হার্টের জন্য ক্ষতিকর খাবার!

আমাদের খাদ্যাভ্যাসের সাথে হৃদরোগের সম্পর্ক এবং নিত্যদিনের খাদ্যাভ্যাস ব্যবস্থপনা। আমাদের হাতের কাছেই এমন সব খাবার পাওয়া যায় যা দিয়ে খুব সহজেই হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো যাবে।

আমাদের হৃদপিণ্ড বা হার্ট প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ বার স্পন্দিত হয়। আমাদের শরীরে হার্ট একমাত্র অঙ্গ, যা সারাক্ষণ কাজ করে, কখনোই বিশ্রাম নেয় না। সারাক্ষণ হার্টের কাজ করার জন্য প্রয়োজন হয় অক্সিজেন ও পুষ্টি, যা সরবরাহের জন্য রয়েছে হার্টের নিজস্ব রক্তনালি। মূলত তিনটি রক্তনালি তাদের শাখা-প্রশাখার মাধ্যমে রক্ত সরবরাহ করে থাকে হার্টের মাংসপেশিতে। তাই হার্টকে বলা হয়ে থাকে আমাদের শরীরের ইঞ্জিন। 

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বে সবচেয়ে বেশি লোক মারা যায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে যা কিনা শতকরা ৩১ শতাংশ। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে পুরো বিশ্বের প্রায় ১ কোটি ৭৩ লাখ মানুষ এই হার্ট জনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করে। ধারনা করা হয় আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি বছর ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ হৃদরোগে মারা যাবে। এর মধ্যে বেশি মারা যাবে নিম্নআয়ের দেশগুলোতে।

বাংলাদেশে হৃদরোগের অবস্থা 

আমাদের দেশে প্রতি চার জনের মধ্যে তিন জনই হার্টের অসুখে আক্রান্ত, হতে পারে এর মধ্যে আপনিও আছেন। অনেক কারণেই হতে পারে আপনার হার্ট জনিত সমস্যা, কিছু বংশগত আর কিছু অন্য রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জনিত, কিন্তু বেশির ভাগ সময় আপনার হৃদরোগের জন্য আপনি নিজেই দায়ী, যেমন, ধূমপান করা, নিয়মিত ব্যয়াম না করা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস (অতিরিক্ত পরিমাণে কোলেস্টেরল বা চর্বি জাতীয় খবার গ্রহণ), অ্যালকোহলে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া,  ইত্যাদি কারণ গুলোর দায়ভার অবশ্যই আপনার।

এছাড়াও যদি আপনার ডায়বেটিস (বহুমূত্র রোগ) থাকে, অথবা পরিবারের বাবা মা দুইজনই যদি ৫৫ বছর বয়সের আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হন, তাহলে আপনার হৃদরোগ হওয়ার সম্ভবনা থাকবে সাধারণ মানুষের থেকে প্রায় ৫০ শতাংশেরও বেশী। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে পরিবারে বাবা অথবা মায়ের যদি উচ্চ রক্ত চাপ থাকে, রক্তে চর্বির মাত্রা সাধারণ থেকে বেশী থাকে এবং ডায়বেটিস জনিত সমস্যা থাকে তাহলে সেই পরিবারের ছেলে মেয়েদেরও হৃদরোগের ঝুঁকি থাকতে পারে। 

আমরা প্রতিনিয়ত ফাস্ট ফুড খেয়ে থাকি, আজকের যুব সমাজের অধিকাংশই এই ফাস্ট ফুডে আসক্ত। ফাস্ট ফুড এ আছে অস্বাস্থ্যকর চর্বি, যাতে কলেস্টেরলের মাত্রা থাকে অনেক বেশী। আর এই অতিরিক্ত পরিমাণে চর্বি বা কোলেস্টেরল জাতীয় খাবার খাওয়া আপনার উচ্চরক্তচাপের জন্য দায়ী কারণ এই অতিরিক্ত চর্বি বা কোলেস্টেরল আপনার রক্তনালীকে বন্ধ করে দেয় যার ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়, এবং এটা থেকে পরবর্তীতে আপনার হৃদরোগের ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। তাই আপনি যদি আপনার রক্তে অস্বাস্থ্যকর চর্বি এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন তাহলে আপনি হৃদরোগের ঝুঁকি ২০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবেন।

