মাল্টিটাস্কিং কি আসলেই কর্মদক্ষতা বাড়ায় নাকি কমায়?
মাল্টিটাস্কিং কি আমাদের আরো বেশি দক্ষ করে তুলছে বা আমাদের প্রোডাক্টিভিটি বাড়াচ্ছে? নাকি ঘটনাটা সম্পূর্ণ এর বিপরীত? আসুন দেখি গবেষণা কি বলে।
মাল্টিটাস্কিং এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে একই সময়ে একাধিক কাজ করা। ধারণা করা হয় যে ১৯৬৫ সালে আইবিএম এর একটি পেপারে আইবিএম/৩৬০ এর সক্ষমতা সম্পর্কে জানাতে প্রথম এই ‘মাল্টিটাস্কিং’ শব্দটি ব্যাবহার করা হয়। তবে মানুষের ক্ষেত্রে এই শব্দের প্রয়োগ কিন্তু এসেছে আরও অনেক পরে। ’৬০ এর দশকে হিউম্যান মাল্টিটাস্কিং ছিল গবেষণার স্তরে। পরবর্তীতে আনুমানিক ১৯৯৮ এর দিকে হিউম্যান মাল্টিটাস্কিং নিয়ে বেশী বেশী চর্চা হতে থাকে।
তো যেমনটা বলছিলাম, মাল্টিটাস্কিং হচ্ছে একই সময়ে একই সাথে একের অধিক কাজ করা। যেমন ফোনে কথা বলতে বলতে ল্যাপটপে কোন কাজ সেরে নেওয়া কিংবা কফি খেতে খেতে সংবাদপত্রটা পড়া, আবার গাড়ি চালানোর সময় ফোনে কথা বলা অথবা গান শোনা এসবই মাল্টিটাস্কিং। কিন্তু কয়েকটা কাজ পর পর করা হলে তাকে মাল্টিটাস্কিং বলা যায় না। যেমন ধরুন আপনি কাপড় ইস্ত্রি করে এরপর ভাজ করে রাখছেন কিংবা চা খাওয়াটা শেষ করে পত্রিকা পড়ছেন তখন এগুলো মাল্টিটাস্কিং হবে না ।
বর্তমান সময়ে মাল্টিটাস্কিং এর ধারনাটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ভাবা হয় যে মানুষটা একইসাথে যত বেশি কাজ সম্পাদন করতে পারে সে তত বেশি দক্ষ এবং কোন প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিতে সে বেশি অবদান রাখতে পারে। তাই কর্পোরেট জগতে সবাই নিজেকে মাল্টিটাস্কার হিসেবে ভাবতে ও দেখতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু আসলেই কি তাই?
মাল্টিটাস্কিং করা কি আদৌ সম্ভব?
এটা খুবই অস্বাভাবিক যে একজন মানুষ একই সময়ে দুই বা তার অধিক কাজ একসাথে করতে পারবে। আমাদের বেশিরভাগকেই বড়জোর সিরিয়াল ইউনিটাস্কার বলা চলে। নতুন এক গবেষনায় বলা হয় যে বেশ কিছু কাজ একসাথে করার ক্ষেত্রে আমরা মানুষেরা ততটা ভাল নই যতটা ভাল আমরা মনে করি। বিজ্ঞানীরা বলে মানুষ একসাথে অনেকগুলো কাজ বা মাল্টিটাস্কিং করে না। এর পরিবর্তে আমরা যা করি তা হল আমরা আমাদের মনযোগকে এক কাজ থেকে অন্য কাজে খুব দ্রুত সরিয়ে নেই। আর একসাথে বিভিন্ন কাজ করার ক্ষেত্রে আমরা মনে করি আমরা একই সময়ে সবকিছুতেই সমান ভাবে মনযোগ দিচ্ছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা তা করছি না ।
যেমন ধরুন আপনি ই-মেইল লিখছেন এবং একইসাথে ফোনে কথা বলছেন। এখানে দুটো কাজ একসাথে করা হচ্ছে বলে মনে হলেও আসলে এই দুটো কাজ একসাথে সমান মনোযোগ দিয়ে করা সম্ভব নয়। এখানে আপনি হয়ত একটি কাজের প্রতি ফোকাস কমিয়ে দিয়ে আরেকটি কাজ করছেন, আবার অন্য কাজে ফিরে যাচ্ছেন।
দুটো কাজে একইসাথে আপনি মনোনিবেশ করতে পারছেন না। কারণ এখানে দুটি আলাদা কাজ করা হচ্ছে যার কারনে আমাদের মস্তিস্ককে আলাদাভাবে ভাবতে হচ্ছে। তাই বলে মাল্টিটাস্কিং যে একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার তা কিন্তু নয়।
