সন্তান নেওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি (পর্ব-১): গর্ভধারণ করার উপযুক্ত সময় কখন?

সন্তান গর্ভে ধারণ করার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন মায়ের মনে থাকে নানারকম প্রশ্ন। গর্ভধারণের ক্ষেত্রে সহায়ক নিয়ামক থেকে শুরু করে এই সময়ের সুস্থতা নিশ্চিতে করণীয় এমন প্রতিটি ব্যাপারেই মায়ের থাকে জিজ্ঞাসা। ছোট্ট কিছু প্রশ্নের উত্তরেই সহজ, স্বাভাবিক ও ভীতিহীন হয়ে উঠতে পারে একজন নারীর মা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। আসুন জেনে নেই বিস্তারিত।

দুইজনের সংসারে নতুন কাউকে নিয়ে আসার কথা ভাবছেন? পরিবারের নতুন এই পদক্ষেপ নিয়ে সবার মধ্যে কাজ করে অনেক অনেক উত্তেজনা আর নানান রকমের চিন্তাভাবনা। তবে এই সমস্ত আশা-প্রত্যাশাকে সুস্থ একটা জীবন হিসেবে পৃথিবীতে স্বাগতম জানাতে চিন্তার পাশাপাশি প্রয়োজন যথাযথ পরিকল্পনারও। সন্তান জন্মের আগে থেকে গর্ভকালীন এবং এর পরবর্তী সময়ে একজন মা, বাবা ও একটি পরিবারের প্রয়োজন পরিকল্পনার। এতে করে শুধু সন্তান নয়, মায়ের সুস্থতা নিশ্চিত করাও সম্ভবপর হয়ে উঠবে।

এই সময় একজনের মায়ের মনে হরেক রকম প্রশ্নের জন্ম নিয়ে থাকে। মা হওয়ার উপযুক্ত সময় কখন? গর্ভকালীন আমার সন্তান সুস্থ থাকবে কোন খাবারগুলো খেলে? আমার ওজন কি সন্তানের স্বাস্থ্যের উপরে কোন প্রভাব ফেলবে? ইত্যাদি। গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানের সময়কালীন সুস্থতা নিয়ে জানতে চাওয়া প্রশ্নগুলোর প্রথম পর্বে চলুন আজ একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাকক। 

গর্ভধারণ করার উপযুক্ত সময় কখন?

গর্ভধারণ করার সবচাইতে সেরা সময় কোনটা, এই প্রশ্নের উত্তরটা ঠিক দুইরকম হতে পারে। একভাবে যদি বলা হয়, গর্ভধারণ করার জন্য একজন মা ও বাবা- দুজনেরই মানসিক, শারীরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সাবলম্বী হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। কারো কথা শুনে বা সামাজিক চাপে, বয়স বেড়ে যাওয়ার কারণে বা শুধুই শখের বশে সন্তানকে পৃথিবীতে নিয়ে আসা কোনদিক দিয়েই খুব একটা ভালো ফলাফল রাখে না। 

তবে এসব বাদেও আরেকটি দিক আছে এই প্রশ্নের। আর সেটি হলো, ঠিক কোন সময়ে, কীভাবে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে গর্ভধারণ করাটা কার্যকরী বেশি হয়।

সাধারণত গর্ভধারণের সবচাইতে উর্বর সময় মনে করা হয় আপনার পরবর্তী পিরিয়ড শুরু হওয়ার ১২-১৪ দিন পূর্বে। এই সময় জরায়ু ডিম্বানু নিঃসরণ করে এবং শুক্রাণু সবচেয়ে বেশি নিষিক্ত হওয়ার সম্ভাবনায় থাকে। তবে তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে, পিরিয়ড হওয়ায় পরপরই গর্ভধারণের সম্ভাবনা বেশি থাকে। কারণ, অনেকসময় শুক্রাণু শারীরিক মিলনের ৭ দিন পর্যন্ত জরায়ুতে অবস্থান করতে পারে। আপনার জরায়ু দ্রুত ডিম্বানু নিঃসরণ করলে দ্রুত গর্ভধারণের সম্ভাবনা থাকে পিরিয়ডের পর।

