ডায়াবেটিস মাপার মেশিন নিরাপদে ব্যবহার করবেন যেভাবে

রক্তে শর্করা পরীক্ষা এবং নিরীক্ষণের জন্য গ্লুকোমিটার ব্যবহার করা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশিদের জীবনের একটি দৈনন্দিন অংশ। তবে এর সঠিক ব্যবহার না জানলেই আছে বিপদ। আর তাই গ্লুকোমিটার এবং টেস্ট স্ট্রিপগুলি নিরাপদে ব্যবহার করছেন কিনা তা জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।

২০১৯ সালে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী দেশের ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। যাদের একটা বড় অংশ গ্লুকোমিটার ব্যবহার করে থাকেন।

তবে ডায়াবেটিস মাপার মেশিন বা গ্লুকোমিটার ব্যবহার সম্পর্কে জানার আগে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সাধারণ কিছু ধারণা জেনে নেই।

ডায়াবেটিস কিভাবে হয়?

ডায়াবেটিস কিভাবে হয় সেটা বোঝার আগে আমাদের বুঝতে হবে যে আমাদের শরীরে শর্করা বা গ্লুকোজ কিভাবে কাজ করে। আমাদের পাকস্থলির পিছনদিকে একটা গ্ল্যান্ড আছে যাকে বলা হয় প্যানক্রিয়াস। এই প্যানক্রিয়াসের কাজ হচ্ছে হরমোন ইনসুলিন নির্গত করা। এই হরমোন ইনসুলিন শর্করাকে রক্তপ্রবাহ থেকে কোষে নিয়ে যায়। শর্করা কোষে যেয়ে শক্তিতে রূপান্তরিত হয় যেই শক্তি তাৎক্ষণিক ব্যবহৃত হয় অথবা ভবিষ্যতে ব্যবহৃত হবার জন্য জমা থাকে। এই প্যানক্রিয়াস যখন যথেষ্ট পরিমাণে হরমোন ইনসুলিন উৎপাদন করতে না পারে তখন আমাদের রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। একেই বলা হয় ডায়াবেটিস।

ডায়াবেটিস কত ধরণের হয়?

সাধারণত ৫ ধরণের ডায়াবেটিস দেখা যায়ঃ

১. টাইপ ১ ডায়াবেটিস

এই ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে প্যানক্রিয়াস অত্যন্ত স্বল্প মাত্রায় ইনসুলিন উৎপাদন করে অথবা একেবারেই করে না। এটি সাধারণত শিশু, কিশোর, এবং তরুণদের মাঝে বেশী দেখা যায়।

২. টাইপ ২ ডায়াবেটিস

এটি ডায়াবেটিসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বহুল প্রচলিত ধরণ। মোট ডায়াবেটিস রোগীর ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশই টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এই রোগের ফলে শরীর ইনসুলিনকে কাজ করতে বাঁধা দেয়। ইনসুলিন কাজ না করতে পারলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়।  

৩. জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস

এটি একটি বিশেষ ধরণের ডায়াবেটিস যা শুধুমাত্র গর্ভকালীন সময়তেই দেখা দেয়। এসময়ে গর্ভের শিশুর বিকাশের জন্য প্লাসেন্টা হরমোন উৎপাদন করে। অনেকসময় এই হরমোনগুলো মায়েদের শরীরে ইনসুলিনকে কাজ করতে বাঁধা দেয়।

৪. মনোজেনিক ডায়াবেটিস

এই ডায়াবেটিস অত্যন্ত দুর্লভ। মূলত একটা জিন এর মিউটেশনের ফলে এই ডায়াবেটিস দেখা দেয়। তরুণদের মাঝে এর প্রাদুর্ভাব অনেক বেশী।

৫. টাইপ বি ইনসুলিন রেজিস্টেন্স

এটা হচ্ছে সবচেয়ে দুর্লভ ধরণের ডায়াবেটিস। এটা মূলত অটোইমিউন ডিজঅর্ডার এর একটি ধরণ।

ডায়াবেটিস টেস্ট এর ধরণসমূহ

একজন মানুষের শরীরের ডায়াবেটিস আছে কিনা তা জানার জন্য তার রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ পরীক্ষা করা হয়। তিনটি উপায়ে এই পরীক্ষাগুলো করা যেতে পারে।

  • PPBS বা পিপিবিএস (পোস্ট প্রানডিয়াল ব্লাড শুগার) টেস্ট – খাওয়ার ২ ঘণ্টা পরে করা হয়।

  • FBS বা এফবিএস (ফাস্টিং ব্লাড শুগার) টেস্ট – সকালে খালি পেটে করা হয়।

  • RBS বা আরবিএস (র‍্যানডম ব্লাড শুগার) টেস্ট – যেকোনো সময় খালি/ভরা পেটে করা যায়।

আগে এই টেস্টগুলো করার জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তবে বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে এখন এই টেস্টগুলো খুব সহজে এবং খুব অল্প খরচে ঘরে বসে গ্লুকোমিটারের সাহায্যেই করে ফেলা যায়।

গ্লুকোমিটার কি এবং এটি কিভাবে কাজ করে?

