প্রেসক্রিপশন ছাড়া গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ আর নয়

চিকিৎসকের পরামর্শ বা প্রেসক্রিপশন ছাড়াই যখন তখন গ্যাস্ট্রিকের ঔষুধ সেবনে নিজের অজান্তেই শরীরের সর্বনাশ ডেকে আনছেন। হাড় ক্ষয় থেকে শুরু করে ক্যান্সার পর্যন্ত ঘটে যেতে পারে এ ধরনের অনিয়ন্ত্রিত ঔষুধ সেবনে।

আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষ গ্যাস্ট্রিক এর সমস্যায় ভুগে থাকেন। তবে এটি তেমন কোন বড় সমস্যা নয়, কারণ আমাদের দেশে ঘরে ঘরে ডাক্তার! কোন অসুখের কোন ঔষধ খেলে ভালো হয় প্রতি বাসায় অন্তত একজন হলেও জানেন! যদিও রসিকতা করছি, ব্যাপারটা মোটেও রসিকতা করার মত নয়! বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর গড়ে ২ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ ভুল ঔষধ সেবনের কারণে মারা যান। বলে রাখছি এমন কোন গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ নেই যাতে কোন পার্শপ্রতিক্রিয়া নেই। তবে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় কি করবেন? জানতে হলে পড়তে থাকুন।

গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ খাওয়া আমাদের সমাজে এতই স্বাভাবিক, যে কেউ কেউ আছেন একটু ভারী খাবার খেতে হলে খাবার আগে প্রথমে গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ খোঁজেন। খাদ্যে ভেজাল, পরিবেশ দূষণ ও আমাদের জীবন ধারণ পদ্ধতি অস্বাভাবিকতার কারণে বিশ্বজুড়েই মানুষের গ্যাস্ট্রিক এর সমস্য বেড়েছে প্রকট ভাবে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ সেবন। 

প্রতিটি ঔষধ সেবনেরই কিছু নিয়ম থাকে। পূর্বে কি কি সমস্যা থাকলে ঔষধটি সেবন করা যাবে না, কখন, কিভাবে খেতে হবে, অন্য কোন ঔষধের সাথে সেবন করা উচিৎ নয় ইত্যাদি নিয়ম মেনে ও রোগীকে বুঝিয়েই একজন ডাক্তার ঔষধ প্রেসক্রাইব করেন। একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারা কখনোই সম্ভব নয়। যদিও বেশিরভাগ মানুষের ধারণা, গ্যাস্ট্রিকের ঔষধের কোন পার্শপ্রতিক্রিয়া নেই!

মাঝে মাঝে খেয়াল করবেন, অনেক অসুস্থ হয়ে ডাক্তারের কাছে গেছেন, কিন্তু ডাক্তার তেমন বেশি ঔষধ দেন নি, কিছু করনীয় বলে ছেড়ে দিয়েছেন। এটার কারণ হলো, খুব বেশি প্রয়োজন না হওয়া পর্যন্ত ঔষধ গ্রহণ করা উচিৎ নয়। বিশ্বজুড়ে ঔষধ শিল্পের মধ্যে গ্যাস্টিকের ঔষধের রয়েছে বিশাল বড়ো একটি বানিজ্য। মূলত গ্যাস্টিকের ঔষধগুলো ছোটখাটো রোগ সমূহের স্থায়ি সমাধান নয়। বরং, আপনার রোগ স্থায়ী ভাবে না সারলেই তাদের লাভ। কারণ তাহলেই আপনি বারবার ঔষধ কিনবেন। তাই ঔষধ নয় সঠিক খাদ্যাভাস ও সুশৃঙ্খল জীবনআচরণই সুস্থ্য থাকার স্থায়ি উপায়।

পাকস্থলির এসিড উপকারি নাকি অপকারি?