আপনার যদি পিরিয়ড ২৮ দিনের সার্কেল মেনে চলে, সেক্ষেত্রে আপনার শরীরে পিরিয়ডের ১৪ দিনের পর ডিম্বানু উৎপন্ন হবে এমন সম্ভাবনাই বেশি। সবচেয়ে ভালো হয় চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে এই সময় ওভালুয়েশনের সময় নির্ধারণ করা এবং সেই অনুযায়ী শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা।

জন্মনিরোধক পিল খাওয়া বন্ধ করুন

আপনি যদি ভেবেই থাকেন সন্তান নেওয়া কথা, তাহলে বার্থ কন্ট্রোল পিল খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। গর্ভধারণের চেষ্টা করার এক মাস আগে থেকেই পিল খাওয়া বন্ধ রাখুন। সাধারণত যেকোন নারীর পিরিয়ডের সাইকেল স্বাভাবিকভাবে একরকম থাকে। ফলে তার ডিম্বাণু তৈরি হওয়ার সময়টাও নির্দিষ্ট থাকে। তবে বার্থ কন্ট্রোল পিল গ্রহণ করলে এই সাইকেল বদলে যায়। 

তাই গর্ভধারণের আগে পিল সেবন বন্ধ করে দিন। এক্ষেত্রে ধীরে ধীরে আপনার শরীরে স্বাভাবিক হরমোন উৎপন্ন হবে এবং শরীর গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত হবে। তবে পিল বন্ধ করার আগে কয়েকটি ব্যাপার নিয়ে একদম নিশ্চিত থাকুন যে, আপনি গর্ভধারনের জন্য মানসিকভাবে পুরোপুরি নিশ্চিত। একইসাথে খেয়াল রাখুন যেন পিল খাওয়া পুরো সাইকেল শেষ হওয়ার আগে বন্ধ না করা হয়। অন্যথায়, শরীর তার গতানুগতিক অভ্যস্ত সাইকেল থেকে বের হয়ে আসতে আরো বেশি সমস্যার মুখোমুখি হবে।

শারীরিক মিলনে করণীয়

দ্রুত গর্ভধারণের জন্য নিচের প্রক্রিয়াগুলো মাথায় রাখুন-

  • নিজের পিরিয়ডের সাইকেল নিয়ে সচেতন হোন এবং হিসেব রাখুন। আপনার পিরিয়ড যদি অনিয়মিত বা দীর্ঘ সময় ধরে হয়ে থাকে, অথবা পিরিয়ডের সিকেলে কোন অস্বাভাবিকতা দেখতেই চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন। বার্থ কন্ট্রোল পিল খাওয়া বন্ধ রাখুন এবং শারীরিক হরমোনকে পিরিয়ড সাইকেল কন্ট্রোল করার সুযোগ দিন।

  • সাধারণত পিরিয়ড ২৮ দিনের হলে ১৪-১৫ দিনের মাথায় একজন নারীর শরীরে ডিম্বাণু জন্ম নেয়। তাই মানসিক ও শারীরিকভাবে তৈরি থাকুন এবং ক্যালেন্ডার মেনে চলুন এই ডিম্বাণু তঈরির সময়ে ও এই সময়েই শারীরিক মিলন করুন।

  • ডিম্বাণু জন্ম নেওয়ার সময়ের ৫ দিন আগ থেকে ওই দিন পর্যন্ত একজন নারীর শরীর নিষিক্ত হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রস্তুত থাকে। এই সময়টায় তাই একদিন গ্যাপ রেখে রেহে শারীরিক মিলনের জন্য প্রস্তুত হয়ে নিন। এতে করে আপনার গর্ভধারণের পরিমাণ শতকরা ৩৩ থেকে ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। 