গ্লুকোমিটার হচ্ছে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরিমাপের একটি যন্ত্র। একটা গ্লুকোমিটার কিট এর কয়েকটা অংশ থাকে যেমন, 

  • গ্লুকোমিটার ডিভাইস

  • ল্যান্সেট

  • ল্যান্সিং পেন

  • গ্লুকোমিটার স্ট্রিপস

  • ব্যাটারি ইত্যাদি। 

গ্লুকোমিটার এর মাধ্যমে রক্তে গ্লুকোজ এর মাত্র পরিমাপের জন্য নীচের পদক্ষেপগুলি অনুসরণ করুনঃ

  • টেস্ট স্ট্রিপের ভায়াল থেকে একটি স্ট্রিপ বের করুন।

  • স্ট্রিপটি মিটার ডিভাইসে প্রবেশ করান।

  • ল্যান্সেট বা সুঁই ল্যান্সিং পেন এর ভিতর প্রবেশ করান।

  • হাত ভালোভাবে সাবান দিয়ে ধুয়ে মুছে নিন অথবা অ্যালকোহল দ্রবণে মুছে নিন। দ্রবণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভালো করে শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।

  • এবার ল্যান্সিং পেন দিয়ে হাতের আঙুলের অগ্রভাগে একটা ফুটো করুন যেন এক ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে আসতে পারে।

  • রক্তের ফোঁটা টেস্ট স্ট্রিপের অগ্রভাগে লাগান এবং রিডিং পাবার জন্য অপেক্ষা করুন।

অ্যামেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের মতে খাওয়ার আগের টেস্টে গ্লুকোজের মাত্রা ৪.৪-৭.২ মিলিমোল/লিটার হল ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। আর খাওয়ার পরের টেস্টে স্বাভাবিক মাত্রা হচ্ছে ১০ মিলিমোল/লিটার এর কম।

ডায়াবেটিস টেস্ট স্ট্রিপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা

টেস্ট স্ট্রিপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নীচের বিষয়গুলির প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবেঃ

  • অপরিষ্কার হাতে টেস্ট করবেন না।

  • খাওয়ার ঠিক পরেই টেস্ট করবেন না।

  • খুব বেশী প্রয়োজন না পড়লে আঙ্গুল চেপে রক্ত বের করবেন না।

  • মেয়াদ উত্তীর্ণ স্ট্রিপ ব্যবহার করবেন না।

  • আপনার গ্লুকোমিটারের সাথে যে স্ট্রিপটি ব্যবহার করবার কথা তার বাইরে অন্য কোন স্ট্রিপ ব্যবহার করবেন না।

  • যেকোনো সমস্যায় ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন।

নিয়ন্ত্রণে রাখা না গেলে ডায়াবেটিস খুবই জটিল একটা রোগে পরিণত হতে পারে। এর ফলে এমনকি মৃত্যুও অস্বাভাবিক নয়। তবে আশার সংবাদ হচ্ছে খাদ্যাভ্যাসে নিয়ন্ত্রণ, শরীরচর্চা, এবং ওষুধের মাধ্যমে ডায়াবেটিসকে অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এজন্য সঠিকভাবে গ্লুকোজ এর মাত্রা পরিমাপ করতে পারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর সঠিক নিয়মে গ্লুকোমিটারের ব্যবহার আপনার জীবনকে করে তুলতে পারে আরও সহজ এবং সাবলীল।

Default user image

শফিকুল বাশার কাজল, লেখক, আস্থা লাইফ

পিতামহ-পিতামহী অনেক শখ করিয়া নাম রাখিয়াছিলেন শফিকুল বাশার কাজল। ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক সম্পন্ন করিবার পর খানিক এই কাজ, কতক ওই কাজ করিয়া অবশেষে ২০১৩ সালের শেষ হইতে ‘সামাজিক মতে বেকারত্ব’ অর্থাৎ কিনা লেখালেখিকেই জীবিকা অর্জনের একমাত্র উপায় হিসাবে বরণ করিয়া লইয়াছি। অদ্যাবধি অন্ততপক্ষে আট-দশখানা দিশী-বিদিশী কোম্পানি এবং অগণিত ব্যক্তিবিশেষের জন্যে প্রায় চল্লিশ সহস্রাধিক লেখা নামে-বেনামে সম্পন্ন করিবার সুযোগ হইয়াছে। ভালোবাসি নিজের পরিবার, সন্তান, এবং ফুটবল।

Related Articles