"মুড সুইং" - যেন নিজের সাথেই নিজের এক অঘোষিত লড়াই
এই ভালো এই মন্দ - কারণ ছাড়াই মেজাজ পরিবর্তন হচ্ছে মুড সুইং এর লক্ষণ। এটি একটি মানসিক সমস্যা। আর এই রোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের জানতে হবে মুড সুইং কেন হয় এবং এর থেকে বাঁচার উপায়।
সমস্ত মাস জুড়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিরামহীনভাবে একের পর এক ভার্সিটির ক্লাস,ল্যাব,পরীক্ষায় যখন ফারাহ বিরক্ত,তখনই টানা পাঁচ দিনের বন্ধ পাওয়া যেন,"মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি"র মতন অনাকাঙ্ক্ষিত। দারুণ খুশিমনে টেবিলে বসে প্রিয় নোটপ্যাডে পাঁচদিনের এক পরিকল্পনা লিখে ফেলল,যা সাজালো তার অপূরনীয় শখ,ঘুরতে যাওয়া,ও স্কিল ডেভলপমেন্টের টাস্ক দিয়ে। সবশেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমাতে গেল ফারাহ,কিন্তু তেমন ভাল ও পর্যাপ্ত ঘুম হলো না বললেই চলে। অবশ্য এ সমস্যা তাকে বেশ কয়েক মাস ধরেই ভোগাচ্ছে। যাই হোক পরের দিন সকালে আর কিছুতেই ফারাহ তার গত রাতের আনন্দ,উত্তেজনা খুঁজে পাচ্ছে না,চারদিকের সমস্ত কিছু বিরক্তিকর,অর্থহীন,বোঝার মতো মনে হচ্ছে তার। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানেই বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার সমস্ত পরিকল্পনা ক্যান্সেল করে দিল, বাগানের গাছগুলোতেও আজ পানি দেওয়ার তাড়া নেই তার, সকালের নাস্তা খাওয়ার কোনরূপ রুচি কিংবা প্রয়োজনীয়তা কিছুই তার অনুভব হচ্ছে না।প্রোডাক্টিভ কোন কাজ ই তার কাছে আর গুরত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না।সবকিছু ছেড়ে বিছানায় একরাশ ক্লান্তি নিয়ে কেঁদে চলল বেশ কয়েক ঘন্টা। সে নিজেও তার এই অস্বাভাবিকতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। পরবর্তীতে ক্লাসে গিয়ে সহপাঠীদের সাথে যখন তার এই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করল তখন আনিছ নামের এক ছেলে সহপাঠী ও তাকে সমর্থন করে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া একাধিকবার ও দীর্ঘস্থায়ী এ যন্ত্রনার অভিজ্ঞতা জানাল।
আমাদের আচরণের খুবই দ্রুত এই অস্বাভাবিক পরিবর্তন কে বলা হয়ে থাকে মুড সুইং।
মুড সুইং এর নির্দিষ্ট কোন লক্ষণ নেই,একেক ব্যক্তির একেক রকম লক্ষণ প্রকাশ পায়,সংখ্যায় ও ব্যক্তি ভেদে তা কম-বেশি হয়ে থাকে।
সাধারণ লক্ষণ
-
কোন কারণ ছাড়া সবকিছুকে গুরত্বহীন,অর্থহীন ভাবা।
-
হুট করেই মনে ভীষন রকম কষ্ট অনুভব করা কিন্তু এর পেছনে দায়ী সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে না পাওয়া।
-
আনন্দদায়ক মুহূর্ত উপভোগ না করে উল্টো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভীষণ রকম রেগে যাওয়া,অস্বাভাবিক আচরণ করা।
-
কোন কাজে মনোযোগ আনতে ও ধরে রাখতে না পারা,স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি কাজ না করা।
-
হঠাত করেই দীর্ঘক্ষণ কান্না করা।
তীব্র লক্ষণ
-
নিজেকে শারিরীক ভাবে আঘাত করা।
-
মানুষের সাথে মিশতে না পারা,নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া,আগের তুলনায় কষ্ট বাড়তে থাকা।
-
সমস্ত নেতিবাচক ঘটনার জন্য নিজেকে দায়ী ভেবে বিভিন্নভাবে নিজেকে কষ্ট দেওয়া।
-
