সুখি হবার সহজ ১০ টি উপায়
সুখ এবং দুঃখ পাশাপাশি চলে সর্বদা, এই সত্যটিও অস্বীকার করার মত নয়। আর তাই আজকের লেখাটিতে মনোবিজ্ঞানের মতে দশটি বিষয়ে আলোচনা করব, যা আপনার সুখ ও দুঃখের উপর অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ এনে দেবে। আর দুঃখ আসলেও শোচনীয় অবস্থা এড়িয়ে চলতে পারবেন।

একবিংশ শতাব্দীর এই অস্থির সময়ে সুখ কামনার চেয়ে “আমি সুখি” সেটা দেখানোই যেন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবার সুখের প্রচার স্ক্রল করতে করতে নিজের জীবনকেই মনে হয় বুঝি সবচেয়ে মলিন। ব্যাপারটি কি আসলেই তাই!
“Happiness is a state of mind” -Steve Maraboli,
অর্থাৎ সুখের সমস্ত অনুভূতির অবস্থান আমাদের মনে। আপনার জীবনে কি চলছে, কি দুর্ভাগ্যের স্বীকার হয়েছেন তার সাথে সুখী হবার সম্পর্ক থাকলেও মূলত এর জন্য দায়ী আমাদের মন। সুখের ধরণটাও খুব আপেক্ষিক। একজন বস্ত্রহীন লোকের জন্য নতুন জামা যতটা সুখের হবে আপনার জন্য ততটা নয়। আমাদের হাত, পা এর মত আমাদের মস্তিষ্ক ও অনেক ক্ষেত্রে একটি ঐচ্ছিক অঙ্গ, কিন্তু দেখা যায় আমরা হাত-পা নিজের ইচ্ছা মত নিয়ন্ত্রণ করলেও মস্তিষ্কের হাতে আমাদের সমস্ত অনুভূতির দায়িত্ব ছেড়ে দেই, অথচ, একটু চেষ্টা করলেই আমরা সুখ কে স্থায়ী ও দুঃখকে সহনীয় করে তুলতে পারি। চলুন আগে সুখ কি সেটা বোঝার চেষ্টা করা যাক।
সুখ কি?
সুখ এর সঙ্গা ব্যক্তি ভেদে অসংখ্য রকম। কারো কাছে সেটা সাফল্য বা খ্যাতি, করো কাছে প্রিয় জনের সান্নিধ্য, কারো সুখ বস্তুগত এমনি হাজারটা প্রকার ভেদ বের হবে। চলুন একটু সরলীকরণ করা যাক। সুখ বলতে এই প্রবন্ধ আমরা বোঝাব-
-
মানসিক প্রশান্তি
-
শারীরিক সুস্থতা
-
ভালো সামাজিক সম্পর্ক
-
অর্থপূর্ণ লক্ষ্য ও
-
আর্থিক নিরাপত্তা।
এর কোন একটি বিচ্যুত হলে সুখী হওয়া বহু দূরেই পড়ে থাকবে।
সুখী হবার বৈজ্ঞানিক দিকটা একটু দেখা যাক, যদিও বিজ্ঞান এদিকে খুব একটা উপকারী না। আমাদের মস্তিষ্কে যখন সুখী হরমোন যেমন ডোপামিন ও সেরাটনিন নিঃসৃত হয়, তখন আমাদের সুখী অনুভূত হয়। তবে একজন মানুষ হবার জন্যই বলতে পারছি, এতটুকই যথেষ্ট নয়। আমাদের আত্মপরিচয়, উদ্দেশ্য, নিরাপত্তা আরও অনেক কিছুই সামনে চলে আসে। চলুন অত না পেঁচিয়ে মূল অংশে চলে যাওয়া যাক।
সুখী হবার দশটি পদক্ষেপ
১. কৃতজ্ঞতা অনুশীলন করুন
আমরা ছোট থেকেই শুনে আসছি কৃতজ্ঞতা একটি মহৎ গুণ, কিন্তু এর শক্তি সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই কম। ধরুন, একটা মুভি টিকিটের লাইনে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছেন। যখন টিকিট পেলেন তখন জানলেন, একদম সর্বশেষ টিকিট টাই আপনি পেয়েছেন। সেই মুহূর্তে আপনি আপনার ভাগ্যের উপর কৃতজ্ঞ হবেন এবং আপনার চেয়ে সুখী সেই লাইনে কেউ হবে না। কেমন হয় আপনি আপনার জীবনের কৃতজ্ঞ হওয়া যায় এমন জিনিস গুলো খুঁজে দেখেন। এই লেখাটি যে ডিভাইসে পড়ছেন, সেটা দিয়েই শুরু করুন, মনে মনে বলুন আমি এই ফোন টার উপর কৃতজ্ঞ কারণ এর মাধ্যমে আমি পড়তে পরছি। এর চেয়ে ভালো হয় লিখে ফেললে। প্রতিদিন এমন দশটা জিনিস খুঁজে বের করুন যার উপর আপনি কৃতজ্ঞ। আপনার বাড়ি, স্বজন, বন্ধু, সুন্দর আবহাওয়া যে কোন কিছুই হতে পারে। এই কৃতজ্ঞতা বোধ আপনাকে সুখী হবার কারণ দেবে আর দুঃখকে করবে দুর্বল!