শিশুরাও হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মূল কারণ হিসেবে ধরা হয় জাঙ্কফুড গ্রহণ ও খেলাধুলা না করা। খেলার জায়গার অভাব শিশুদের ঘরে বসে টিভি দেখা এবং মোবাইল গেমস খেলার প্রতি আসক্ত করে ফেলছে। এতে তাদের স্থূলতা বাড়ছে এবং হৃদরোগে আক্রান্তের ঝুঁকিতে পড়ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ৮ লাখ ৮৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৫৯ শতাংশ মানুষ মারা গেছে হার্ট, কিডনি, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন অসংক্রামক ব্যাধিতে। অর্থাৎ প্রতি বছর অসংক্রামক ব্যাধিতে মৃত্যু হয় ৫ লাখ ২২ হাজার ৭৪০ বাংলাদেশির। যার মধ্যে হৃদরোগে মারা যায় ৮৮ হাজার ৮৬৫ জন।

খাদ্যাভ্যাসের সাথে হৃদরোগের সম্পর্ক 

হৃদরোগকে খাদ্যবাহিত রোগ বলা হয়। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এবং শারীরিক কার্যক্রম হৃদরোগের ঝুকি অনেকটাই কমিয়ে দেয়। যদিও বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে হৃদরোগের প্রকোপ বাড়ছে, তবু মানুষের মধ্যে এখনো গড়ে ওঠেনি পর্যাপ্ত সচেতনতা। মানুষ হৃদরোগকে ভয় পেলেও তা প্রতিরোধে আগাম সতর্কতা অবলম্বনে এখনো পিছিয়ে আছে। অনেকেই এই রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কে রীতিমত অন্ধকারেই রয়ে গেছে।  

শরীরের অন্য যেকোনো অঙ্গ যদি তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে অর্থাৎ অঙ্গটি অকেজো হয়ে যায় তাহলে শুধুমাত্র ওই অঙ্গের কার্যের ব্যাঘাত ঘটে, কিন্তু যদি হৃদপিণ্ড নষ্ট বা বন্ধ হয়ে যায়? তাহলে আপনার মৃত্যু অনিবার্য। তাই হার্টকে যদি কার্যক্ষম রাখেন তাহলে আপনিও কার্যক্ষম থাকবেন। আর তাই নিজেকে সুস্থ রাখতে আপনার হার্টেরও যত্ন নেয়া জরুরী। 

হার্টকে সুস্থ রাখতে আপনি অনেক নিয়ম মেনে চলতে পারেন আর সেইসব নিয়মের পাশাপাশি হার্টকে ভালো রাখার জন্য আপনি গ্রহণ করতে পারেন কিছু সুস্বাদু খাবার। কথায় আছে “প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম” আর তাই আমাদের হার্টকে ঠিক রাখার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ঔষধ খেলে আপনি রোগ থেকে প্রতিকার পাবেন কিন্তু স্বাস্থ্যকর খাবার আপনাকে সাহায্য করবে রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। চলুন জেনে নেয়া যাক হার্টকে সুস্থ্য রাখার উপায় এবং স্বাস্থ্যকর খাবারগুলো সম্পর্কে।