কারও স্বাভাবিক বা ভাল আচরণে ও আক্রমনাত্মক হয়ে উঠা।
-
অতিরিক্ত মানসিক যন্ত্রনা ও অস্বস্তির পাশাপাশি শারিরীক যন্ত্রণা ও অস্বস্তি অনুভব করা।
মুড সুইং এর জন্য দায়ী যেসব কারণ
এর পেছনে সুনির্দিষ্ট খুব কম কারণ ই গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে। শুধুমাত্র গুটিকয়েক কারণ ই আচরণের এরূপ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে সক্ষম নয়,মেজর মাইনর বিভিন্ন ধরনের অধিক সংখ্যক কারণ এর পেছনে পাওয়া যায়।
১. দেহের হরমোনের তারতম্য।
২. পূর্বের কোন মানসিক সমস্যার প্রভাব।
৩. দীর্ঘদিন লাগাতার কোন শারিরীক অসুস্থতায় ভুগতে থাকা।
৪. দীর্ঘদিন কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পন্ন ঔষধ সেবন।
৫. দৌনন্দিন জীবনের ব্যক্তিগত, পেশাগত বিভিন্ন ধরনের কাজের চাপ।
৬. জীবনযাত্রার উত্থান-পতন।
৭. তীব্র হতাশা (শিক্ষাক্ষেত্রের অনিশ্চয়তা,কর্মক্ষেত্রের অনিশ্চয়তা,অতিরিক্ত অসুস্থ প্রতিযোগিতা,আকাঙ্ক্ষিত সফলতা না পাওয়া,ফ্যামিলি প্রব্লেম,ফাইনান্সিয়াল প্রব্লেম ইত্যাদি তীব্র হতাশার জন্য দায়ী)।
৮. ভারসাম্যহীন ঘুমের সময়সূচি/ঘুমের অপ্রতুলতা।
৯. অসামাঞ্জস্য ও ক্ষতিকর খাদ্যাভ্যাস(অতিরিক্ত ফাস্টফুড,অতিরিক্ত কফি বা ক্যাফেইন জাতীয় খাবার-পানীয়)।
১০. মাদকদ্রব্য সেবনের প্রভাব।
১১. দীর্ঘদিন নেতিবাচক পরিস্থিতির শিকার হওয়া ইত্যাদি।
পুরুষ ও নারী ভেদে মুড সুইং এর মাত্রা
নারী ও পুরুষ উভয় ক্ষেত্রেই মুড সুইং হতে পারে,তবে সাধারণত পুরুষের তুলনায় নারীদেরই এ সমস্যার সম্মুখীন বেশি হতে হয়,কিন্তু কিছু কিছু পুরুষের মাঝেও এর তীব্রতা অতিরিক্ত হতে পারে।
পুরুষের মুড সুইং
সাধারণ কারণ গুলো ছাড়াও হরমোনের তারতম্য, IMS (Irritable Male Syndrome) ইত্যাদি পুরুষের মুড সুইং এর জন্য অধিকাংশ দায়ী।পুরুষের দেহের একটি গুরত্বপূর্ণ হরমোন হল টেস্টোস্টেরন হরমোন, এই হরমোন পুরুষ দেহের আভ্যন্তরীণ, বাহ্যিক, মনস্তাত্ত্বিক অধিকাংশ বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে। যখন কোন পুরুষ দেহে নির্দিষ্ট মাত্রা ছাড়া টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কম-বেশি হয়ে যায়, বিশেষ করে অধিক মাত্রায় কমে যায় তখন তাদের নেতিবাচক আচরণগত বিভিন্ন পরিবর্তন হতে থাকে। মেজাজ বিগড়ে যাওয়া,বিরক্তি ভাব বেড়ে যাওয়া,অনীহা ও ক্লান্তি বৃদ্ধি, নানাবিধ আবেগিক সমস্যা ইত্যাদি প্রকাশ পায়।
নারীর মুড সুইং
সাধারণত নারীদের পুরুষদের তুলনায় একটু বেশিই মুড সুইং হয়ে থাকে। এর পেছনের বৈজ্ঞানিক কারণ না জানার ফলে সকলে নারীদের ছিঁচকাদুনে, এটেনশন সিকার, মানসিকভাবে দূর্বল ইত্যাদি বলে থাকে। মূলত প্রতি মাসের নিয়মিত বা অনিয়মিত ঋতুচক্রের পূর্বের সময় টা, ঋতুচক্র চলাকালীন সময়ে, অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন দীর্ঘ সময়, বাচ্চা প্রসবকালীন পরবর্তী সময়ে নারীদেহে হরমোনের মাত্রা ব্যাপকভাবে তারতম্য ঘটা, ঔষধ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া,যত্নের অভাব, এছাড়াও সেই সময় গুলো তে নতুন ভাবে কিছু হরমোন হুট করেই ক্ষনস্থায়ী সময়ের জন্য নিঃসৃত হয়ে থাকে আবার হুট করেই নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়, যা নারীদের মানসিক