ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার যে ৭টি স্বাস্থ্য উপকারিতাগুলি আপনার জানা উচিত!

ইসবগুলের ভুসি যুগ যুগ ধরে চলে আসা কোষ্ঠকাঠিন্য সহ অন্যান্য রোগ প্রতিকারের বিশ্বস্ত নাম। তবে আপনি কি জানেন সঠিক উপায়ে এটি না খেতে পারলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। তাই ইসবগুলের সর্বোত্তম উপকার পেতে এর সঠিক ব্যবহার জেনে নেওয়া যাক।

মিল্ক অফ ম্যাগনেশিয়া নামটার সাথে হয়ত আমরা সবাই পরিচিত। আমি অন্তত আমার ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি যে কারও কোষ্ঠকাঠিন্য হলেই তাকে মিল্ক অফ ম্যাগনেশিয়া খাওয়ানো হয়। বাঙালীর ঘরে ঘরে এই ওষুধ একসময় ঘরোয়া টোটকা হিসেবেই প্রচলিত ছিল। ছোটবেলায় এটুকুই জানতাম যে কোন কারণে পায়খানা শক্ত হয়ে গেলে পেট নরম করার জন্য এই ওষুধ খেতে হয়। একটু বড় হবার পর জানতে পারলাম এই ওষুধের পোশাকি নাম হল ‘ল্যাক্সেটিভ’। আস্তে আস্তে এমন আরও বেশ কিছু ল্যাক্সেটিভ যেমন অ্যাভোল্যাক, অসমোল্যাক্স, মোভিল্যাক্স এগুলোর সাথে আমার পরিচয় ঘটে। বিশেষ করে অপারেশনের রোগী অথবা বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য (ক্রনিক কনস্টিপেশন) দূর করতে এই ল্যাক্সেটিভগুলো ব্যবহার করা হয়।

তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদিত এই ওষুধগুলোই যে একমাত্র ল্যাক্সেটিভ তা কিন্তু নয়। বরং প্রকৃতিতেও বেশ কিছু ল্যাক্সেটিভও রয়েছে যেমন, পাকা কলা, ইসবগুল ইত্যদি। এবং এই ইসবগুল শুধু আমাদের দেশে না, বরং এই গোটা উপমহাদেশেই একটি জনপ্রিয় বস্তু। ছোটবেলায় স্কুলের সামনে দাঁড়ানো শরবতওয়ালা যে গুড়োমতন জিনিসটা না চাইতেও শরবতের মধ্যে দিয়ে দিতো, সেই জিনিসের যে এতো গুণ তা সেই বয়সে বুঝতে না পারলেও এখন ঠিকই বুঝি। 

তবে আমাদের মাঝে একটা অতিপ্রচলিত ধ্যানধারণা হচ্ছে, এই ইসবগুলের ভুসি যত খাওয়া যায় তত শরীরের উপকার। সেজন্য আমরা যখন যেভাবে পারি এই ইসবগুলের ভুষি খেয়েই যাচ্ছি। আবার অনেকেই ইসবগুল সারা রাত ভিজিয়ে রেখে সকালে খালি পেটে খান। কিন্তু এমন অপরিকল্পিত খাওয়ার রয়েছে কিছু ভয়ানক দিক। কারণ ইসবগুল ভিজে ফুলে ওঠার পর খেলে এর কোন উপকার তো পাওয়া যাবেই না, বরং ঘটতে পারে ঠাণ্ডার সংক্রমণ। এবং শুনতে যতই আশ্চর্য শোনাক, সত্যি হল, ইসবগুলের ভুষি নিয়ম মেনে না খেলে শরীরের ক্ষতি হতে পারে। 

 

তাই আসুন জেনে নেই ইসবগুল খাওয়ার সঠিক নিয়ম সম্পর্কে-

১. কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে

কোষ্ঠকাঠিন্য বা কনস্টিপেশন নিরাময়ের জন্য ২ চামচ পরিমাণ ইসবগুলের ভুষি এক গ্লাস কুসুম গরম দুধ বা পানির সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন। এতে থাকা খাদ্যআঁশ পরিপাকতন্ত্রে যেয়ে প্রচুর পরিমাণ পানি শোষণ করে মলের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে দেয় এবং অন্ত্রের দেয়াল পিচ্ছিল করে দেয় যাতে সহজেই মলত্যাগ করা যায়।

২. ডায়রিয়া প্রতিরোধ করতে

শুনতে অবাক লাগছে না? যে একই জিনিস কোষ্ঠকাঠিন্য আর ডায়রিয়া দুটোই সারিয়ে তুলতে পারে কিভাবে! কিন্তু যতই আশ্চর্য লাগুক, এটাই সত্যি। ডায়রিয়া প্রতিরোধের জন্য ৩ চামচ টক দইয়ের সাথে ২ চামচ ইসবগুল মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়। টক দই পাকস্থলির যেকোনো সংক্রমণ সারিয়ে তোলে আর ইসবগুল তরল মলকে শক্ত করে।

৩. হজম প্রক্রিয়া বৃদ্ধি করতে

বদজমের সমস্যায় ইসবগুল এনে দিতে পারে খুব সহজ সমাধান। নিয়মিত ইসবগুল খেলে আপনার পাকস্থলি পরিষ্কার থাকে এবং এর বর্জ্য পদার্থও দ্রুত নিষ্কাসিত হয়ে যায়। তাই খাওয়ার পর মাঠা বা ঘোলের সাথে ২ চামচ ইসবগুল মিশিয়ে খেয়ে ফেলুন।

৪. ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে

খাওয়ার পর ২ চামচ ইসবগুলের ভুষি এক গ্লাস পানির সাথে মিশিয়ে খেয়ে ফেলুন। ইসবগুল পাকস্থলিতে যেয়ে জেলির মতো পদার্থে পরিণত হয় যেটা গ্লুকোজের ভাঙ্গন ও শোষণ এর গতিকে কমিয়ে দেয় যার ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।

৫. অ্যাসিডিটির হাত থেকে মুক্তি পেতে

ইসবগুল পাকস্থলির দেয়ালে একটি প্রতিরক্ষামূলক স্তর তৈরি করে যা অ্যাসিড রিফ্লাক্সের হাত থেকে পাকস্থলিকে রক্ষা করে। এজন্য ২ চামচ ইসবগুল এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি অথবা আধা গ্লাস ঠাণ্ডা দুধে মিশিয়ে খেতে পারেন।

৬. ওজন কমানোর জন্য

ইসবগুলের ভুষি পাকস্থলিতে যাবার পর পানি শোষণ করে ভারী হয়ে যায়। এতে বেশী সময় ধরে আপনার পেট ভরে থাকার অনুভূতি হয় এবং আপনার ক্ষুধা লাগে না। ওজন কমানোর জন্য তাই ২ চামচ ইসবগুল কুসুম গরম পানিতে সামান্য লেবুর রসের সাথে মিশিয়ে খাওয়া উচিৎ।

৭. পাইলস প্রতিরোধ করতে

ইসবগুল মলকে নরম রাখে যার ফলে পায়ুপথে ফাটল এবং পাইলসের মতো সমস্যার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। এজন্য কুসুম গরম পানিতে ২ চামচ ইসবগুলের ভুষি নিয়মিত খেলে উপকার পাওয়া যাবে।

ইসবগুল ব্যবহারের মৌলিক নির্দেশাবলী

  • যদি একজন ডাক্তার আপনাকে ইসবগুল খেতে বলেন, তাহলে ডোজের পরিমাণ এবং ফ্রিকোয়েন্সি সম্পর্কিত তার নির্দেশাবলী অনুসরণ করুন। 

  • আপনি যদি ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই ইসবগুল ব্যবহার করতে চাল তবে লেবেলে দেওয়া নির্দেশাবলী অনুসরণ করুন।

  • সাধারণত, আপনার কোষ্ঠকাঠিন্য কেটে না যাওয়া পর্যন্ত আপনাকে প্রতিদিন তরল/পানি সহ ১ থেকে ২ চামচ ইসবগুল খেতে হবে। সঠিক ডোজ বয়স, চিকিৎসার অবস্থা এবং চিকিৎসার প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে।

  • ইসবগুল দিয়ে চিকিৎসা শুরু করার আগে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়।

  • আপনার যদি কোন উদ্বেগ বা প্রশ্ন থাকে, আপনার ডাক্তার বা সারটিফাইড ফার্মাসিস্টের সাথে কথা বলুন।

ইসবগুল অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণ পানির সাথে খেতে হবে

  • ইসবগুল সবসময় পর্যাপ্ত পরিমাণ (২৪০ মিলি) পানির সাথে মিশিয়ে খেতে হবে। 

  • প্রথমে ইসবগুলের পাউডারকে পানিতে মিশিয়ে ভালোভাবে নাড়তে হবে।  

  • মিশানোর সাথে সাথেই খেতে হবে।

  • ইসবগুলের পাউডার যেন নাক দিয়ে ভিতরে ধুকে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

  • মনে রাখবেন, আপনি যদি ইসবগুল মিশিয়ে সাথে সাথে না পান করে ভিজিয়ে রাখেন তবে তা ফুলে মোটা ও ঘন হয়ে যায়। এতে হিতে বিপরীত হয়ে যায়।

কখন বা কোন অবস্থায় ইসবগুলের ভুষি খাওয়া উচিৎ নয়?

১. ঘুমানোর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে

২. পেটে ব্যাথা বা বমি বমি ভাব থাকলে

৩. ইসবগুল খেয়ে ইতঃপূর্বে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে

৪. বৃহদান্ত্রের মাংসপেশির দুর্বলতা থাকলে

৫. আগে থেকেই পায়ুপথ দিয়ে রক্ত যাবার রেকর্ড থাকলে

সঠিক নিয়ম মেনে খেতে পারলে ইসবগুল শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এবং অন্যান্য ল্যাক্সেটিভ এর তুলনায় এটি অনেক বেশী সাশ্রয়ী। তাই নিয়মিত ইসবগুল খাবার অভ্যাস গড়ে তুলুন, আর সুস্থ্য থাকুন।

আরও জানুনঃ

Default user image

শফিকুল বাশার কাজল, লেখক, আস্থা লাইফ

পিতামহ-পিতামহী অনেক শখ করিয়া নাম রাখিয়াছিলেন শফিকুল বাশার কাজল। ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক সম্পন্ন করিবার পর খানিক এই কাজ, কতক ওই কাজ করিয়া অবশেষে ২০১৩ সালের শেষ হইতে ‘সামাজিক মতে বেকারত্ব’ অর্থাৎ কিনা লেখালেখিকেই জীবিকা অর্জনের একমাত্র উপায় হিসাবে বরণ করিয়া লইয়াছি। অদ্যাবধি অন্ততপক্ষে আট-দশখানা দিশী-বিদিশী কোম্পানি এবং অগণিত ব্যক্তিবিশেষের জন্যে প্রায় চল্লিশ সহস্রাধিক লেখা নামে-বেনামে সম্পন্ন করিবার সুযোগ হইয়াছে। ভালোবাসি নিজের পরিবার, সন্তান, এবং ফুটবল।

Related Articles