১। আপনার খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করুন

খাদ্যগ্রহণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি আপনি কতটুকু খাবেন এটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনের থেকে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ, কিছুক্ষণ পরপর খাবার খাওয়া, মনের শান্তি না হওয়া পর্যন্ত খেয়ে যাওয়া আপনার শরীরে বাড়িয়ে দিতে পারে ক্যালরির পরিমাণ যেটা আপনার জন্য যতটুকু দরকার তার থেকে অনেক বেশী। সাধারণত আমারা যে রেস্তোঁরাগুলিতে যাই, সেখানে প্রায়ই প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশী খাবার পরিবেশিত হয়। আর এই অতিরিক্ত খাবার আপনার হার্টের জন্যও ক্ষতিকর। তাই হার্টকে সুস্থ রাখতে আপনার খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সবার আগে। আপনি একটি ছোট প্লেট বা বাটি ব্যবহার করতে পারেন খাবার পরিমাপ করে প্রতি বেলায় খাওয়ার জন্য। উদাহরণস্বরুপ, আপনি যদি পাস্তা খেতে চান তাহলে ১/৩ থেকে ১/২ কাপ; মাছ, মাংস অথবা মুরগী খেতে চাইলে প্রায় দুই থেকে তিন আউন্স পরিমাপ করে খেতে পারেন। স্বল্প-ক্যালরিযুক্ত ও পুষ্টিকর খাবার যেমন ফল এবং শাকসবজি এসব খান। এই কৌশলটি অবলম্বন করলে আপনার ফিটনেস ঠিক রাখার পাশাপাশি এড়াতে পারবেন হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি। খাবার পরিমাপের জন্যে কাপ,  চামচ অথবা স্কেল ব্যবহার করতে পারেন।

২। সকালের নাস্তায় সম্পূর্ণ শস্য জাতীয় খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন 

এসব শস্য জাতীয় খাবার আঁশ এবং অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদানের গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস। এসব খাবার রক্তচাপ এবং হার্টের স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। মিহি শস্য পণ্যগুলি যেমন, সাদা মিহি ময়দা, সাদা রুটি, ভুট্টা রুটি, বিস্কুট, কেক, নুডলস, বাটার্ড পপকর্ন ইত্যাদির জন্য সহজ বিকল্প তৈরি করে আপনি হার্টের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকায় পুরো শস্যের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলতে পারেন। যেমন, গমের আটা, বার্লি, বাদামী চাল, খই, ওটস, গমের পাস্তা ইত্যাদি।

৩। খাবারের তালিকায় বেশি পরিমাণে শাক-সবজি এবং ফলমূল যুক্ত করুন

শাকসবজি ও ফলমুল হচ্ছে ভিটামিন ও খনিজলবণের প্রধান উৎস যা স্বল্প ক্যালোরি এবং আঁশযুক্ত খাবার। বেশি ফল এবং শাকসবজি গ্রহণ আপনাকে অধিক ক্যালোরি যুক্ত খাবার যেমন মাংস, পনির এবং ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবারগুলি ত্যাগ করতে সহায়তা করবে। আপনার দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় শাক-সবজি এবং ফল যুক্ত করার জন্য আপনি কিছু পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। দ্রুত নাস্তা বানানোর জন্য আপনার ফ্রিজে সবজি ধুয়ে কেটে রাখুন। আপনার রান্নাঘরের একটি পাত্রে ফল রাখুন যাতে আপনি এটি  দেখলে খাওয়ার কথা মনে পরে যায়। প্রধান উপাদান হিসাবে শাকসব্জী বা ফল রয়েছে এমন খাবারের আইটেম গুলো বেছে নিন, যেমন মিক্সড ভেজিটেবল সালাদ, তাজা ফলের রস হার্টের জন্য খুবই ভালো। এছাড়া সবুজ শাক-সবজির মধ্যে পালংশাক, লাউ, কুমড়া, গাজর, বিট, বাঁধাকপি, ভুট্টা, লাল আলু ইত্যাদি হার্টের জন্য খুব উপকারী। এছাড়াও রয়েছে ক্যারটিনয়েড ও ভিটামিন-সি যুক্ত ফলমূল যেমন কমলালেবু, পেঁপে, আপেল, কলা, স্ট্রবেরি, আঙ্গুর, তরমুজ ইত্যাদি হার্টের জন্য খুবই উপকারী সকল উপাদানই রয়েছে। 