গ্যাস্টিকের ঔষধ মূলত পাকস্থলির অ্যাসিড নিঃসরণ কমিয়ে দেয়। এতে পাকস্থলির এসিডিটি কমে যায়। উল্লেখ্য আমাদের খাবার হজমে পাকস্থলীর স্বাভাবিক অম্লতা প্রয়োজন এবং এটির ব্যাঘাত ঘটলে শরীরবৃত্তিয় কাজে ব্যাঘাত ঘটে। যার ফলে,

  • ক্যালশিয়াম শোষণ বাধাগ্রস্থ হয়

  • জীবানু সংক্রমনের ঝুঁকি বাড়ে

  • রক্ত উৎপাদন কমে যায়

  • হাড় নরম ও ভঙ্গুর হয়ে যায়

  • কিডনীর কার্যকারীতা হ্রাস পায়

অতএব বুঝতেই পারছেন, গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ সাধারণ জীবনের অংশ নয়। বরং, খুব বেশি সমস্যা হলে ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক সঠিক ঔষধ নির্দিষ্ট সময় ধরে সেবন করতে হবে। মনে রাখবেন, গ্যাস্ট্রিক প্রাথমিক অবস্থায় মারাত্মক কোন রোগ নয়, কিন্তু গ্যাস্ট্রিকের ঔষধের ভুল প্রয়োগ হতে পারে মারাত্বক। 

তবে গ্যাস্ট্রিক থেকে কিভাবে নিস্তার পাবেন? গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ-ই কি একমাত্র সমাধান? উত্তরগুলো জানার আগে চলুন কিছু প্রচলিত গ্যাস্ট্রিকের ঔষধের ঝুঁকি ও পার্শপ্রতিক্রিয়া জেনে নেওয়া যাক। 

*** জেনে রাখুন - “বিভিন্ন নামে ঔষধ হতে পারে, তবে ঔষধের কার্যকরী উপাদান ছোট করে নামের নিচে লেখা থাকবে, সেটা থেকেই মূল ঔষধ চিনতে পারবেন।”

Aluminum Hydroxide (অ্যালুমিনিয়াম হাইড্রোক্সাইড)

এটি সাধারণত এন্টাসিড হিসেবে ব্যাবহার হয়। এই ঔষধের যথেচ্ছা ব্যবহারের ফলে,

  • বমি বমি ভাব

  • বমি হওয়া

  • রক্তের ফসফেটের পরিমান কমে যাওয়া

  • কোষ্ঠকাঠিন্য

  • রুচিহীনতা 

  • বিষন্নতার মত জটিলতা দেখা দেখা যায়।

দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব যেমন, বিভ্রান্তি, অতিরিক্ত ঘুম, পেটে ব্যাথার মত সমস্যা হতে পারে। ২৬ টি ঔষুধের সাথে এটি মারাত্মক জটিলতা তৈরি করতে পারে। এজন্য ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত ঔষধ সেবন উচিৎ নয়! 

Magnesium Hydroxide (ম্যাগনেসিয়াম হাইড্রোক্সাইড)

এটিও একটি এন্টাসিড জাতীয় ঔষধ। এই ঔষধটি গ্রহণেরও নির্দিষ্ট বিধিমালা রয়েছে। এই ঔষধটি নিয়ম মেনে গ্রহণ না করলে-

  • বমি বমি ভাব।

  • বমি।

  • ডায়রিয়া।

  • রুচিহীনতা হতে পারে।

অতিরিক্ত সেবনে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া ও শ্বাসকষ্টের মত জটিলতা তৈরি হতে পারে।

Calcium Carbonate (ক্যালসিয়াম কার্বনেট)

এটি একটি খুব জনপ্রিয় এন্টাসিড জাতীয় ঔষধ। এটির পার্শপ্রতিক্রিয়া নিন্মরূপ:

  • এলার্জি

  • শ্বাসকষ্ট

  • ঠোঁট, মুখ শুকিয়ে যাওয়া

  • প্রস্রাব কমে যাওয়া

  • দ্রুত ওজন বেড়ে যাওয়া ও

  • রক্তে ক্যালশিয়ামের মাত্রা বেগে যাওয়া।

Bismuth Subsalicylate (বিসমাথ সাবস্যালিসাইলেট)

এটি ডায়রিয়া পেটে ব্যাথা গ্যাস্ট্রিক বুক জ্বালা নিরাময়ক। এটির যথেচ্ছ ব্যাবহারে-

