কিশোরীর প্রথম পিরিয়ড স্বাস্থ্যসম্মত হতে যা করণীয়

পিরিয়ড কী, প্রথম পিরিয়ড হওয়ার বয়স, কিছু শারীরিক পরিবর্তন, প্রথম পিরিয়ডে সতর্কতা, হাইজিন নিয়ন্ত্রণ এবং মুডসুইং প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত থাকছে আজকের প্রবন্ধে।

 

বাবা-মার একমাত্র মেয়ে উর্মি (ছদ্মনাম)। বয়স মাত্র ১২ বছর, সবে ক্লাস সিক্সে উঠলো। ধীরে ধীরে উর্মির ভিতর বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনগুলো দেখা দিতে শুরু করেছে। আর তাইতো উর্মির সাথে ওর মা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় মানে মাসিক কি, কেন হয়, তা কিভাবে মোকাবেলা করতে হয় তা শেয়ার করলো। এতে উর্মি ঋতুস্রাব সম্পর্কে আগাম ধারণা পেলো এবং তার মনের দ্বিধা, সংশয়, ভয়ও কেটে গেলো।  

আসলে একজন কিশোরীকে নারী বানিয়ে দেওয়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে পিরিয়ড। তাই মেয়েদের প্রথম মাসিক সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই প্রবন্ধটি সম্পূর্ণ পড়ুন।

 

পিরিয়ড কী  

সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরীদের মধ্যে বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। সেক্ষেত্রে মেয়েদের ১২ বছর কিংবা তার কম-বেশি সময়ে মাসিক শুরু হয়। মূলত একজন মেয়ের নারী হয়ে উঠার প্রথম ধাপই হল পিরিয়ড। এই সময়ে প্রত্যেক মাসের নির্দিষ্ট সময়ে মেয়েদের যৌনাঙ্গ থেকে অল্প অল্প করে রক্ত নির্গত হয়। মূলত এই ঋতুচক্র বা পিরিয়ড সাধারণত ২৮ দিন পরপর হয়। এই ক্ষেত্রে মাসিক ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। আর প্রথম ২ দিন রক্তপ্রবাহ একটু বেশি হয়ে থাকে।  এই মাসিকের সময় অনেক বেশি হাইজিন মেনে চলতে হয়। কেননা এই সময় অপরিষ্কার থাকলে ইনফেকশনের পাশাপাশি বিভিন্ন রোগও হতে পারে। এমনকি অসচেতনার কারণে বিভিন্ন রোগ হয়ে, তা মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দিতে পারে।

 

প্রথম পিরিয়ড হওয়ার বয়স

ঋতুস্রাব হওয়ার কোন নির্দিষ্ট বয়সসীমা নেই। আমাদের দেশের মেয়েদের সাধারণত ১২ বছর বয়সে মাসিক হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে কোন কোন মেয়ের ক্ষেত্রে ৮ বছরে যেমন পিরিয়ড হতে পারে, তেমনি ১৪ বা ১৫ বছরেও তা হতে পারে।  এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের আবহাওয়া, জলবায়ু, বয়সন্ধিকালের পরিবর্তন, বয়সসীমা ইত্যাদির কারণেও ঋতুস্রাব হওয়ার তারতম্য হতে পারে।  

 

আপনার মেয়েকে প্রথম পিরিয়ডের জন্য যেভাবে প্রস্তুত করবেন

 

প্রথম  পিরিয়ড হওয়ার আগে মেয়েদের কিছু শারীরিক পরিবর্তন 

মাসিক একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া। সাধারণত প্রথম পিরিয়ড হওয়ার ৬-১২ মাস আগে মেয়েদের কিছু শারীরিক পরিবর্তন দেখা দেয়, আর তা হল- 

  • দেহের নানা জায়গায় লোম দেখা দেয়। 

  • স্তন অনেকটা দৃশ্যমান হতে আরম্ভ  করে।

  • যৌনাঙ্গ দিয়ে অল্প অল্প তরল নির্গমন হতে থাকে। 

 

প্রথম পিরিয়ডে সতর্ক না হলে যে সমস্যা হতে পারে?

