রমজানে রোগীদের যেভাবে ঔষুধ খেতে হবে

বছরের অন্যান্য সময়ে রোগীরা সাধারণত হিসেব করে তিন বেলা ঔষুধ সেবন করে থাকলেও রমজানে ব্যাপারটা ভিন্ন। এই সময়টাতে রোজাদার রোগীরা অনেক বেশি দ্বিধায় থাকেন! তাদের মনে অসংখ্য প্রশ্ন থাকে - কখন ঔষুধ খাবেন, ইনসুলিন নিলে রোজা ভাঙ্গবে কিনা, ইফতারের আগে ইনহেলার নেওয়া যাবে কিনা ইত্যাদি। আর আজকে আমরা সেসব প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করব।

রমজান মাসে অসুস্থ রোজাদার ব্যক্তিরা চিকিৎসা ও ঔষুধ ব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন। এই সময়ে বেশীরভাগ রোগীদের কি করা যাবে আরা কি করা যাবে না তা নিয়ে জ্ঞান ও সচেতনার কমতি থাকে। আবার অনেক চিকিৎসক এবং ইসলামিক স্কলারদের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি ও সংশয় লক্ষ করা যায়।

এই বিভ্রান্তিগুলি দূর করার জন্য উত্তর আফ্রিকার দেশ মরক্কোতে ১৯৯৭ সালের জুন মাসে নবম ফিক্বহ-চিকিৎসা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জেদ্দা ইসলামিক ফিকহ অ্যাকাডেমি, আল আজহার ইউনিভার্সিটি, ইসলামিক এডুকেশনাল, সায়েন্টিফিক এন্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন (আইএসইএসসিও) এর শীর্ষ প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। 

সম্মেলনটির মূল আলোচ্য বিষয় ছিল রোজা রেখেও কোন চিকিৎসাগুলি করা যাবে আর কোনগুলি করা যাবে না, কোন টেস্টগুলি করা যাবে বা যাবে না এবং কোন ঔষুধ সেবনের পরেও রোজার কোন ক্ষতি হবে না সে বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা তৈরি করা। 

আসুন সেই  দিকনির্দেশনা অনুসারে রমজান মাসে ঔষুধ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর গুলি জেনে নেই-

১) রোজা রেখে কোন ঔষুধগুলি গ্রহণ করা যাবে?

নিম্নোক্ত ঔষুধগুলি অথবা ঔষুধ গ্রহণের মাধ্যমগুলির দ্বারা ঔষুধ নেওয়া যাবে-

১) চোখ এবং কানের ড্রপ। 

২) যে সব উপাদান চামড়ার মাধ্যমে গ্রহন হয় যেমন- ক্রীম, মলম, সেলাই বা ঔষধ লাগানো কোনো প্লাস্টার।

৩)খাবার সরবরাহ হয় এমন কিছু শিরা দিয়ে গ্রহন (ইন্ট্রাভেনাস) ব্যতীত চামড়া, শিরা, মাংশ পেশী বা হাড়ের জোড়ায় যেকোনো ইনজেকশন।

৪) অক্সিজেন বা অচেতন করা গ্যাস।

৫) কন্ঠনালীর প্রদাহ নিবারনের জন্য জিহ্বার নিচে ব্যবহার করা নাইট্রোগ্লিসারিন ট্যাবলেট।

৬) মাউথ ওয়াস ব্যবহার, গরগরা করা বা মুখে কোনো কিছু স্প্রে করা সবই করা যাবে যদি পেটে কোনো কিছু না যায়।

৭) নাকের ড্রপ বা নাকের স্প্রে।

৮) ইনহেলার। 

২) কিভাবে আমি ব্লাড প্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপের ঔষুধগুলি ব্যবহার করতে পারি? (এনটিহাইপারটেন্সিভ ড্রাগ)

১) সবচেয়ে ভালো হয় ইফতারের সময় অথবা সেহেরীতে নিতে পারেন।

২) মূত্রবর্ধক ঔষধ ইফতারের সাথে বা দুই ঘন্টা পরে ব্যবহার করা উত্তম।

৩) বিটা ব্লকার ঔষধ যেমন- মে্টোপ্রোলল, কার্ভিডিলল বা বাইসোপ্রোলল ইত্যাদি খালি পেটে বা ইফতারের সময় গ্রহন করা। 

৪) ক্যালসিয়াম ব্লকার যেমন - অ্যামলোডিপিন, নিফিডিপিন ব্যবহার করলে ঐ সব ভেষজ এড়িয়ে চলুন যা রক্তচাপ বাড়ায় যেমন- আদা, জিনসেং এবং যেসব ভেষজ রক্তচাপ কমায় যেমন- রসুন।

৩) আমি কিভাবে আমার অ্যাজমার (শ্বাস কষ্ট) ঔষুধ নিতে পারি?