  • পেটে ব্যাথা

  • দুশ্চিন্তা

  • জিহ্বা কালো হয়ে যাওয়া

  • ঠান্ডা লাগা

  • কোষ্ঠকাঠিন্য

  • বমি বমি ভাব

  • কালো মুত্র সহ আর ৪০ টি পার্শপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

Sodium Bicarbonate (সোডিয়াম কার্বনেট)

এটি ক্ষার উৎপাদী ওও পাকস্থলির এসিডের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রনে ব্যাবহৃত হয়। এটির অতিরিক্ত ব্যবহারে-

  • যাদের হার্টের সমস্যা তাদের হার্ট ফেইলিয়র হতে পারে।

  • হৃদরোগের জন্য ক্ষতিকর।

  • রক্তে সোডিয়াম ও ক্যালশিয়ামের মাত্রা বেড়ে যায়।

  • ফুসফুসে পানি জমা।

  • বিষন্নতা সহ আরও অনেক পর্শপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়

Omeprazole (ওমিপ্রাজল)

এটি একটি অতি জনপ্রিয় গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ যা সঠিক নিয়ম মেনে গ্রহণ না করলে বিপদজ্জনক হতে পারে। সম্ভাব্য (Rare) পার্শপ্রকিক্রিয়া গুলো,

  • পিঠ বা পেটে ব্যাথা

  • প্রস্রাবে রক্ত আসা

  • জ্বর হওয়া 

  • ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া

  • চুলকানি

  • খাবারে স্বাদ না পাওয়া ইত্যাদি।

অতিরিক্ত ব্যাবহারে ঝাপসা দেখা, মাথা ব্যাথা, মুখ শুকিয়ে যাবার মত সমস্যা দেখা দেয়।

Lansoprazole (ল্যানসোপ্রাজল)

এটি একটি গ্যাস্ট্রিক ও এসিডিটি নিরাময়ক ঔষধ। এটির ভুল ব্যাবহারে,

  • মাথা ব্যাথা

  • ডায়রিয়া

  • বমিভাব

  • পেটে ব্যথা কোষ্ঠকাঠিন্য

  • এলার্জির সমস্যা হতে পারে তাছাড়া

দীর্ঘমেয়াদী ব্যাবহারে হাড়ে ব্যাথা ও লিভারে সমস্যা হতে পারে।

Rabeprazole (র‍্যাবিপ্রাজল)

এটি একটি প্রচলিত গ্যাস্ট্রিক এর ঔষধ। এটির যথেচ্ছ ব্যবহারে,

  • পেট ফাঁপা

  • দুর্বলতা

  • পাতলা পায়খানা

  • দ্রুত ওজন বৃদ্ধি বা হ্রাস

  • চামড়া ও চোখ হলুদ হয়ে যাওয়ার মত সমস্যা দেখা যায়।

Esomeprazole (ইসওমিপ্রাজল)

এটি পাকস্থলীর এসিডের আধিক্য নিয়ন্ত্রনে ব্যাবহার হয়। বিভিন্ন বয়সের জন্য এই ঔষধটি বিভিন্ন মাত্রায় প্রয়োগ করতে হয়, তাই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ব্যাতিত এটি সেবন খুব সহজেই একটি ভুল হয়ে দাঁড়াতে পারে। পার্শপ্রতিক্রিয়া গুলো নিন্মরূপ-

  • চামড়া উঠা ও ঝুলে যাওয়া

  • পেট ফোলা।

  • কোষ্ঠকাঠিন্য

  • কালো মুত্র

  • মাথা ঘোরা

  • দ্রুত হৃদস্পন্দন

  • জ্বর

  • এলার্জি

  • শ্বাসকষ্ট সহ ২০ টির ও অধিক পার্শপ্রতিক্রিয়া রেকর্ড হয়েছে।

Pantoprazole (প্যানটোপ্রাজল)

এটিও পাকস্থলীর এসিডের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। এটির পার্শপ্রতিক্রিয়া নিন্মরূপ-

