গর্ভাবস্থার ষষ্ঠ মাস: সকল খুঁটিনাটি জেনে নিন আজই
ষষ্ঠ মাস - অর্থাৎ আগের পাঁচ পাঁচটি মাস আপনি সুন্দর ভাবে পার করে ফেলেছেন। এখন আপনি সেকেন্ড ট্রাইমেস্টারের শেষ ভাগে অবস্থান করছেন। আর মাত্র ৩ মাসের অপেক্ষা। তারপরই আপনার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখবে। আপনার এত কষ্ট, এত অপেক্ষা, এত সতর্কতার মধ্যে দিয়ে যে শিশু জন্ম নিতে চলেছে, সে নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। তবে এই শেষদিকে এসে যেন কোনো রকম ভুল না হয়, গর্ভবতী মা ও শিশুর যেন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত অসুবিধায় পরতে না হয়, সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। গর্ভাবস্থার ষষ্ঠ মাসের সাথে সম্পর্কিত সব কিছু নিয়ে আজকের ব্লগে আমরা বিস্তারিত জেনে নেব।
ষষ্ঠ মাসে শিশুর বেড়ে ওঠা
যেহেতু এটা ষষ্ঠ মাস, তাই আপনার গর্ভস্থ ছোট্ট শিশুটি এখন আর ততটা ছোট নেই। ৬ মাস বয়স্ক ভ্রূণ আট থেকে বারো ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। ওজন হতে পারে ৮০০ থেকে ১০০০ গ্রাম।
ইতিমধ্যে গর্ভস্থ বাচ্চার ফুসফুস এবং অনন্য আঙুলের ছাপ পুরোপুরি ভাবে তৈরি হয়ে গেছে। ষষ্ঠ মাসে বোনম্যারো বা অস্থি মজ্জা থেকে রক্ত কণিকা তৈরি শুরু হয়। এছাড়াও আইব্রো (ভ্রু) এবং আইল্যাশ তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়।
যদিও আটাশ সপ্তাহের আগে 'কিক কাউন্ট' করা হয় না, তবে ছয় মাসের গর্ভবতী মা নিজে নিজেই বাচ্চার নড়াচড়া, বাচ্চার হাত পা ছোড়ার হিসাব রাখতে পারেন। বিশেষ করে যারা এর আগেও গর্ভধারণ করেছেন, তারা এই হিসাবটা ভাল ভাবে করতে পারবেন।
ষষ্ঠ মাসে মায়ের সাধারণ কিছু লক্ষণ ও তার প্রতিকার
১) যদি আপনি গর্ভাবস্থার আগের মাসগুলো নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করে থাকেন, তাহলে আপনি নিশ্চয়ই জানেন, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং বদহজম গর্ভাবস্থায় হাত ধরাধরি করে চলে। হরমোনের ওঠানামা, স্লো ডাইজেশন, ভিটামিন মিনারেল সাপ্লিমেন্টেশন, বার বার প্রস্রাবের ভয়ে কম কম পানি খাওয়া এসব কারণে গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য ও হজমের গোলমাল হরদম হয়ে থাকে। একে পুরোপুরি প্রতিরোধ করা যাবে না তবে সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বেশি বেশি পানি খাওয়া, ফাইবার বা আঁশ জাতীয় খাবার খাওয়া, অল্প অল্প করে বারে বারে খাওয়া যেতে পারে।
২) প্রথম ট্রাইমেস্টারের প্রধান সমস্যা যদি বমি বমি ভাব, খেতে না পারা, কিছু খেতে গেলেই বমি আসা হয় তবে দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া। গর্ভের শিশু যত বড় হয়, ততই তার পুষ্টিচাহিদা বাড়তে থাকে। একজন ছয় মাসের প্রেগনেন্ট মাকে স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ খাবার খেতে হয়। অনেক সময় কোনো স্পেসিফিক ধরনের খাবারের জন্য মা অস্বাভাবিক রকম ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই ধরনের 'ক্রেভিং' গর্ভবতী মায়ের জন্য খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা।