আমাদের মস্তিষ্কের পক্ষে তথা আমাদের পক্ষে মাল্টিটাস্কিং করা সম্ভব যদি কোন একটি কাজ মস্তিষ্কের উপর খুব একটা প্রভাব না ফেলে কিংবা খুব বেশি চিন্তাভাবনা করে কাজটি করা না লাগে। যেমন হাটতে হাটতে চুইংগাম খাওয়া খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার যেখানে চুইংগাম খেতে আমাদের খুব একটা চিন্তাভাবনা করতে হয় না বা মস্তিষ্কের উপর কোন প্রভাব পড়ে না। সমস্যাটি আসে যখন দুটি কাজই মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। কিংবা কাজগুলো করার ক্ষেত্রে আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়কে সজাগ থাকতে হয়।
কারন মানব মস্তিষ্ক দুটি কাজ একসাথে একাগ্রতার সহিত কখনোই করতে পারে না
এর ফলে দুটি কাজের কোনটিই পূর্ণ মনযোগ পায় না এবং পরিপূর্ণ দক্ষতার সাথে একটি কাজও করা যায় না। একটি বই পড়ার সময় দুটি সংখ্যা গুণ করার চেষ্টা করুন, দেখবেন কোনটিই সঠিকভাবে করতে পারছেন না ।
এম আই টি এর নিউরো সাইন্টিস্ট অধ্যাপক আর্ল মিলারের মতে লোকেরা খুব ভালভাবে মাল্টিটাস্ক করতে পারে না কিন্তু যখন তারা বলে যে তারা পারে তখন তারা নিজেরাই নিজেদের বিভ্রান্তিতে ফেলছে।
মাল্টিটাস্কিং কি প্রোডাক্টিভিটি বাড়ায়?
মাল্টিটাস্কিং করার প্রবনতা মস্তিষ্কে এক বিরুপ পরিবর্তন নিয়ে আসে যা হতাশা এবং উদ্বেগ সৃষ্টি করে এবং প্রকৃতপক্ষে প্রোডাক্টিভিটি হ্রাস করে। কিছু কিছু গবেষণা বলে যে মাল্টিটাস্কিং আপনার বোধগম্যতা, মনযোগ এবং সামগ্রিক কর্মদক্ষতা হ্রাস করার মাধ্যমে প্রোডাক্টিভিটি কমিয়ে দেয়।
কারন মাল্টিটাস্কিং এর সময় বিভিন্ন কাজ একসাথে করা হয় যেখানে আমরা খুব দ্রুত আমাদের মনযোগ এক কাজ থেকে অন্য কাজে সরিয়ে নেই এবং এর ফলে আমরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ি। গবেষকদের মতে যারা মাল্টিটাস্ক করে তারা দ্রুত কাজ করে কিন্তু তাদের মাঝে উৎপাদনশীলতা কমে যায়।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষনায় দেখা যায় যারা নিজেদের খুব ভাল মাল্টিটাস্কার বলে দাবি করত এবং বিশ্বাস করত যে এটা তাদের কর্মক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয় তারা আসলে কাজের ক্ষেত্রে খারাপ করেছে, যারা একবারে একটি কাজ করে তাদের তুলনায়। মাল্টিটাস্কারদের ক্ষেত্রে তাদের চিন্তাভাবনাগুলিকে সমন্বয় করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল এবং এক কাজ থেকে অন্য কাজে সুইচ করার ক্ষেত্রেও তারা ধীরগতির ছিল।
মস্তিষ্কের উপর মাল্টিটাস্কিং এর প্রভাব
মাল্টিটাস্কিং কেবল আমাদের চিন্তাভাবনার মধ্যে শূন্যতাই সৃষ্টি করে না, এটি আমাদের মস্তিষ্কেরও ক্ষতি করে। একাধিক কাজের মধ্যে খুব দ্রুত সুইচ করার ফলে মস্তিষ্কে অক্সিজেনেটেড গ্লুকোজ ব্যবহারের মাত্রা বেড়ে যায় ফলে আমরা স্বাভাবিকের চেয়ে খুব দ্রুতই ক্লান্ত হয়ে পড়ি।