১) যেসব রোগীরা রিলিভার স্প্রে (শ্বাসকষ্ট থেকে দ্রুত উপশম করে) ব্যবহার করে তারা বেশি প্রয়োজন হলে যেকোন সময় ব্যবহার করতে পারবে, রোজা রেখে দিনের বেলাতেও ।

২) যদি রোগ নিরাময়ের জন্য ইনহেলার ব্যবহার করে তবে তা ব্যবহার করতে হবে ইফতার বা সেহেরীতে।

৪) রমজানে কখন উচ্চ কোলেস্টরেল (হাইপারলিপিডেমিয়া) এর ঔষুধ নেওয়া উচিত?

১) হাইপারলিপিডেমিয়ার ঔষুধ দিনে একবার দেওয়া হয়। সুবিধা মত ইফতার বা ঘুমানোর সময় নেওয়া যেতে পারে।

২। স্ট্যাটিন টাইপের ঔষধ যেমন - অ্যাটো্রভাস্ট্যাটিন ব্যবহার করলে আঙ্গুর ফলের রস পরিহার করতে হবে।

৫) কিভাবে আমি রমজানে থাইরয়েড এর ঔষুধ (লিভোথাইরক্সিন) ব্যবহার করব?

১) লিভোথাইরক্সিন একধরনের থাইরয়েড হরমোন ট্যাবলেট যা হাইপো থাইরয়েডে আক্রান্ত রোগীদের থেরাপির পরিবর্তে দেওয়া হয়। এটি সাধারনত দিনে একবার ব্যবহার করার জন্য দেওয়া হয় যা ইফতারির পূর্বে ব্যবহার করতে হয়।  

৬) রমজানে কখন আমার অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট বা রক্ত জমাট বাধার ঔষধ খাওয়া উচিত? 

১) অধিকাংশ রক্ত জমা বাধার ঔষধ দিনে একবার বা দুই বার খেতে বলা হয় যা আপনি ইফতার ও সেহেরীতে খেতে পারেন।

৭) আমি কি রমজানে রক্ত জমাট বাধার ঔষধের ডোজ কমাতে পারি? 

১) এই ঔষধ ডাক্তার যতটুকু খেতে বলেন ততটুকু খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি ঔষধের ডোজ বা পরিমান বেশি হয় তবে অপ্রয়োজনীয় রক্তপাত বাড়তে পারে আর অল্প ব্যবহারে রক্ত জমাট বাধতে পারে।

৮) কিভাবে আমি রমজানে আমার মৃগীরোগের ( খিচুনী) ঔষধ খেতে পারি?  

১) মৃগীরোগে আক্রান্ত রোগীর উচিৎ রোজা শুরুর আগেই তার ডাক্তারের সাথে কাউনসিলিং করে তার ঔষধ খাওয়ার সময় নির্ধারন করে নেওয়া। মৃগী রোগের ঔষধ সাধারনত দিনে একবার বা দুই বার খাওয়ার জন্য দেওয়া হয় যাতে করে এর প্রভাব দীর্ঘ সময় থাকে। এটি তারা ইফতার বা সেহেরীতে খেতে পারে। যদি কোনো রোগীর রোজা রাখার কারনে খিচুনি ওঠে বা মৃগী রোগে আক্রান্ত হয় তবে তার দ্রুতই রোজা ভেঙে ফেলে উচিত।  

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ 

১) নিজে নিজে ঔষধের ডোজ পরিবর্তনের পরিবর্তে আপনার উচিৎ আপনার ডাক্তার এর সাথে  আলোচনা করা।

২) নিজে নিজে ঔষধের ডোজ পরিবর্তন করলে এর প্রভাব কতটূকু হবে তা নির্ভর করে আপনার ঔষধ কেমন কাজ করে তার উপর এবং এটি ঔষধের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করে।

৩) উপরোক্ত বিষয় গুলিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দয়া করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

Default user image

খন্দকার মোঃ শওকত হোসেন, লেখক, আস্থা লাইফ

বরিশাল এর নিভৃত ও মনোরম একটি গ্রামে জন্ম। সাহিত্য অনুরাগী মা-বাবার কাছেই লেখালেখির হাতেখড়ি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করলেও লেখালেখির দিকেই ঝোঁকটা বেশি। তাই অবসরে লেখালেখির চেষ্টা করি। লেখনীর মাধ্যমে যদি কারো উপকার করা যায় কিংবা কোন পরিবর্তনের সূচনা করা যায়, তাহলে তৃপ্তিটা আসে মন থেকে। এই উদ্দেশেই আস্থা লাইফ পরিবারে যোগ দেয়া। আমার লেখার মাধ্যমে কারো মধ্যে কিঞ্চিৎ সচেনতাও যদি সৃষ্টি করতে পারি, সেইটাই হবে পরম পাওয়া।

Related Articles