মাকে সাধারণ মাছ, মাংস, ভাত, ডাল, সবজি এসব খাবারই খেতে বলা হয়। তবে খাবারের পরিমাণ প্রেগনেন্সির সময় অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে। দুধ এবং অন্যান্য ডেইরি প্রডাক্ট অবশ্যই খাদ্য তালিকায় থাকা উচিত। এছাড়াও রঙিন ফল বিশেষ করে ভিটামিন সি যুক্ত ফল প্রতিদিন অন্তত একটা করে খাওয়া উচিত।
আমাদের দেশে বিশেষ করে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যে খাবার নিয়ে বেশ কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। অনেকে মনে করেন, ভালো খাবার মানেই দামী খাবার। বিষয়টা মোটেই সেরকম নয়। যেমন ধরুন, আপেল বেশ দামী একটা ফল। প্রতিদিন গর্ভবতী মাকে ২ টা করে আপেল খাওয়ানো অনেক পরিবারের পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ পেয়ারা বেশ সাশ্রয়ী এবং সুস্বাদু একটি ফল। পেয়ারার পুষ্টিগুণ প্রায় আপেলের সমপরিমাণ। এক্ষেত্রে মাকে আপেলের বদলে রোজ একটি করে পেয়ারা খাবার পরামর্শ দেয়া যেতে পারে।
৩) পায়ের ফোলা ভাব মায়েদের একটি কমন অভিযোগ। অনেক মায়েরা পায়ের পাশাপাশি হাত, মুখ, চোখের চারপাশ ফুলে যাবার অভিযোগ করে থাকেন। বিশ্রাম নেবার পরে ফোলা ভাব কমে গেলে তা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তবে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেবার পরও যদি ফোলাভাব আগের মতই বজায় থাকে, তবে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
অনেক সময় গর্ভবতী মা এবং গর্ভবতী মায়ের পরিবার হাত পা ফোলার বিষয়টাকে তেমন একটা গুরুত্ব দিতে চান না। গ্রাম গঞ্জে স্বাস্থ্য কর্মী এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্র পর্যাপ্ত না হওয়ায় অনেক মায়ের 'প্রি একলাম্পসিয়া' ডায়াগনোসিসই হয় না। এর ফলে মা বাচ্চা উভয়ের প্রাণ সংশয় হতে পারে। তাই হঠাৎ করে হাত পা ফুলে গেলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত, অন্তত ব্লাড প্রেশারটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চেক করা উচিত।
৪) পিঠে এবং শরীরের অন্যান্য স্থানে ব্যথা হতে পারে। আস্তে আস্তে গর্ভস্থ শিশু বেড়ে উঠসে, বাড়ন্ত গর্ভাশয় মূত্রথলি এবং পেলভিক মাংসপেশির উপর চাপ দিতে থাকে। ফলাফল - পিঠে বিশেষ করে কোমড়ের দিকে প্রচন্ড ব্যথা। ডেলিভারির পর সাধারণত এই ব্যথা কমে যায়, তবে অনেক ক্ষেত্রে নাও কমতে পারে।
৫) ইনসমনিয়া বা ঘুম না আসা বা ঘুমের অসুবিধা নিয়ে অনেক মা অভিযোগ করে থাকেন। যেহেতু মায়েদের এসময় হরমোন জনিত কিছু সমস্যা হয়ে থাকে এবং বাচ্চা ক্রমাগত নড়াচড়া করতে শুরু করে, তাই মায়েরা ভাল ভাবে ঘুমাতে পারেন না। অথচ একজন গর্ভবতী মায়ের রাতে অন্তত আট ঘন্টা ঘুম এবং দুপুরে অন্তত দুই ঘন্টা বিশ্রাম নেয়া খুবই জরুরি।
অন্যান্য সময়ের অনিদ্রা জনিত সমস্যার থেকে গর্ভাবস্থার সমস্যা গুলি একেবারেই আলাদা। বিশেষ করে এসময় ঘুমের ওষুধের বদলে কিছু কার্যকরী টিপস ফলো করা উচিত। যেমন - রাত আটটার মধ্যে রাতের খাবার খাওয়া, খাবার আধা ঘন্টা থেকে এক ঘন্টার মধ্যে শুয়ে পড়া, সন্ধ্যার পর মোবাইল, ল্যাপটপ জাতীয় গ্যাজেট পারতপক্ষে এড়িয়ে চলা, ঘুমের আগে বই পড়া, হালকা মিউজিক শোনা কিংবা হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করা। মোটকথা, আপনার মন ও শরীরকে প্রশান্তি দিতে যা যা করা জরুরি, সেগুলো করার মাধ্যমে অনিদ্রা জাতীয় সমস্যা দূর করা হয়।
ডাক্তারের কাছে কখন যাবেন? কেন যাবেন?
