কিভাবে গর্ভবতী মায়ের যত্ন নিবেন?

গর্ভাবস্থায়, গর্ভবতী মহিলাকে তার জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে, তার নিজের ও শিশুর সুস্বাস্থ্যের জন্য গর্ভকালীন যত্ন নিতে হয়। নিয়মিত পরীক্ষা এবং ডাক্তারের পরামর্শের মাধ্যমে এটি পরিচালিত হয়। গর্ভকালীন সময়ে একজন মাকে অবশ্যই কমপক্ষে ৮ বার স্বাস্থ্য সরবরাহকারী এবং চিকিৎসক এর শরণাপন্ন হতে হবে ও সঠিকভাবে নিয়মগুলি মেনে চলতে হবে।

গর্ভকালীন সময়ে একজন মাকে যে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয় তাই গর্ভকালীন সেবা । গর্ভধারণের সময় হতে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত সময়কালে মা ও শিশুর যত্নকে গর্ভকালীন যত্ন বা Antinatal Care বলে। এই গর্ভকালীন যত্নের লক্ষ্য হল মা ও শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং গর্ভজনিত কোনো জটিলতা দেখা দিলে তার প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করা। এক কথায় মায়ের স্বাস্থ্যের কোনো অবনতি না করে সমাজকে একটি সুস্থ শিশু উপহার দেয়া।

খাদ্যাভ্যাস এবং বিশ্রাম 

নবজাতকের সঠিক ভাবে বেঁচে থাকা নির্ভর করে তার জন্মকালীন ওজনের ওপর। এই জন্মকালীন ওজন নির্ধারিত হয় গর্ভাবস্থায় শিশুটির ঠিক কতখানি ওজন বৃদ্ধি পায় তার ওপর।   

  • সাধারণত গর্ভাবস্থায় একজন নারীর আনুমানিক ৯ থেকে ১১ কেজি ওজন বাড়ে,এবং প্রসবকালীন সময় অতিরিক্ত ক্যালোরি এবং পুষ্টির প্রয়োজন হয়।

  • সাধারণ নারীর খাদ্যভাস এর তুলনায় গর্ভবস্থায় একজন নারীর প্রতিদিন  অতিরিক্ত ৩০০ কিলো ক্যালোরি প্রয়োজন হয় এবং দুগ্ধপান করানোর কারণে তার আরো  ৫৫০ কিলোক্যালোরি প্রয়োজন।

  • এ সময় মহিলাদের অবশ্যই প্রোটিন, আয়রন, ভিটামিন-এ সম্বৃদ্ধ এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টিজাতীয় খাবার খেতে হবে। 

গর্ভবতী মায়ের সঠিক খাদ্য তালিকা  

  • সিরিয়াল, দুধ এবং দুধ জাতীয় পণ্য, দই 

  • সবুজ শাকসবজি এবং অন্যান্য সবজি 

  • মাছ মুরগি মাংস ডিম এবং ডাল 

  • বাদাম (বিশেষত চীনাবাদাম)

  • ফলমূল (আনারস, গাজর, কাঁচা পেঁপে পরিত্যাগ করতে হবে)

  • ভারী কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে, যেমন নির্মাণ সম্পর্কিত কাজ, সারাদিন অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমযুক্ত কাজ। কারণ এগুলো বাচ্চার জন্মকালীন ওজনের ব্যাপারটা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। 

  • প্রত্যেক মহিলাদের চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা থেকে বিরত থাকতে হবে বিশেষত গর্ভাবস্থার শেষ দিকে। 

  • আয়রন এবং ফলিক এসিডের পরিপূরক খেতে হবে।

  • গর্ভবতী মায়েদের গর্ভাবস্থায় সাধারণত  আয়রন এর অভাব হয়,বিশেষ করে দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার এর সময় যা খাবার দিয়ে পূরণ করা সম্ভব হয় না। তাই ১৬ সপ্তাহ থেকে আয়রন ট্যাবলেট খেতে দেয়া হয়। বাচ্চার যাতে কোনো মস্তিষ্কের ত্রুটি না হয়,তার জন্য গর্ভধারণের ৪ সপ্তাহ আগে থেকে শুরু করে ১ম ট্রাইমেস্টারএ ফলিক অ্যাসিড খেতে দেয়া হয়

  • ভিটামিন এবং ক্যালসিয়াম এর পরিপূরক খেতে হবে। 

ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি

প্রতিদিন নিজে পরিছন্ন থাকা, গোসল এবং কাপড় পরিষ্কার করা উচিত, গোসল করার সময় অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।