সাধারণত কোন মেয়ের মাসিকের শুরুটা যদি ভয়, আতংক, অস্বস্তির হয়, তবে তার রেশ তাকে অনেক দিন ধরেই বহন করতে হয়। সেক্ষেত্রে প্রথম পিরিয়ড যদি অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আসে এবং  এই বিষয়ে কোন ধারণাই না থাকে, তবে এটার ফল ভালো নাও হতে পারে।

মূলত ঋতুস্রাবে অনেকটা শারীরিক এবং মানসিক প্রভাব থেকে থাকে, তাই, যদি প্রথম পিরিয়ডে সতর্কতা এবং সচেতনতা না থাকে, তবে তা আজীবনের সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তখন এই ক্ষেত্রে কিশোরীরা যেসব সমস্যা ফেস করে- 

  • পিরিয়ড সম্পর্কে অযথা ভীতি জন্মে।

  • মাসিকের সময়ে অনেক বেশি অস্বস্তি কাজ করে।

  • পিরিয়ড নিয়ে আতংকিত হয়ে পড়ে।

  • ঋতুস্রাবের সময়কার হাইজিন ঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

  • অতিরিক্ত লজ্জা কাজ করে।

  • মাসিককে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না।

  • মানসিক  স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব পড়ে। 

  •  অযথা উদ্বেগ এবং দুশ্চিন্তা দেখা দেয়।

  • শারীরিক এবং মানসিক ভাবে অস্থিরতা কাজ করে। 

  • বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আর এই বিব্রতকর পরিস্থিতি দিয়ে শুরু হওয়া প্রথম মাসিকের বিরূপ রেশ সারাজীবন থাকে।  

 

পিরিয়ডের সময়কার হাইজিন কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় 

একটি সমীক্ষায় জানা গেছে যে, মাসিক শুরু হওয়ার আগে, আমাদের দেশের ৭১% মেয়েই এই বিষয়ে জানেনা। আর তাইতো এতে  হাইজিনের  বিষয়টিও উপেক্ষিত থেকে যায়।  আরেকটি ব্যাপার হল- আমাদের সমাজে এখনো ঋতুস্রাবকে একটি ট্যাবু হিসেবে ধরা হয়। তবুও সময়ের সাথে সাথে এখন অনেকবেশি পরিবর্তন এসেছে।  আগেকার দিনে মহিলারা পিরিয়ডের সময় পুরনো কাপড় ব্যবহার করতো, কিন্তু এতে পুরোপুরি হাইজিন মেইন্টেইন হতো না। আর যার কারণে তখন তারা নানা অসুখ- বিসুখে আক্রান্ত হতো। তবে বর্তমানে নারীরা তাদের ঋতুস্রাব চলার সময়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন, মেনস্ট্রুয়াল কাপ কিংবা ট্যাম্পন ব্যবহার করে চলে। পিরিয়ডের সময় স্বাস্থ্যসুরক্ষার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে-

  • পরিষ্কার ও আরামদায়ক পোশাক পরতে হবে। 

  • পিরিয়ডের সময় স্যানিটারি প্যাড কিংবা মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করতে হবে। 

  • মেনস্ট্রুয়াল কাপের ব্যবহার এবং এর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে।

  •  স্যানিটারি প্যাড ৪ থেকে ৬  ঘণ্টা পরপর পরিবর্তন করতে হবে।

  • সবসময় যোনির চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে যোনিপথের আশপাশের অঞ্চল শুকনো রাখার চেষ্টা করতে হবে। 

  • নরম সুতির আন্ডারগার্মেন্টস ব্যবহার করতে হবে এবং তা পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে কড়া রোদে শুকাতে হবে। 

  • এই সময় কাপড়, তুলা বা টিস্যু ব্যবহার করা যাবে না। 

  •  একসঙ্গে দুটি স্যানিটারি প্যাড পরিধান করা যাবে না।

  • সবসময় পরিষ্কার অন্তর্বাস ব্যবহার করতে হবে। 

  • ঋতুস্রাব চলাকালীন সময়ে র‍্যাশ এড়াতে যথাসময়ে প্যাড পরিবর্তন করতে হবে। 

  • এই সময় ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন এড়াতে নিয়মিত গোসল করতে হবে। 

  • যোনিপথের আশপাশে কোন ধরণের সুগন্ধী বা পাউডার ব্যবহার করা যাবে না। 

  • মাসিক চলাকালীন সময়ে মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা পরিহার  করে চলতে হবে। 

  • ঋতুস্রাব চলাকালীন সময়ে জরায়ুতে সংক্রমণ হওয়া এড়াতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন  থাকতে হবে। 

