গর্ভাবস্থার সপ্তম মাসের কিছু সাধারণ সমস্যা ও তার প্রতিকার
এক এক করে ছয়টি মাস পার হয়ে গেছে। শুরু হয়েছে সাত নম্বর মাস। সপ্তম মাস থেকেই গর্ভাবস্থার তৃতীয় ট্রাইমেস্টার শুরু হয়। এখন জরায়ুর ভেতরে আপনার বাচ্চাটি দ্রুত বড় হয়ে উঠছে। প্রস্তুতি নিচ্ছে বাইরে বেরিয়ে আসার। আর মাত্র দুই মাসের অপেক্ষা। তারপরই আপনি আপনার সন্তানের মুখ দেখতে পাবেন, শুনতে পারবেন তার কান্নার শব্দ। আগের মাসগুলোর ধারাবাহিকতায় আজকে আমরা সপ্তম মাস নিয়ে কিছু কথা জেনে নেব।
সপ্তম মাসে গর্ভস্থ শিশুর শারীরিক পরিবর্তন
সপ্তম মাসে গর্ভস্থ শিশু প্রায় ১৪ ইঞ্চি লম্বা হয় এবং দুই থেকে চার পাউন্ড অর্থাৎ এক কেজি থেকে ১৮০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন হয়ে থাকে। ইতিমধ্যে বাচ্চার শ্রবণ ক্ষমতা পুরোপুরি বিকশিত হয়েছে এবং বাচ্চা ক্রমাগত নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। সাত মাসের বাচ্চা শব্দ, ব্যথা, আলো এসব প্রাকৃতিক উদ্দীপকের প্রতি সাড়া দেয় এবং সে অনুযায়ী আচরণ করে।
এ সময় গর্ভের ছোট্ট শিশুটি নিজেই নিজের চোখ খুলতে ও বন্ধ করতে পারে। এ সময় ত্বকের রঙ নির্ধারণকারী 'মেলানিন' তৈরি শুরু হয় এবং ত্বকের নিচে ফ্যাট জমা হতে থাকে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সাত মাসের প্রিম্যাচিউর বাচ্চা জন্ম হলে অনেক ক্ষেত্রেই তাকে বাঁচানো যায়। সাত মাস বয়সে বাচ্চার ফুসফুসে সারফেকটেন্ট তৈরি হতে থাকে, যা ফুসফুস ক্রমাগত সম্প্রসারণ ও সংকোচনে সাহায্য করে। অর্থাৎ সারফেকটেন্ট তৈরি হতে শুরু করলে বাচ্চা মায়ের গর্ভের বাইরে নিজে নিজে শ্বাস প্রশ্বাস চালাতে সমর্থ হয়। এজন্য সাত মাসের বাচ্চা প্রিম্যাচিউর হলেও দ্রুত এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিলে বাচ্চাকে বাঁচানো সম্ভব হতে পারে।
সপ্তম মাসের কিছু সাধারণ সমস্যা ও তার প্রতিকার
নিন্মক্ত বিষয়গুলো মাথায় রাখলে কিছু জটিলতা সহজে এড়ানো যায়।
-
যেহেতু আপনি এখন সাত মাসের গর্ভবতী, আপনার হাঁটা চলা কাজকর্ম সব কিছুই এখন সীমিত পরিসরে করতে হবে। বাচ্চার ক্রমাগত বেড়ে ওঠার কারণে আপনার পেট সামনের দিকে অনেকটা বেড়ে যায়। ফলে হাঁটতে কষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। যতটা সম্ভব বসে বসে কাজকর্ম করতে হবে।
-
দিন দিন জরায়ু আকারে বড় হচ্ছে, ক্রমবর্ধমান ইউটেরাস এবং সন্তানের মাথা একত্রে সায়াটিক নার্ভের উপর চাপ দেয়। এ থেকে তীক্ষ্ণ লো ব্যাক পেইন বা পিঠে ব্যথা হতে পারে। পিঠ থেকে এই ব্যথা কোমড়, নিতম্ব এমনকি পায়ের পিছন দিক পর্যন্ত চলে যেতে পারে। একে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে 'সায়াটিকা'। ব্যথা কমানোর জন্য গরম সেঁক দিতে পারেন কিংবা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কোনো ওষুধ খেতে পারেন।
-
অনেক মা থার্ড ট্রাইমেস্টারে স্তনে ছোট খাটো লাম্প (Lump) বা চাকা নিয়ে আসেন। এতে ভয়ের কিছু নেই। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রেগনেন্সিতে ব্রেস্ট ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবুও পরের বার রুটিন চেক আপ করার সময় আপনার চিকিৎসককে বিষয়টি জানাতে ভুলবেন না।
-
উচ্চ মাত্রার প্রজেস্টেরণ এবং আয়রন ট্যাবলেট খাবার কারণে হজম প্রক্রিয়া ধীরে হয় এবং পেট ফাঁপা বা সব সময় খাবার গলার কাছে দলা পাকিয়ে আছে বলে মনে হতে পারে। এ সমস্যা এড়ানোর জন্য প্রচুর পানি খেতে হবে এবং রোজকার খাদ্য তালিকায় আঁশ জাতীয় খাবার রাখতে হবে।
-