৪। সূর্যমুখী তেল বা সূর্যমুখী বীজ

সূর্যমুখী তেলে আপনি পাবেন ভিটামিন 'ই', যা শরীরের জারণ বিক্রিয়া প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। ধরুন আপনি একটি আপেল যদি কেটে রেখে দেন তাহলে সেটি বাতাসের স্পর্শ পেয়ে লালচে হয়ে যায়, এখানে আপেলের কাটা অংশটার জারণ হয়েছে যার জন্য কোষ গুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ঠিক তেমনি আপনার শরীরেও জারণ বিক্রিয়া হয় যার ফলে আপনার শরীরের কোষ মরে যায়, এবং আপনার হার্টেরও ক্ষতি হয়। সূর্যমুখী তেল অথবা বীজ সরাসরি হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে এবং আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।  তাছাড়া ভিটামিন 'ই' আপনার ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে সুরক্ষিত রাখবে।

৫। মাছ

সপ্তাহে অন্তত দুইদিন মাছ রাখুন আপনার খাদ্য তালিকায়। ছোট মাছ যেমন- মলা, কাচকি, টাকি, বেলে ইত্যাদি আপনি কোনো সংকোচ ছাড়াই খেতে পারেন। এগুলো আপনার হার্টকে সুস্থ্য রাখার পাশাপাশি শরীরের সব জৈবিক চাহিদা পূরণ করবে। এ ছাড়াও আপনি তালিকায় যুক্ত করতে পারেন পাবদা, শিং, কৈ ও মাগুর মাছকে। জাতীয় মাছ ইলিশ খাবেন বেশি করে। এতে অনেক বেশী পরিমাণে রয়েছে শরীরের জন্য উপকারী চর্বি যাকে বলা হয় ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড। এই ফ্যাটি এসিড আপনার রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে ও রক্তনালীতে কোলেস্টেরল জমাট বাঁধাকে প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে, যা হার্টের জন্য খুব প্রয়োজন। এখন বাজারে অনেক হাইব্রিড মাছ পাওয়া যায়, মাছের খামারিরা খাবারের সাথে রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে মাছকে দ্রুত বড় করে তুলে লাভের আশায়। আর এই মাছ গুলো শরীরের জন্য মোটেই উপকারী নয়। তাই হাইব্রিড মাছগুলো খাওয়া থেকে এড়িয়ে চলুন। খাদ্য তালিকা থেকে পাঙ্গাস, হাইব্রিড তেলাপিয়া, রুই এই জাতীয় মাছ বাদ দিয়ে দিন। গবেষকরা মনে করেন, সামুদ্রিক মাছ হৃৎপিন্ডের সুস্থতা রক্ষার পাশাপাশি আপনার শরীরে আয়োডিনের ঘাটতিও পূরণ করে সহায়ক। আপনি চাইলে নদীর মিঠা পানির বড় মাছের উপরের চর্বির অংশটুকু বাদ দিয়ে শুধু মাছটুকু খেতে পারেন।

৬। সয়াফুড

সয়াবিন থেকে তৈরি খাবারকে সয়া ফুড বলে। সয়াবিন শব্দটার সাথে বরাবরই পরিচিত আর এই শব্দ শুনলেই সবার আগে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সয়াবিন তেল। কারণ আমাদের দেশে সয়াবিন তেল বহুল পরিচিত কিন্তু সয়াবিনের বীজ তেমন একটা প্রচলিত নয়। কিছু কিছু এলাকায় শুধুমাত্র ডাল হিসেবেই খাওয়া হয়। সয়া ফুড জাতীয় খাবার গুলো যেমন সয়া দুধ, টাফু, সয়া বার্গার  ইত্যাদি কেবল আপনার কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখবে তা নয়, শরীরের জৈবিক কাজগুলো নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করবে। তাই আপনার খাবার তালিকায় যথেষ্ট পরিমাণে সয়াবিন রাখুন। আঁশযুক্ত সয়াবিন আপনার হার্টের জন্য খুব উপকারী। প্রতি ১০০ গ্রাম সয়াবিনে পাওয়া যায় ৪৩ গ্রাম প্রোটিন। সয়াবিন অবশ্যই ভালো করে সিদ্ধ করে খাবেন, কারণ সয়াবিন আপনার হজমে কিছুটা ব্যাহত করতে পারে।