আমাদের স্মৃতিশক্তি হ্রাসজনিত সমস্যার সাথেও মাল্টিটাস্কিং এর সম্পৃক্ততা আছে। দুই বছর আগে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে যারা অন্তত একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে ক্রমাগত একাধিক কাজ করে তাদের ওয়ার্কিং মেমোরি এবং লং টার্ম মেমোরিতে দুর্বলতা ছিল।
মাল্টিটাস্কিং এর সুফল
প্রতিটি কাজেরই ভাল খারাপ দুটি দিকই থাকে, ঠিক তেমনই মাল্টিটাস্কিং এরও কিছু ভাল দিক আছে যা আমাদেরকে মাল্টিটাস্কার হতে উৎসাহিত করে, যেমন-
-
সময় বাচায়: একসাথে কয়েকটি কাজ করার মাধ্যমে আমরা কম সময়ে আমাদের কাজগুলো শেষ করতে পারছি। যদিও আমাদের সামগ্রিক কর্মদক্ষতা হয়ত এর ফলে হ্রাস পাচ্ছে।
-
প্রোডাক্টিভিটি বাড়ে: মাল্টিটাস্কিং করার প্রবনতা প্রোডাক্টিভিটি কমায়। কিন্তু খুব অল্প কিছু ক্ষেত্রে এটি আমাদের প্রোডাক্টিভিটি কে বাড়িয়ে দেয় যেহেতু আপনি অল্প সময়ে কয়েকটি কাজ করার ক্ষমতা অর্জন করছেন।
-
মোটিভেশন: যখন আপনি অল্প সময়ে কয়েকটি কাজ করে ফেলবেন তখন ইন্সট্যান্টলী মোটিভেটেড ফিল করবেন কিছু সময়ের জন্য হলেও। কিন্তু মাল্টিটাস্কিং এর মাধ্যমে আমরা দীর্ঘমেয়াদী কোন উপকার পাই না বললেই চলে।
মাল্টিটাস্কিং এর কুফল
-
সামগ্রিক প্রোডাক্টিভিটি কমায়
-
কোন কাজ করার সময় অপ্রাসঙ্গিক তথ্য এড়িয়ে চলার ক্ষমতা কমে যায়
-
ভুল করার প্রবনতা বাড়িয়ে দেয়
-
মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং বিষন্নতা বাড়ায়
-
নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ কমে যায়
-
মাল্টিটাস্কিং আসক্তিতে পরিণত হতে পারে
তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যাবহারের এই যুগে সম্পূর্ণ একাগ্রতার সাথে কোন কাজ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। ফোন কিংবা ল্যাপটপে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার সময় ইন্টারনেট কানেকশন অন থাকলেই নোটিফিকেশন আসতে থাকে। এসবের কারনে কোন একটা কাজে মনযোগ ধরে রাখাটা কঠিন। কিন্তু মনযোগ দিয়ে কাজ করার গুরুত্বটা আমরা বুঝি ঠিকই। নতুন কোন কিছু শিখতে হলে আমাদের আরও মনযোগী হয়ে কাজ করতে হয়। নতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রে পূর্ণ মনঃসংযোগ না থাকলে সেটা শেখা হলেও তা খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়ার প্রবনতা দেখা যায়। তাই জটিল কোন কাজ বা বিষয় সমাধানে আমাদের সম্পূর্ণ একাগ্রতার সাথে মনযোগী হয়ে কাজটা করা উচিত। এক্ষেত্রে মাল্টিটাস্কিং যত এড়িয়ে চলা যায় ততই ভাল। একই ধরনের দুটি কাজ কিংবা খুব সহজেই করা যায় এমন, অথবা করতে করতে খুব দক্ষ হয়ে উঠেছে এমন কাজের ক্ষেত্রে মাল্টিটাস্কিং করা যেতে পারে।
সবশেষে বলা যায় আপনাকেই বুঝে নিতে হবে আপনি কোন কাজটা কিভাবে করতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। গুরুত্বপূর্ণ কিংবা জটিল কোন কাজের ক্ষেত্রে মাল্টিটাস্কিং এড়িয়ে চলে মনযোগের সাথে কাজটা করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। অপরদিকে টুকটাক সহজ কোন কাজ একসাথে সেরে ফেলে যদি সময় বাচানো যায় তাহলেও ব্যাপারটা মন্দ হয় না।