  • ওজন গর্ভধারণের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখে। তাই আপনার শরীরের বডি মাস ইন্ডিকেটর অনুযায়ী চিকিৎসকের সাথে কথা বলে ওজন কমিয়ে বা বাড়িয়ে নেওয়ার চেষতা করুন এবং প্রিন্যাটাল সাপ্লিমেন্ট সেবন করুন।

সঙ্গীর সাথে আলোচনা করুন

সন্তানের গর্ভধারণ নিয়ে যেকোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রথমেই আপনার সঙ্গীর সাথে কথা বলে ফেলুন। হয়তো আপনি মানসিকভাবে একটি সন্তানের জন্য প্রস্তুত, কিন্তু আপনার সঙ্গী হয়তো নন। এছাড়া সন্তান ও তার জন্মদান নিয়ে আপনার সঙ্গীর ভিন্ন কোন মতামতও থাকতে পারে। এই সবকিছু সম্পর্কে জানার জন্য প্রয়োজন তার সাথে কথা বলা।

এমনটাও হতে পারে যে আপনারা দুজনেই সন্তানের জন্য তৈরি। কিন্তু তাকে কীভাবে বড় করবেন, কোথায় জন্ম দিবেন, কোন পরিবেশে বড় করবেন ইত্যাদি ছোট ছোট ব্যাপারগুলো নিয়েও গর্ভধারনকালীন সময়ে সঙ্গীর সাথে অবশ্যই আপনার কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। হতেই পারে কোন ব্যাপারে আপনাদের মতামত মিললো না। তবে তার মানে কিন্তু এই নয় যে গর্ভধারনের পুরো পরিকল্পনা থেকেই এজন্য আপনারা দুজন বের হয়ে আসবেন বা গর্ভধারণ করাটাই ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে।  

দিনশেষে আপনারা দুজনেই সন্তানের অভিভাবক। তাই নিজেদের মধ্যকার ভিন্নমতকে সন্তানের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু না ভেবে পথ চলুন। ছোট ছোট ব্যাপারগুলোতে পাওয়া মিল নিয়ে আনন্দে থাকুন এবং প্রেগনেন্সি টাইমকে উপভোগ করুন।

গর্ভধারণ করার আগেই জেনেটিক স্ক্রিনিং করিয়ে নিন

জেনেটিক কারণে অনাগত শিশু ও মা দুজনেই নানারকম সমস্যায় ভুগতে পারেন গর্ভধারনকালীন সময়ে। হয়তো আপনি শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ এবং সন্তান ধারণে সক্ষম। কিন্তু আপনার সঙ্গীর জেনেটিক সমস্যা বা শারীরিক কোন অসুস্থতার কারণে এই পুরো গর্ভকালীন সময়টাতেই আপনি ও আপনার অনাগত সন্তান ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন। অনেক ক্ষেত্রেই সিস্টিক ফাইব্রোসিস, সিকল সেল ডিজিজ ইত্যাদি জেনেটিক বংশগত অসুস্থতা পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে এবং গর্ভধারণ প্রক্রিয়ায় সমস্যা তৈরি করে। 

তাই গর্ভধারণ করার আগেই আপনার ও আপনার সঙ্গীর জেনেটিক ক্যারিয়ায় স্ক্রিনিং সম্পন্ন করুন। যদি কোন বংশগত সমস্যা আপনার বা আপনার সঙ্গীর মধ্যে থেকেও থাকে তাহলেও সেটা আপনার শিশুর মধ্যে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে এক চতুর্থাংশ। সেক্ষেত্রে আরো আগে থেকেই আপনি এ সম্পর্কে জেনে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবেন। 

আপনারদের সমস্যা নিয়ে কোন জেনেটিক কাউন্সিলরের সাথেও এর মধ্যে আপনারা কথা বলে নিতে পারেন। এই ছোট্ট একটি কাজের মাধ্যমেই আপনার অনাগত সন্তানকে একটি সুন্দর আর সুস্থ জীবন নিশ্চিত করতে পারবেন আপনি কুব সহজেই।