ব্রাক্সটন হিকস কনট্রাকশন - কাজ কর্ম করার পর অনেক সময় কনট্রাকশন হতে পারে। একে ফেইক কনট্রাকশন বা ব্রাক্সটন হিকস কনট্রাকশন বলা হয়। যদিও স্বাভাবিকভাবে সপ্তম মাসে প্রসবকালীন কনট্রাকশন বা সংকোচন শুরু হয় না। তবুও সংকোচন হচ্ছে বা পেটে চাপ ভাব অনুভব করলে নিশ্চিত হবার জন্য নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগাযোগ করা উচিত।
-
অনেক মা সেকেন্ড ট্রাইমেস্টারে সতেজ ও উৎফুল্ল বোধ করেন। প্রথম ট্রাইমেস্টারের বমি বমি ভাব, মাথা ঘুরানো, খেতে না পারার মত সমস্যাগুলি সেকেন্ড ট্রাইমেস্টারে থাকে না। তবে তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে যত দিন এগিয়ে আসতে থাকে মা ততই ক্লান্ত শ্রান্ত বোধ করতে থাকেন। যেহেতু মায়ের পেটের আকার বড় হচ্ছে, রাতে ঠিকভাবে ঘুম না হওয়া স্বাভাবিক। এছাড়া পেটের সন্তান সারা রাত ধরে দফায় দফায় লাথি মারা বা হাত পা ছোঁড়াছুড়িতে ব্যস্ত থাকে। হাঁটাচলা কাজকর্ম সব কিছুতেই মায়ের অসুবিধা হতে থাকে। যতটা সম্ভব এ সময় বিশ্রাম নিতে হবে। অনেক সময় ঘুমানোর আগে পেটের নিচে নরম পাতলা বালিশ রাখলে কিছুটা আরাম বোধ হয়।
-
হালকা হালকা রক্তপাত বা স্পটিং হতে পারে। যদিও বেশির ভাগ সময়েই এতে ভয়ের কিছু থাকে না, তবুও প্রেগনেন্সিতে সতর্ক থাকা ভালো। ব্লিডিং তা যত সামান্যই হোক, চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি।
সপ্তম মাসের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা
নিয়মিত চেক আপে যেসব পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়, সেগুলোর পাশাপাশি সপ্তম মাসে ফান্ডাল হাইট মাপা খুবই জরুরি।
তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে প্রতি সপ্তাহে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে ফান্ডাল হাইট মাপা উচিত। সাধারণত 'যত সপ্তাহ, তত সেন্টিমিটার' এই হিসাবে ফান্ডাল হাইট দেখা হয়। এ থেকে বাচ্চার গ্রোথ ডেভেলপমেন্ট অর্থাৎ বাচ্চা ঠিকভাবে বেড়ে উঠছে কিনা, লিকার বা পানি কম বেশি আছে কিনা সেটা জানা যায়।
সপ্তম মাসে প্রয়োজনীয় খাবার দাবার
গর্ভাবস্থায় পুষ্টিকর খাবার খাওয়া মা ও শিশু দুজনের জন্যই খুবই প্রয়োজনীয়।
-
আয়রন ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার - অ্যানিমিয়া এবং হেমোরেজ বা অনাকাঙ্ক্ষিত রক্তপাত প্রতিরোধ করার জন্য প্রচুর পরিমাণে আয়রন যুক্ত খাবার খেতে হবে। বাচ্চার সঠিক ভাবে বেড়ে ওঠার জন্যও এসব পুষ্টিগুণ দরকার হয়। প্রতিদিন প্রায় ২৭ মিলিগ্রাম আয়রন এবং প্রায় ১০০ গ্রাম প্রোটিন মায়ের শরীরের জন্য প্রয়োজন পড়ে। পালং শাক, ড্রাই ফ্রুটস, কুমড়া, কলিজা, সয়াবিন এসবে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে। এছাড়াও প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর জন্য নিয়মিত ডিম, মাংস, ডাল এবং দুগ্ধজাত খাবার খেতে হবে।
-
ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার - বাচ্চার হাড়ের গঠন যেন ঠিক থাকে এজন্য থার্ড ট্রাইমেস্টারে প্রচুর পরিমাণে ডেইরি প্রডাক্ট যেমন দুধ, দই, ছানা, পনির, বিভিন্ন রকম মিষ্টান্ন খাওয়া উচিত।
-
ফলিক এসিড - ফলিক এসিডের অভাবে বাচ্চার নিউরাল টিউব ডিফেক্ট হতে পারে। গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন ৪০০ মিলিগ্রাম ফলিক এসিড প্রয়োজন। সবুজ শাক সবজি, কমলালেবু, বিভিন্ন রকম শস্য থেকে ফলিক এসিড পাওয়া যায়। এছাড়াও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ফলিক এসিড ট্যাবলেট মুখে খাওয়া যেতে পারে।
-