২. বর্তমানে বাঁচুন
ঠিক এই মুহূর্তে, একদম আক্ষরিক অর্থেই এই মুহূর্তে কি আপনার কোন কষ্ট বা অসুবিধা হচ্ছে? যদি হয়ে থাকে তাহলে আপনি আসলেই দুঃখী। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাবে আপনার বর্তমানে কোন দুঃখ নেই। আপনি হয়ত ফেলে আসা কোন অতীত ভেবে দুঃখ পাচ্ছেন না হয় ভবিষ্যতের কোন অনিশ্চয়তার কথা ভাবছেন। যখনই দুঃখ পাবেন, এই ব্যাপার টা অনুধাবন আপনার দুঃখ অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারে। উপলব্ধির পর বসে থাকবেন না, যদি ভবিষ্যতের সমস্যা টার জন্য যদি কিছু করতে পারেন সেটা করুন। বর্তমানে আপকার দায়িত্ব গুলো সেরে রাখুন। চারপাশ খেয়াল করুন, গাছে পানি দিন, বাইরে হেঁটে আসুন। দুঃখবোধ অনেকটাই সহনীয় হয়ে উঠবে।
৩. সামাজিক সম্পর্ক কে অবহেলা নয়
আপনি যদি পৃথিবীর সবচেয়ে সফল মনুষটিও হন, সেই গল্পটা প্রাণ ভরে কাউকে না বলতে পারলে সব কিছুই অর্থহীন হয়ে যায়। মাথায় রাখবেন যত কিছুই করুন না কেন, কিছু মানুষের সাথে আপনার সম্পর্ক সবসময় সুন্দর রাখতে হবে। সেই মানুষগুলো হলো তারা যারা আপনাকে আনন্দ ও উৎসাহ দেয়। আপনার কথা শোনে।
সব ধরণের সম্পর্ক ই গুরুত্বপূর্ণ, পরিবার, বন্ধুত্ব, প্রেম, আর সাধারণ পরিচিত। সম্পর্ক গুলো আপনাকে মানসিক ভাবে নিরাপত্তা দেবে আর দুঃখের সময় শক্তি যোগাবে। নেতিবাচক ও অপছন্দনীয় মানুষকে এড়িয়ে চলা, পছন্দের মানুষের সাথে থাকার মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
৪. স্বাস্থ্যের স্থান সবার আগে
স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কোন আপস নয়, সামান্য দাঁতে ব্যাথাই আপনার সমস্ত সুখ শান্তির সঙ্গা বদলে দিতে পারে। সেই সঙ্গে আমাদের স্বাস্থ্যকর অভ্যাস ও সুস্থ দেহের উপরে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য বড় ভূমিকা রাখে। আপনার শরীর ও মন সুস্থ্য থাকলে যেকোনো খারাপ পরিস্থিতি ও সামলে ওঠার শক্তি পাবেন। নিচের পয়েন্ট গুলো লক্ষ করুন।
-
পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন, কারণ পুষ্টিস্বল্পতায় মস্তিষ্ক ঠিক ভাবে কাজ করে না।
-
নিয়মিত ব্যায়াম করুন। ব্যায়াম আমদের শরীরের মত মনের জন্যও প্রয়োজনীয়। মাত্র ৫ মিনিট ব্যায়ামই শরীরে হ্যাপি হরমোন নিঃসৃত করতে পারে।
-
পর্যাপ্ত ও সময় মাফিক ঘুমান। ঘুম দেহ ও মন সুস্থ রাখে মেরামত করে ও নতুন প্রেরণা যোগায়।
-
ধ্যান করুন। সঠিকভাবে ধ্যান করলে মনের নেতিবাচক ভাবনা গুলো দূরে সরিয়ে দিয়ে রাখা যায়।
৫. নিজেকে সময় দিন
নিজেকে সময় দেওয়া সুখী হবার একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। নিজেকে সময় দেওয়া বলতে নিজের জীবনের উপর কাজ করা বোঝায়। ধরুন, একটা অগোছালো রুমে আপনি আছেন। আপনাকে যদি এক ঘণ্টা দেওয়া হয় শুধু রুমটা গোছাতে, আপনি কি করবেন? ধরুন সাধারণ গোছানো দশ মিনিটে হয়ে যাবে, তারপর খুঁজবেন আর কি করা যায়? হয়ত বিছানাটা সরিয়ে জানালার কাছে আনবেন, একটা পোট্রেট টাঙাবেন তারপর হয়ত ছোটখাটো আরো অনেক কিছুই করার পাবেন। নিজের জীবনের সাথে ঠিক এটাই করুন। দেখা যায়, আমরা ছোট ছোট অনেক কাজ ফেলে রাখি, একসাথে অনেক কাজ জমে যায়, তারপর নতুন নতুন ঝামেলা বাড়তে থাকে। আজকাল এত বিনোদনের যুগে একদম ঘাড়ের কাছে ডেডলাইন ছাড়া কেউ কাজ করতে চায় না। এর চাইতে একে একে সেরে ফেলতে থাকুন। ঝামেলার কাজটি আগে সারুন।