  • মাসিক চলাকালীন সময়ে বাইরের খাবার না খেয়ে বরং পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।

  • ঋতুস্রাব  চলাকালীন সময়ে  প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে।  

 

পিরিয়ডের সময়কার মুডসুইং  প্রতিরোধে করণীয়

মাসিক চলাকালীন সময়ে নারীদের অনেক বেশি মুডসুইং হয়। অনেকে এই সময় বিষণ্ণ থাকেন কিংবা হতাশায় ভোগেন। সেক্ষেত্রে কিছু বিষয় মেনে চললে এই অবস্থা থেকে বের হওয়া যায়, যেমন- 

  • একটু বেশি বিশ্রাম নিতে অথবা ঘুমাতে পারেন। 

  • আপনার পছন্দের খাবার খেতে পারেন।

  •  খারাপ লাগলে বাইরে কোথাও ঘুরে আসতে পারেন।

  • বন্ধু-বান্ধবিদের সাথে গল্প করতে পারেন।

  • এখন যেসব সমস্যা ফেস করছেন, তা নিয়ে আপনার  মায়ের সাথে কথা বলতে বা আলোচনা করতে পারেন। 

  • এই সময় ডায়েরিতে আপনার অনুভূতি লিখতে পারেন। 

  • বই পড়ার অভ্যাস করতে পারেন।

 

স্বাস্থ্যসম্মত পিরিয়ড: ইউনিসেফের পরামর্শ

সাধারণত পিরিয়ড চলাকালীন সময়ের করণীয় সম্পর্কে ইউনিসেফ থেকে জানানো হয়েছে যে- ভবিষ্যতের মানবসম্পদ হিসেবে কিশোরীদের ঋতুস্রাব তথা প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে মাসিক কালীন সময়ের করণীয় সম্পর্কে যেসব পরামর্শ দেয়া হয়েছে, তা হল-

  • ঋতুস্রাবের সময়ে প্রয়োজন পড়লে বাবা-মা কিংবা পরিবারের অন্য নারী সদস্যদের সাথে কথা বলা। 

  • স্যানিটারি ন্যাপকিন  ব্যবহার করা এবং অভিজ্ঞদের কাছে এর ব্যবহার বিধি জেনে নেওয়া।

  • পিরিয়ডের সময় ব্যবহৃত পোশাক নোংরা পানিতে না ধুয়ে বরং সাবান ও পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালো করে ধোয়া।

  • মাসিকের কাপড় অন্ধকার ও স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় শুকাতে না দিয়ে বরং পরিষ্কার জায়গায় রোদে শুকানো এবং  নিরাপদ জায়গায় সংরক্ষণ করা। 

  • এই সময় পুষ্টিকর খাবার বিশেষ করে মাছ, মাংস, ডিম,  দুধ, বাদাম, শাকসবজি ও ফলমূল ইত্যাদি বেশি করে খাওয়া।

  • পিরিয়ডকালীন সময়ের তলপেটের ব্যথা উপশমে বোতলে গরম পানি নিয়ে সেঁক দিলে অনেকটা আরাম পাওয়া যাবে। 

  • মাসিকের  সময় অতিরিক্ত ব্যথা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। 

  • এইসময়  বিশ্রামে থাকতে হবে, তবে স্কুলে যাওয়া বা ঘরের কাজ করা অব্যাহত রাখতে হবে। 

  • ঋতুস্রাবের সময় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কিছু হালকা ব্যায়াম করলে শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকবে।  

 

শেষকথা 

সাধারণত প্রথম মাসিক সম্পূর্ণ স্বাভাবিক একটি বিষয়। এই প্রাকৃতিক ঘটনাটিকে লজ্জা পাওয়ার কিংবা গোপন করার কিছু নেই। সব মেয়েদের নারীত্বের এই প্রতীক মানে পিরিয়ডকে সহজ ভাবে গ্রহণ করে এবং  সচেতন হয়ে সামনের পথে এগিয়ে যেতে হবে।   
 

আরও পড়ুনঃ

 

Default user image

সাবরিনা দিলশাদ এলিন, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি একজন কন্টেন্ট রাইটার! আমি বই পড়তে, গল্প করতে এবং ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করি। মূলত লেখালিখি আমার প্যাশন এবং তা এখন আমার পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে! আশা করি আস্থা লাইফের সাথে আমার এই লেখালিখির জার্নিটা অনেক দূর এগিয়ে যাবে!

Related Articles