আঁশ জাতীয় খাবার - কোষ্ঠকাঠিন্য গর্ভবতী মায়েদের রোজকার সমস্যা। এমন কোনো গর্ভবতী মা নেই যে এই সমস্যায় কম বেশি ভোগে না। শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের কারণেই কোষ্ঠকাঠিন্য গর্ভাবস্থার একটি সার্বজনীন সমস্যা। এ সমস্যা একেবারে সমাধান করা হয়ত সম্ভব নয়, তবে সহনীয় মাত্রায় রাখার জন্য নিয়মিত এক্সারসাইজ করতে হবে এবং আঁশজাতীয় খাবার খেতে হবে।
-
ভিটামিন সি - টক জাতীয় বিভিন্ন ফল এবং কিছু কিছু সবজিতে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। এছাড়াও এই ভিটামিন বাজারে 'সিভিট' নামে কিনতে পাওয়া যায়। ভিটামিন সি Iron Absorption বা লৌহ শোষণে সহায়তা করে।
যেসব খাবার থেকে দূরে থাকবেন
গর্ভাবস্থায় কিছু খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। যেমন,
-
ভাজাপোড়া তেল মসলা যুক্ত স্পাইসি খাবার থেকে হার্টবার্ন বা বুক জ্বালাপোড়া হতে পারে। এমনিতেই এসময় স্লো ডাইজেশনের কারণে খাবারের হজম বিষয়ক কিছু গোলমাল দেখা দেয়। তাই এসব ভাজা পোড়া খাবার একেবারেই খাওয়া যাবে না।
-
অতিরিক্ত সোডিয়াম যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। সোডিয়াম যুক্ত চিপস, আচার, সস, কেচাপ থেকে ব্লোটিং হতে পারে।
-
চা কফি একেবারে বাদ দিতে পারলেই ভালো; তবুও যদি খেতেই হয়, দিনে এক কাপের বেশি খাওয়া যাবে না। বাজারের বিভিন্ন কোল্ড ড্রিংকস খেতে যতই সুস্বাদু ও রিফ্রেশিং হোক, গর্ভাবস্থায় এসব খাওয়া পুরোপুরি নিষেধ।
-
এলকোহল নিয়ে আগেও বলেছি, আবারো বলছি। সুস্থ স্বাভাবিক বাচ্চা জন্ম দিতে হলে গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার সময়েই ধূমপান, মদ্যপান বাদ দিতে হবে। বাচ্চার মা, বাবা এবং বাচ্চার সরাসরি সংস্পর্শে আসবে এমন যেকোনো মানুষকে মদ এবং সিগারেট থেকে দূরে থাকতে হবে।
নিয়ে নিন সাধারণ কিছু প্রস্তুতি
যেহেতু সাত মাস হয়ে গেছে, আপনাকে এখন বাচ্চার জন্মের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। বাচ্চাকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়ে যায়। বাচ্চা কোথায় ডেলিভারি হবে - বাড়িতে নাকি হাসপাতালে, বাড়িতে হলে মিড ওয়াইফ বা প্রশিক্ষিত দাই ঠিক করা, হাসপাতালে হলে নর্মাল নাকি সিজারিয়ান, রক্ত দেবার জন্য অন্তত দুইজন ডোনার প্রস্তুত করে রাখা, যেকোনো সময় প্রসব বেদনা উঠলে মাকে নিয়ে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহন ঠিক করে রাখা, প্রসব কালীন খরচপাতির জন্য আনুমানিক কিছু টাকা আলাদা করে রাখা - এই সব প্রস্তুতি এখনই নিতে হবে। হাসপাতালগুলোতে বেশির ভাগ মা গ্রাম অঞ্চল বা মফস্বল থেকে আসেন এবং এইসব প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি না থাকার দরুন অহরহ মাতৃমৃত্যু কিংবা শিশুমৃত্যুর মত ঘটনা ঘটে থাকে।
শেষ কথা
গর্ভের যে শিশুকে নিয়ে এত জল্পনা কল্পনা, আর মাত্র দুই মাস পরেই সে পৃথিবীর আলো দেখবে। গর্বিত কন্ঠে সে ঘোষণা করবে নিজের আগমনের জয়বার্তা। এইটুকু সময় একটু ধৈর্য ধরতে হবে, চলতে হবে কিছুটা সাবধানে। গর্ভাবস্থায় সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল পরিবারের সাহায্য। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যদি সহযোগিতা করে তবে এই নয় মাস সময় পার করা মায়ের পক্ষে খুব বেশি কঠিন হয় না। নিয়ম কানুন মেনে চললে, নিয়মিত ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষা করলে এবং ঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া করলে মা ও শিশু উভয়ের সুস্থতাই নিশ্চিত করা সম্ভব।