স্থিতিশীলতা (mental stability), আচরণ,চিন্তা-ভাবনা,অনুভূতি ইত্যাদিতেও অরভাব ফেলে, এবং ঘন ঘন ও দীর্ঘক্ষণ মুড সুইং এর শিকার হয়ে থাকেন। যা পরবর্তীতে প্রসব পরবর্তী মানসিক সমস্যা (Postpartum Depression) বা এরকম স্থায়ী মানসিক রোগের ও রূপ নিতে পারে। বিভিন্ন ধরনের হরমোনাল রোগও মুড সুইং এর জন্য দায়ী। এগুলো ছাড়াও সাধারণ কারণ গুলোও মুড সুইং ঘটিয়ে থাকে, তীব্র হতাশা, দুশ্চিন্তা, ওভার থিংকিং, অতিরিক্ত কাজের চাপ,মানসিক চাপ,নেতিবাচক পরিস্থিতি ও পরিবেশ এর মাঝে দিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
মুড সুইং নিয়ন্ত্রণের উপায়
রোগের স্বল্পতার সময় সঠিক সিদ্ধান্তই পারে একটি সুন্দর নিরাময়।
১. প্রতিদিন অল্প সময় হলেও শরীরচর্চা করা (হাঁটা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা ইত্যাদি)।
২. ফাস্টফুড,জাঙ্কফুড,কার্বনেটেড ব্রেভারেজ,অতিরিক্ত অস্বাস্থ্যকর তৈলাক্ত খাবার গ্রহণের মাত্রা যথাসম্ভব কমিয়ে আনা।
৩. খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সুষম ভেজালহীন খাদ্য গ্রহণ (দুধ, ডিম,মাংস, ফলমূল, শাকসব্জি, বাদাম ইত্যাদি), রান্নার সময় পুষ্টিমান ঠিক রেখে সঠিক আঁচে রান্না করা খাদ্য গ্রহণ।
৪. মাদকদ্রব্য সেবন, ধুমপান পরিহার করা, কফি বা ক্যাফেইন জাতীয় খাদ্য-পানীয় গ্রহণে নিয়ন্ত্রণ আনা।
৫. পরিমিত পরিমাণে ঘুম ও বিশ্রাম নিশ্চিত করা।
৬. নেতিবাচক ঘটনা, সঙ্গ, খবর এড়িয়ে চকা, নিজের আনন্দের দিক প্রাধান্য দেয়া।
৭. অতিরিক্ত মানসিক চাপ,কাজের চাপ নেওয়া থেকে বিরত থাকা।
৮. অহেতুক দুশ্চিন্তা, ওভার থিংকিং না করা।
৯. ছোট ছোট এচিভমেন্টেও নিজেকে পুরষ্কৃত করা।
১০. বিভিন্ন ধরনের মাইন্ডফুলনেস ব্যায়াম চর্চা, সেল্ফ মোটিভেট করা ইত্যাদি।
এসকল কিছু অনুসরণ এর পরও যদি কোন উন্নতি পরিলক্ষিত না হয় তবে দেরি না করে দ্রুত সাইকিয়াট্রিস্ট ও সাইকোলজিস্ট এর শরণাপন্ন হওয়া। কেননা দীর্ঘদিন কোন মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকলে ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পরবর্তীতে তা ভেতরে বাড়তে বাড়তে খুব শক্তিশালী হয়ে যায় এবং তখন কোন পরামর্শ বা স্বাভাবিক ঔষধ কাজ করে না, এটি এতটা তীব্র আকারে বহিঃপ্রকাশ ঘটে যা নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পরে এবং তখন কোনরূপ কারণ ছাড়াই রোগটি রোগীকে যন্ত্রণা দিয়ে থাকে। তাই সময় থাকতে আমরা সকলে আমাদের মেন্টাল প্রব্লেম ও হেলথ নিয়ে সোচ্চার হই, অন্যকে সঠিক টা জেনে আগানোর পরামর্শ দেই, এরকম পরিস্থিতি বা পরিবেশ সৃষ্টি না করি যা অন্যের মেন্টাল হেলথ ডেমেজের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের শরীর যেমন আকস্মিক ভাবেই বিভিন্ন ধরনের রোগের জটিলতার মুখোমুখি হয়,তেমনি আমাদের মন ও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রতিনিয়ত মানসিক বিভিন্ন সমস্যা গুরত্ব না দিয়ে আমরা না বুঝে না জেনে এড়িয়ে যাচ্ছি,যা পরবর্তীতে বিকট রূপে জটিল এক রোগ আকারে আমাদের ভেতর আত্মপ্রকাশ করে এবং তখন তা নিয়ন্ত্রণে আনা আমাদের জন্য হয়ে পড়ে কঠিন থেকে কঠিনতর। তাই সময় থাকাকালীন পুরুষ ও নারীর উভয়ের মানসিক সমস্যা নিয়ে সঠিক ধারণা রাখা ও সচেতন হওয়া খুবই জরুরী।