৭। অলিভ অয়েল অথবা বাদাম তেল

হার্টের সুস্থ্যতায় রান্নায় সঠিক তেলের ব্যাবহারও খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং তেল নির্বাচনের সময় সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। রান্নায় অলিভ অয়েল বা বাদাম তেল ব্যবহার করা ভালো। সম্প্রতি এক গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে যে, দুর্বল হার্টের রোগীদের জন্য অলিভ অয়েল খুবই উপকারী খাবার। দুর্বল হার্টের জন্য জ্বালানি হিসেবে প্রয়োজনীয় চর্বির জোগান দেয় এই অলিভ অয়েল। আমাদের পুরো শরীরে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত পাঠাতে এবং রক্ত থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড বাইরে বের করে দিতে হার্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আর এই কাজে হার্টকে সংকোচিত এবং প্রসারিত হতে হয়। সাধারণত একটি হৃদপিন্ড তার স্বাভাবিক সংকোচন ও প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় যে শক্তি দরকার হয় সেটি গ্রহণ করে শরীরে আগে থেকে জমা করা চর্বি থেকে। যাদের হার্ট দুর্বল তারা এই চর্বি গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে হার্ট ভালোভাবে কাজ করতে পারে না এবং গ্রহণ করতে না পারা অতিরিক্ত চর্বি জমা হয়ে হৃৎপিন্ডের রক্তনালীতে বাঁধা তৈরী করে। এতে করে আমাদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে। অলিভ অয়েলে আছে ওলিয়েট নামের এক ধরনের উপকারী ফ্যাট, যা দুর্বল হার্টকে খুব সহজে প্রয়োজনীয় চর্বি গ্রহন করতে সাহায্য করে এবং হার্টকে রাখে সুস্থ্য। তাছাড়া অলিভ অয়েল কমাতে পারে ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি ও গড়ে তুলতে পারে ক্যানসার প্রতিরোধ।

৮। আদা, রসুন ও হলুদ

প্রতিদিন রান্নার সময় মসলা হিসেবে আদা, রসুন ও হলুদ ব্যবহার করুন। এগুলো আপনার রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে। হার্টের অসুখে কার্যকারী ভূমিকা পালন করে। হলুদে এমন একটি উপাদান রয়েছে রয়েছে যা প্রদাহজনিত আক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করে। রসুন হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং প্রাকৃতিকভাবেই এটা হার্টের ওষুধ হিসেবে আদিকাল থেকে ব্যবহার করা হয়। এটা হার্টের ভেতরে রক্ত চলাচলকে স্বাভাবিক রাখে। আদা এমন একটি ওষুধি উদ্ভিদ যা আমাদের রক্তনালীকে বিশ্রাম দেয় এবং রক্ত প্রবাহকে চালু রাখতে সাহায্য করে।

৯। ডার্ক চকলেট

আজকাল প্রায় সবাই চকলেট খেতে পছন্দ করে। আর যারা চকলেট পছন্দ করেন, তাদের জন্য আনন্দের সংবাদ হলো এই পরিমিত পরিমাণে চলকেটও হার্টের জন্য অনেক উপকারী। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডক্টর ন্যান্সি স্নাইড্যার্মা বলেছেন, “ডার্ক চকলেটে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাবিনয়েড, ফ্ল্যাবিনয়েড এক ধরণের উপাদান যা আমাদের হৃদরোগ থেকে রক্ষা করে।” কিন্তু মনে রাখা ভালো, অতিরিক্ত ডার্ক চকলেট আপনার শরীরের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত চকলেট আপনার ওজন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। 