৬. অর্থপূর্ণ লক্ষ্যে কাজ করুন
কখনো এমন হয়েছে যে কি কারণে দুঃখবোধ হচ্ছে তা বুঝতে পারছেন না অথচ সবকিছু ঠিকই আছে। বিখ্যাত মনোবিদ ও দার্শনিক নিৎসের মতে, মানুষের একটা স্বভাব হচ্ছে সে সবসময় ভালো থাকতে পারে না, এমনকি চায়ও না। ভালো থাকলেও সে নিজের মত করে সমস্যা তৈরি করবে। ধরুন আপনার সবকিছু আছে, সুখে শান্তিতে আছেন। হঠাৎ মনে হবে আমার একটা গাড়ি কেন নেই? এই একটা গাড়ির চিন্তা আপনার সকল সুখ নষ্ট করবে। এ থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় নেই, কিন্তু যদি একটা বড় লক্ষ্যের পেছনে যদি নিজেকে লাগিয়ে দিতে পারেন, ছোট খাটো অপ্রয়োজনীয় দুঃখবোধ কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
৭. অর্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা শিখুন
এই কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে আমাদের সুখ শান্তির একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে অর্থ। অর্থের হিসেবি ব্যবহার আপনার জীবনকে আরো ঝামেলা হীন করে তুলতে পারে। প্রতি কিছুদিন পর পর অর্থের হিসাব খরচ ও আয়ের একটি পরিকল্পনা করুন। এতে করে অর্থ নিয়ে সবসময় বৃথা চিন্তা করতে হবে না। আপনি জানবেন কতটুকু খরচ করতে হবে কিভাবে চলতে হবে ইত্যাদি।
৮. সুস্থ বিনোদন উপভোগ করুন
বিনোদন আমাদের সুখের অন্যতম একটি উপকরণ। আজকের দুনিয়ায় বিনোদনের কোন অভাব নেই, কিন্তু সুস্থ অর্থপূর্ণ বিনোদন উপভোগের প্রচলন কমে গেছে। অপনার ভালো লাগে এমন বিনোদন এর মাধ্যম গুলো বেছে নিন। সেটা বই, মুভি, ঘুরতে যাওয়া যে কোন কিছু হতে পারে। খুব জ্ঞান সমৃদ্ধ হওয়ার দরকার নেই, অন্তত রুচিশীল কনটেন্ট গ্রহণ করার চেষ্টা করুন।
৯. শখ গুলো বাঁচিয়ে রাখুন
আমরা কতরকম শখ নিয়ে বড় হতে থাকি, কালের পরিক্রমায় আমাদের শখ গুলো অনেকসময় ত্যাগ করা লাগে। কিন্তু এই শখগুলোই আমাদের আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখে, সুখী করে, সঙ্গ দেয়। তাই শখ কখনো ত্যাগ করবেন না। শখ অনেকসময় আপনার গভীরতম বাসনা থেকেও দামী।
১০. তুলনা করা বন্ধ করুন
নদীর ওপাড়ে সব মানুষ কেই সুখী মনে হয়, কিন্তু আদতে ওপাড়েও মানুষ এপাড়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তাই অন্যদের সাথে তুলনা করা বন্ধ করুন, আর নিজের উপর মনোযোগ দিন, দেখবেন কোথায় কষ্ট পেতে হবে আন্ডারলাইন করে দিলেও খুঁজে পাচ্ছেন না।
পরিশেষে
সুখী হওয়ার যে অংশ টা খুব সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন তা হলো, নিজের জীবনটা ভালোভাবে সামলানো। কাজ গুলো করা, সম্পর্ক ঠিক রাখা, শরীর ও মনের যত্ন নেওয়া এই গুলো করলেই আপনার নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে থাকবে। বাকী টুকুর নির্ভর করে আপনার ভাবনার উপর, আপনার সন্তুষ্টির উপর। ভিক্ষুক কে কিছু খুচরা দিয়েও সুখী হওয়া যায়, সমস্ত পৃথিবী হাতে পেয়েও দুঃখী হওয়া যায়।