পরিবারের হেলথ হিস্ট্রি জানুন

সন্তান জন্মের আগে মা-বাবা দুজনেই খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন ছোট্ট শিশুর চোখটা কার মতো হবে, গালটা কার মতো হবে সেটা ভেবে। কিন্তু শুধু চোখ, গাল বা শারীরিক বৈশিষ্ট্যই নয়, একটি শিশু তার বাবা আর মায়ের শারীরিক সমস্যা ও অসুখগুলোকেও নিজের করে নেয়। এই সমস্যাগুলোকে আগে জানার মাধ্যমে আপনি-

  • মিসক্যারেজ

  • সন্তান না হওয়া

  • পূর্বে জন্ম নেওয়া সন্তানের শারীরিক সমস্যার কারণ জানা

  • পূর্ববর্তী সন্তানের মৃত্যুর কারণ ইত্যাদি জানতে পারবেন। 

আর এই তথ্যগুলো আরো পরিপাটিভাবে আপনাকে গর্ভধারণের পরিকল্পনা করতে সাহায্য করবে। 

পারিবারিক স্বাস্থ্য ইতিহাস জানার জন্য-

  • পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলুন

  • পারিবারিক চিকিৎসক থাকলে তার সাথে কথা বলুন

  • পরিবারের সদস্যদের কোন শারীরিক সমস্যা ও এর কারনে চিকিৎসককে দেখানোর তথ্যাদি থাকলে সেগুলো সাথে রাখুন

এক্ষেত্রে আপনার সন্তানকে ভবিষ্যতে আপনি যেকোন সমস্যা থেকে দূরে রাখোতে সক্ষম হবেন।

কর্মক্ষেত্রের ব্যাপারে সতর্ক হোন

শুধু ঘরে নয়, কখনো কি ভেবেছেন আপনার বর্তমান কাজের চাপ নিয়ে আপনি সুস্থ গর্ভধারণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে পারবেন কিনা? আপনার অফিস টাইম, সেটা দিন না রাত বা কত ঘন্টা বা কাজের ধরণ কী- এই সবকিছুর উপরে নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিন যে আপনি বর্তমান কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করবেন নাকি সেখানে থাকবেন। কর্মক্ষেত্র একজন মানুষের লাইফস্টাইলের একটা বড় জায়গা জুড়ে থাকে বিধায় এ ব্যাপারেও সচেতন থাকুন।

 

সুস্থ শিশুকে পৃথিবীতে স্বাগতম জানানোর জন্য প্রয়োজন সুস্থ মা, সুস্থ পরিবেশ ও সুস্থ পরিবারের। গর্ভধারণ বা সন্তান জন্মদান খুব হুটহাট করে ফেলার মতো ব্যাপার নয়। তাই চেষ্টা করুন গর্ভধারণের পরিকল্পনাটা সময় নিয়ে করে তারপর এগোতে। এতে করে আপনি যেমন সুস্থ থাকবেন, মাতৃত্বকে উপভোগ করবেন, তেমনি আপনার শিশুও বড় হয়ে উঠবে সুস্থ-সবলভাবে!

আরও জানুন:

Default user image

সাদিয়া ইসলাম বৃষ্টি, লেখক, আস্থা লাইফ

জন্ম ২রা মার্চ, ১৯৯৪, নানুবাড়ী ঝিনাইদহে। বাবার বাসা বরিশাল। বাবা জাহিদুল ইসলাম, মা রোজী ইসলাম, ভাই সাকিব সাদমান বাঁধন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে এমএসএস শেষ করে বর্তমানে একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। লেখা এবং কাজ করার সুযোগ হয়েছে বহুক্ষেত্রে। বর্তমানে জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত লিখছেন। নবীন সাহিত্যিক হিসেবে ২০১৮ সালে ‘আয়েশা ফয়েজ সাহিত্য পুরষ্কার’ পান লেখক।

Related Articles