প্রথমেই কখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত সেই কথায় আসি -
-
ভ্যাজাইনাল ব্লিডিং বা যোনি পথে রক্তপাত হলে
-
লিকেজ অর্থাৎ পানি ভেঙে গেছে এমন মনে হলে
-
প্রস্রাবে কষ্ট অথবা প্রস্রাবের রাস্তায় সংক্রমণের অন্য কোনো লক্ষণ দেখা দিলে
-
অস্বাভাবিক বেশি মাত্রায় জ্বর হলে
-
ক্রমাগত বমি বা ডায়রিয়া হলে
-
বাচ্চার নড়াচড়া হঠাৎ আগের চেয়ে কমে গেলে
-
প্রচন্ড মাথাব্যথা হলে
কেন যাবেন সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। গর্ভাবস্থায় যত বেশি আপনি একজন চিকিৎসকের নজরে থাকবেন, গর্ভাবস্থা আপনার জন্য ততটাই নিরাপদ হবে। যেকোনো ধরনের সমস্যা হলে তো যেতেই হবে, এছাড়াও প্রত্যেকে নিজেদের সামর্থ্য এবং কত কাছাকাছি ডাক্তার কিংবা স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে তার উপর ভিত্তি করে নিয়মিত চেক আপ করতে পারেন। শহর বন্দর এলাকায় একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ যতটা সহজে পাওয়া যায়, গ্রাম এলাকায় সেটা পাওয়া যায় না। তবুও প্রতি মাসে, সম্ভব না হলে অন্তত প্রতি ২ মাসে মায়ের রক্ত, প্রস্রাব, ওজন বৃদ্ধি এসব পরীক্ষা করা উচিত।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
যেহেতু আমরা আজকে ষষ্ঠ মাস নিয়ে কথা বলছি, হাতে আর খুব বেশি সময় নেই। সাধারণত প্রথম ভিজিটেই মায়ের রক্তের গ্রুপিং, টাইপিং করানো হয়। ষষ্ঠ মাস থেকেই মাকে রক্ত দেবার জন্য ডোনার জোগাড় করে রাখা উচিত। কোথায় কিভাবে কার হাতে ডেলিভারি হবে সেটাও ভাবার সময় চলে এসেছে। ডেলিভারির সকল প্ল্যানিং এখন থেকেই শুরু করা উচিত।
একজন গর্ভবতী মাকে নিয়ে আমরা যতটা আগ্রহ দেখাই, যে মানুষটা আর তিন মাস পরেই বাবা হতে চলেছে তাকে নিয়ে আমাদের ততটা আগ্রহ থাকে না। যদিও এই পুরো সময়টা তার জন্যও যথেষ্ট উত্তেজনা ও আবেগের। হবু বাবার জন্য এটাই মানসিক ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করার উপযুক্ত সময়। স্ত্রী ডাক্তারের কাছে যাবার সময় তাকে সঙ্গ দেয়া, হবু বাচ্চার নাম ঠিক করা, যে কাজগুলো স্ত্রী এখন আর করতে পারছেন না সেগুলো করে দেয়ার পাশাপাশি মানসিক ভাবে নিজেকে শক্ত রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
ষষ্ঠ মাস শেষ করে একজন মা যখন সপ্তম মাসে পা দেবার জন্য তৈরি হয়, তখন ইতিমধ্যে তিনি মা হবার প্রাথমিক ধাপ পার করে ফেলেছেন। এখন অপেক্ষা শুধু গর্ভের সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার। প্রেগনেন্সি এবং প্রেগনেন্সি পরবর্তী জটিলতা একেবারে এড়ানোর কোনো উপায় আমাদের হাতে নেই। তবে আমাদের সবার চেষ্টায় সেটা অনেকটা কম হতে পারে। একজন শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ মা যেন সুন্দর ভাবে সুস্থ একটি শিশুর জন্ম দিতে পারেন সেদিকে আমাদের সবার খেয়াল রাখা উচিত