  • মাথা ব্যাথা

  • কোষ্ঠকাঠিন্য

  • ডায়রিয়া

  • পেটে ব্যাথা

  • দ্রুত ওজন বেড়ে ডাওয়া

যারা লিভার ও এলার্জির সমস্যায় ভোগেন ও অন্তসত্মা তারা এই ঔষধ সেবন করতে পারবেন না।

Cimetidine (সিমেটিডিন)

এটি একটি প্রচলিত গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ যা প্রেসক্রিপশন ছাড়া ব্যাবহার উচিৎ নয়। এটির সাধারণ পার্শপ্রতিক্রিয়া গুলো হলো-

  • পুরুষের স্তন বৃদ্ধি পাওয়া।

  • মাথা ঘোরা

  • অনিদ্রা

  • বমি বমি ভাব

  • ডায়রিয়া

১৪৩ টি ঔষধের সাথে এটি গ্রহণ করলে মারাত্বক প্রভাব ফেলতে পারে।

Ranitidine (র‍্যানিটিডিন)

এটি গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা নিরাময়ে ব্যাবহার হয়ে থাকে। এটির পার্শপ্রতিক্রিয়া সমুহ-

  • মাথা ব্যাথা

  • কোষ্ঠকাঠিন্য

  • ডায়রিয়া

  • বমি বমি ভাব

  • পেট ব্যাথা

Famotidine (ফ্যামোটিডিন)

এটি একটি বহুল ব্যবহৃত গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ। পার্শপ্রতিক্রিয়া গুলো লক্ষ করুন-

  • দুশ্চিন্তা

  • মাড়ি থেকে রক্ত পড়া

  • মল, মূত্রে রক্ত আসা

  • কাশি

  • বিষন্নতা

  • শ্বাস প্রশ্বাসে শব্দ হওয়া।

  • অনিদ্রা।

  • শ্বাসকষ্ট।

যে যে কারণে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা সারতে চায় না

গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ খাওয়া সাময়িক সমস্যাটি সমাধান করতে পারে, কিন্তু এটি স্থায়ি সমাধান নয়। 

  • আমাদের জীবন পদ্ধতি ও খাদ্যাভাস মূলত গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার জন্য দায়ি। সুশৃঙ্খল জীবন ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার মূল ঔষধ। 

  • যদি পাকস্থলিতে হেলিকোব্যাকটার পাইলোরি নামক ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ হয়, তবে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা সারতে চায় না। এই রোগটির নির্দিষ্ট চিকিৎসা রয়েছে,  শুধু গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ খেয়ে গেলে চলবে না।

  • পিত্তথলির সমস্যা ও পাকস্থলীর ক্যান্সার এর কারণেও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা সারতে চায় না। ডাক্তারের পরামর্শে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ সনাক্ত করে চিকিৎসা গ্রহণ দীর্ঘ গ্যাস্ট্রিক থেকে মুক্তির সহজ উপায়।

গ্যাস্ট্রিক এর সমস্যায় করনীয় ও বর্জনীয়

  • পর্যাপ্ত ঘুমানো, সঠিক নিয়ম করে ঘুমাতে যাওয়া ও ওঠা।

  • সঠিক সময়ে খাবার গ্রহণ করা।

  • দিনে অন্তত ১ ঘন্টা ব্যায়াম ও শারিরীক পরিশ্রম করা।

  • তৈলাক্ত ও অস্বাস্থ্যকর খাবার বর্জন করা।

  • গ্যাস্টিকের সাথে মানসিক অবস্থার সম্পর্ক রয়েছে, সবসময় প্রফুল্ল ও আনন্দময় থাকার চেষ্টা করা।

  • যে যে খাবারে গ্যাস্ট্রিক বেড়ে যায় সেগুলো সমস্যা সেরে যাওয়া না পর্যন্ত এড়িয়ে যাওয়া।

 

এই সাধারণ নিয়ম গুলো অনুস্বরণ করলে স্বাভাবিক উপায়েই সাধারণ গ্যাস্ট্রিক থেকে মুক্তি পেতে পারেন। আপনার পরিচিত কারো অনুমানে ঔষধ সেবন করার বদ অভ্যাস থাকলে তার সাথে এই প্রবন্ধটি তার সাথে ভাগ করতে পারেন। 

 

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles