মাল্টিভিটামিন এর অপব্যবহার আপনাকে যেভাবে ক্ষতি করছে
“ভিটামিনের ট্যাবলেট খেলে উপকার হবে, এতে কোন ক্ষতি নেই” - যা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। বরং অতিরিক্ত ভিটামিন এর ট্যাবলেট খেলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে। আর আজকে আমরা ঠিক সেই ঝুঁকিগুলো সম্বন্ধেই জেনে নেবো।
মাল্টিভিটামিন বর্তমান সময়ের বেশ জনপ্রিয় একটি ওষুধ। যদিও মেডিকেলের ভাষায় একে ঠিক ‘ওষুধ’ বলা চলে না। কারণ এটি সাধারণ ওষুধের ন্যায় কোন রোগ প্রতিরোধের জন্য সরাসরি ব্যবহৃত হয় না। ডাক্তাররা বরং এগুলো আমাদের পুষ্টির ‘সম্পূরক অংশ’ বা সাপ্লিমেন্ট হিসাবে খাওয়ার জন্য দিয়ে থাকেন।
আমাদের দেশে ঠিক কত শতাংশ মানুষ এই সাপ্লিমেন্ট নিয়মিত গ্রহণ করে তার কোন সঠিক উপাত্ত আমাদের হাতে না থাকলেও একটা উপাত্ত থেকে সেই সংখ্যাটা খুব সহজেই অনুমান করা যায়। আমেরিকান অস্টিওপ্যাথিক অ্যাসোসিয়েশনের এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে আমেরিকার ৮৬% জনগণ এই ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করে থাকে। এবং শুধু আমেরিকাতেই না, এই ভিটামিন সাপ্লিমেন্টস, যেগুলোকে আমরা সহজ ভাষায় ভিটামিন ট্যাবলেট বলি, এগুলো সারা বিশ্বেই দিনদিন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এবং তার সঙ্গত কারণও রয়েছে।
দৈনন্দিন জীবনে আমাদের ব্যস্ততা এতটাই বেড়ে গেছে যে সুষম খাবার খাওয়ার প্রতি মনোযোগ দেয়ার আর সময় হয়ে উঠছে না। “কোনরকমে তাড়াহুড়া করে চারটা খেয়েই আবার কাজ শুরু করতে হবে” এই চিন্তাধারার ফলে আমাদের শরীরের পুষ্টির চাহিদা বেশিরভাগটাই থেকে যাচ্ছে অপূর্ণ। তার উপর আবার রয়েছে পুষ্টিকর খাবার সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব এবং শাকসবজি ও ফলমূলে পর্যাপ্ত খাদ্যগুণের অনুপস্থিতি। আর তাই ব্যস্ত জীবনের সহজ সমাধান হয়ে উঠেছে এই মাল্টিভিটামিনস।
কিন্তু মাল্টিভিটামিন সেবনে আসচেতনাই আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জেনে না বুঝে, কারণে অকারণে খাওয়াতে মাল্টিভিটামিন ওভারডোজ হয়ে যাচ্ছে। আর এতে নানা ধরণের সাইড ইফেক্ট বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে।
মাল্টিভিটামিন ওভারডোজ এর সাইড ইফেক্টসমূহ
রোগীর শরীরে যখন ভিটামিন ডেফিশিয়েন্সি দেখা দেয় তখনই সাধারণত ডাক্তাররা মাল্টিভিটামিনস সাজেস্ট করে থাকে। কিন্তু এই ট্যাবলেটগুলো যেহেতু কোন প্রেসক্রিপশান ছাড়াই যেকোনো ওষুধের দোকান থেকে কিনতে পারা যায়, তাই বেশীরভাগ মানুষ এগুলো খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শের খুব একটা তোয়াক্কা করে না। এর ফলে তারা নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশী খেয়ে ফেলে। ওভারডোজ বা অতিরিক্ত ভিটামিনের ওষুধ একজন মানুষের শরীরে নিম্নোক্ত সমস্যাগুলো তৈরি করতে পারে।
ভিটামিন ‘এ’ ওভারডোজ
এর ফলে-
-
মাথা ঘোরা,
-
বমি, এবং
-
চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যেতে পারে।
ভিটামিন ‘ডি’ ওভারডোজ
এর ফলে-
-
রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেতে পারে, যাকে হাইপারক্যালসেমিয়া বলা হয়।
-
এই হাইপারক্যালসেমিয়ার কারণে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে, কিডনিতে পাথর হতে পারে, এবং হার্ট ও ব্রেইনের কাজে বাঁধা দিতে পারে।
ভিটামিন ‘ই’ ওভারডোজ
অতিরিক্ত ভিটামিন এ শরীরে প্রবেশ করলে-
-
মাংসপেশির দুর্বলতা,
-
অবসাদ,
-
বমি বমি ভাব,
-
ডায়রিয়া, এবং
-
অস্বাভাবিক রক্তপাতের সম্ভাবনা থাকে।
ভিটামিন ‘কে’ ওভারডোজ
ভিটামিন কে এর ওভারডোজ সাধারণত-
-
নবজাতক শিশুদের ক্ষেত্রে বেশী দেখা যায়।
-
শরীরে ভিটামিন কে এর আধিক্য থাকলে লাল রক্ত কণিকা (রেড ব্লাড সেল) ভেঙে যায়।
-
ফলে রক্তশূন্যতা এবং জন্ডিস দেখা দিতে পারে।
ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স ওভারডোজ
মোট ৮ ধরণের বি ভিটামিনকে একত্রে বোঝানোর জন্য ‘বি কমপ্লেক্স’ টার্মটি ব্যবহার করা হয়। আর এই বি কমপ্লেক্সের ওভারডোজের কারণে-
-
ত্বকের র্যাশ, অনিদ্রা,
-
গ্যাস্ট্রিকজনিত সমস্যা,
-
অতিরিক্ত মুড সুয়িং,
-
অস্বাভাবিক রক্তচাপ ইত্যাদি হতে পারে।
ভিটামিন ‘সি’ ওভারডোজ
অতিরিক্ত ভিটামিন সি এর ট্যাবলেট খাবার কারণে-
-
ডায়রিয়া,
-
বমি,
-
হৃদযন্ত্রে জ্বালাপোড়া,
-
তলপেটে খিঁচুনি, এবং
-
মাথায় যন্ত্রণা হতে পারে।
সরাসরি এই ভিটামিনগুলো ছাড়াও আরও দুটি উপাদান রয়েছে যা মাল্টিভিটামিনের ট্যাবলেটের ভেতরে পাওয়া যায়। সেগুলো হল আয়রন এবং ক্যালসিয়াম। এবং যেহেতু ভিটামিনের ট্যাবলেট খাওয়ার সময় আমরা এই দুটি উপাদানও গ্রহণ করি তাই এগুলোর ওভারডোজ সম্পর্কেও আমাদের জেনে রাখা দরকার।
আয়রন ওভারডোজ
আয়রন ওভারডোজের ফলে-
-
বমি এবং ডায়রিয়া দেখা দিতে পারে।
-
ওভারডোজের পরিমাণ বেশী হয়ে গেলে তখন লো ব্লাড প্রেশার, লিভার ফেইলিওর, ফুসফুসে ক্ষত, কোমা, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ক্যালসিয়াম ওভারডোজ
মাত্রাতিরিক্ত ক্যালসিয়াম খেলে-
-
কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে।
-
এছাড়া রক্তে পিএইচ এর মাত্রা বেড়ে যাওয়া, মাথা ঘোরা এবং বমি বমি ভাব, চুলকানি, এবং অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, যেকোনো কিছুরই অতিরিক্ত ভালো না। মাল্টিভিটামিন সাপ্লিমেন্টসও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই যেকোনো ধরণের মাল্টি ভিটামিন গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে ডোজ নির্ধারণ করে নিতে হবে এবং নির্দিষ্ট ডোজের অতিরিক্ত খাওয়া যাবে না। উপরে উল্লেখিত ভিটামিন ওভারডোজ সংক্রান্ত যেকোনো জটিলতা দেখা দিলে অতিসত্ত্বর নিকটস্থ হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।