ঘুমানো এবং বিশ্রাম করা 

প্রতিদিন ৮ ঘন্টা ঘুমাতে হবে এবং দুপুরের খাবার এর পর কমপক্ষে ২ ঘন্টা বিশ্রাম নিতে হবে। 

অন্ত্রের যত্ন

নিয়মিত সবুজ শাকসবজি, ফলমূল এবং অতিরিক্ত তরল খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে কৌষ্ঠকাঠিন্য দূর করা যায়। 

স্তনের যত্ন 

গর্ভধারণের পর স্তন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, এবং অস্বস্থি হতে পারে। এজন্য সঠিক সাইজের অন্তর্বাস বা ব্রেসিয়ার পরিধান করতে হবে।  

মুত্রাশয়ের যত্ন

প্রতিদিন কমপক্ষে ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান করতে হবে।  প্রসাব এর বেগ পেলে সাথে সাথে মূত্র ত্যাগ করতে হবে। সহবাস এর আগে এবং পরে প্রসাব করতে হবে, এতে মূত্রনালীতে ব্যাক্টেরিয়া থাকলে সেটি দূর হয়ে যাবে।

প্রস্রাবের পর সামনে থেকে পিছনের দিকে পরিষ্কার করতে হবে। নিয়মিত পরিষ্কার পরিছন্ন থাকতে হবে। 

সুতির আন্ডারওয়ার এবং ঢিলেঢালা সালোয়ার পরিধান করতে হবে, লেগিংস, চাপা জিন্স পেন্ট যৌনাঙ্গে আদ্র পরিবেশ তৈরী করার ফলে ব্যাক্টেরিয়া কে ধরে রাখতে সহায়তা করে, তাই এধরণের পোশাক পরিধান করা এড়িয়ে চলতে হবে। 

যদি আপনার ডায়বেটিস থাকে তাহলে রক্তে  গ্লুকোজ এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করুন। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে চলুন।

ব্যায়াম 

বাসা বাড়ির হালকা কাজ করা যাবে। গর্ভাবস্থায় শেষের দিকে অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমযুক্ত কাজ ফিটাস বা ভ্রন কে খারাপভাবে প্রভাবিত করতে পারে। 

ধূমপান বা মদ্যপান 

ধূমপান বা মদ্যপান অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে। এগুলো গর্ভপাত, ছোট বাচ্চা, আই ইউজিআর এবং ক্ষতি করতে পারে, গর্ভাবস্থায় অধূমপায়ী মায়েদের তুলনায়, যেসব মহিলারা ধুমপান করেছিলেন তাদের বাচ্চার জন্মমৃত্যুর হার ১০ থেকে ৪০% বেশি ।

দাঁতের যত্ন 

দিনে দুবার ব্রাশ করতে হবে এবং রাতে ঘুমানোর আগে মিষ্টি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। 

যৌনমিলন 

১ম ট্রাইমেস্টারে এবং গর্ভাবস্থার শেষ ৬ সপ্তাহ পুরোপুরিভাবে যৌন-মিলন থেকে বিরত থাকতে হবে। যদি বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে বা নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই সন্তান জন্মদানের ঝুঁকি থাকে তাকলে শারীরিক ভাবে মিলিত না হওয়াই শ্রেয়।  

ভ্রমণ

এই অবস্থায় লম্বা সময় ধরে কিংবা অতিরিক্ত চাপযুক্ত ভ্রমণ এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়। ১ম এবং ৩য় ট্রাইমেস্টারে, ঝাঁকুনি দেয় এমন যানবাহন এড়িয়ে চলা ভাল। 

পোশাক পরিধান 

গর্ভাবস্থায় খুব সাধারণ ও ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করা উচিত। আঁটসাঁট বা চাপা কাপড় পরিধান থেকে বিরত থাকতে হবে। উঁচু জুতা পড়া থেকে বিরত থাকতে হবে।  

ওষুধ 

প্রয়োজন না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কোন ধরনের ওষুধ খাওয়া উচিত নয়।

টিটেনাস টক্সয়েড টিকা

  • গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে টিটি টিকা নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।কারণ এই টিকা নবজাতক কে ধনুষ্টঙ্কার এর হাত থেকে সুরক্ষা প্রদান করবে। 

  • যদি কারোর পূর্বে টি টি টিকা দেয়া না থাকে তবে অবশ্যই গর্ভাবস্থায় দুই ডোজ টিকা দিতে হবে,এবং প্রথম ডোজটি প্রথম ট্রাইমেস্টার এর পরপর এবং তার ঠিক এক মাস পর দ্বিতীয় ডোজটি দিতে হবে। অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, দ্বিতীয় ডোজটি যেন ইডিডি এর একমাস পূর্বেই দেয়া হয়। কারোর পূর্বেই টিটি টিকা দেয়া থাকলে, গর্ভাবস্থায় তার একটি বুস্টার ডোজ ই যথেষ্ট।

রেডিয়েশন 

গর্ভাবস্থায় ভ্রূণ রেডিয়েশনের সংস্পর্শে আসলে ভ্রূণের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। 

  • রেডিয়েশনের প্রধান উৎস হচ্ছে গর্ভাবস্থায় এক্স-রে করানো। 

  • মাইক্রোসেফালির মতো জন্মগত ত্রুটি এই ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। 

  • একটি গবেষণায় এই ব্যাপারটি স্পষ্ট যে, যে সমস্ত শিশুরা ইন্ট্রাইউটেরিন এক্স রে রশ্মির সংস্পর্শে আসে তাদের ক্ষেত্রে লিউকেমিয়া এবং অন্যান্য নিউপ্লাজম রোগ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্বাবনাও তত বেশি।   

  • যদিও নির্দিষ্ট নির্দেশনা অনুযায়ী গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে এক্স-রে করানো যেতে পারে, তবে এক্ষেত্রে এক্স-রে ডোজ যতটা সম্ভব কমিয়ে নিতে হবে।

ইনভেস্টিগেশন 

গর্ভকালীন সময়ে একজন ডাক্তার সাধারণত একজন মাকে নিচের পরীক্ষা নিরীক্ষা গুলি দিয়ে থাকেন- 

  • ব্লাড গ্রূপ এবং আর-এইচ টাইপ 

  • এইচ বি%

  • আর বি এস

  • এইচ বি এস এ জি

  • ভিডিআরএল

  • ইউরিন আর/ই

  • ইউ এস জি প্রেগন্যান্সি প্রোফাইল

  • ফেটাল এনোমালি টেস্ট (১৮ থেকে ২২ সপ্তাহের মধ্যে)

জেনেটিক স্ক্রিনিং (১ম ট্রাইমেস্টার শেষ হওয়ার সময়)

যদি বাবা কিংবা মা কারো ক্ষেত্রে নিজেদের অথবা পারিবারিক ক্ষেত্রে জেনেটিক্যালি কোন সমস্যা অথবা জন্মগত ত্রুটির কোন রেকর্ড থাকলে তথাপি বাচ্চা জন্মদানের সময় মা-র জীবন নাশের হুমকি থাকা সত্ত্বেও তিনি যদি সন্তান জন্ম দিতে আগ্রহী হন তাহলে চিকিৎসক কিছু পরামর্শ দিয়ে থাকেন।সেগুলো হল 

  • এমিনোসেন্টেসিস

  • কোরিওনিক ভিলিয়াস স্যাম্পলিং(সিভিএস)

সতর্ক-সঙ্কেত 

নিম্নলিখিত সমস্যাগুলো দেখা দিলে গর্ভবতী মহিলাকে অবশ্যই অতি দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। 

  • পায়ের তালু ফুলে গেলে

  • খিঁচুনি 

  • প্রচন্ড মাথাব্যথা

  • চোখে ঝাপসা দেখা 

  • যোনি থেকে ক্রমাগত রক্তক্ষরন হওয়া সহ অন্য যেকোন অস্বাভাবিক লক্ষণ 

রোগীকে এই ব্যাপারেও নির্দেশনা দেয়া থাকে যে, যদি ভ্রূণের স্বাভাবিক নড়াচড়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় কিংবা তুলনামূলকভাবে কম হয়, ঘুমানোর ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরী হলে, বমি অথবা মূত্রনালীতে সমস্যা তৈরী হলে, মূত্র তুলনামূলক কম মাত্রায় ক্ষরিত হলে, ১২ ঘন্টার বেশি প্রসব ব্যাথা অনুভব হওয়া সহ যেকোন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে গর্ভবতী মহিলাকে অবশ্যই অতি দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। 

গর্ভকালীন এবং প্রসাবকালীন সময়ে যে কোনো জটিলতা দেখা দিলে দেরি না করে গর্ভবতী মাকে জরুরি সেবার জন্য মাকে দ্রুত হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।

Default user image

ত্রপা চক্রবর্তী, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি ত্রপা চক্রবর্তী, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ফার্মেসী তে স্নাতক সম্পন্ন করে, এখন একটি ফার্মাসিউটিক্যালসে প্রোডাকশন ফার্মাসিস্ট হিসেবে চাকরি করছি। ফার্মাসিস্ট হিসেবে মানুষের সুস্বাস্থ্যে অবদান রাখতেই আস্থা লাইফের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছি।

Related Articles