১০। মধু

মধু কে সকল রোগের মহৌষধ বলে বিবেচিত করা হয়। মধুতে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন, মিনারেল এবং এনজাইম থাকে যা আমাদের শরীরের বিভিন্ন অসুস্থতা থেকে রক্ষা করে। মধু আমাদের হার্টের জন্য খুবই উপকারী। মধু আমাদের হার্টে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। উন্নতমানের মধুতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা ক্যান্সার এবং স্ট্রোকের মতো মারাত্মক অবস্থার ঝুকি কমায়। এছাড়া প্রতিদিন সকালে এক চামচ মধু খেলে ঠাণ্ডা, কাশি, কফ ইত্যাদি সমস্যা কমে যায়।

১১। কফি এবং গ্রীন টি

আজকাল আমরা সবাই প্রায় নিয়মিত কফি পান করি। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হোক বা দিনের শেষে, বিকেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় অথবা হালকা নাস্তার সময় এক কাপ কফির বিকল্প আমরা অনেকেই ভাবতে পারি না। গবেষনায় দেখা গিয়েছে, দিনে দুই কাপ কফি আপনার হৃৎপিণ্ডকে সব রোগ থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। বর্তমান সময়ে হার্টের জন্য সবচেয়ে বেশি ওষুধের কাজ করে গ্রীন টি। গ্রীন টি  রক্তের শিরাকেই সচল রাখার পাশাপাশি শিরাকে রক্ষাও করে। চিকিৎসকদের ধারণা, নিয়মিত গ্রিন টি গ্রহণ করা হলে রক্তনালি শিথিল হয় এবং রক্তচাপের পরিবর্তন হলেও তা পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতে পারে। এর ফলে রক্ত জমাট বেঁধে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি অনেকখানি কমে যায়। তাই হার্ট সুস্থ্য রাখতে আপনার বিকালের নাস্তায় গ্রীন টি এবং কফি রাখুন। 

১২। অস্বাস্থ্যকর চর্বি পরিহার করুন

চিকিৎসা বিজ্ঞানে অস্বাস্থ্যকর চর্বি বলতে বুঝায় স্যাচুরেটেড এবং ট্রান্স ফ্যাট গুলোকে, যা আমরা প্রতিনিয়ত খাচ্ছি ফাস্ট ফুড, অস্বাস্থ্যকর তেলে ভাজা খাবার, পোড়া তেলে ভাজা খাবার ইত্যাদি খাওয়ার মাধ্যমে। এই ধরনের চর্বি  রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়ায়, যা আমাদের রক্তনালীকে বন্ধ করে দেয়, যার ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে। তাই রক্তের কোলেস্টেরল এর পরিমাণ হ্রাস এবং হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য খাদ্য তালিকা থেকে অস্বাস্থ্যকর চর্বি পরিহার করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

১৩। আপনার খাবারে অতিরিক্ত লবণ নিয়ন্ত্রণ করুন

আমরা খাবারের সাথে যে লবণ খাই তাতে থাকে সোডিয়াম থাকে, আর এই সোডিয়াম আমাদের রক্তের জলীয় অংশের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে রক্তের আয়তন বেড়ে যায় এবং রক্তের আয়তন বেড়ে যাওয়া উচ্চরক্তচাপ হওয়ার অন্যতম কারণ এবং এর ফলে হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। তাই তরকারিতে প্রয়োজনীয় লবণের বাইরে অতিরিক্ত লবণ অবশ্যই পরিহার করতে হবে। খাবারের সাথে অতিরিক্ত লবণ আপনার হার্টের জন্য ক্ষতিকর, তাই এটা অবশ্যই পরিহার করতে হবে।

১৪। নিয়মিত আপনার স্বাস্থ্য নিরীক্ষণ করুন

হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ সকল কারণ সমূহের নিয়মিত পরীক্ষণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ৩ মাস, ৬ মাস অথবা ১ বছর পর পর পরীক্ষা করা যেতে পারে।  আপনাকে অবশ্যই আপনার রক্তে সুগারের মাত্রা, কোলেস্টেরলের মাত্রা এবং রক্তচাপের লেভেল সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। যদি এসবের কোন একটির মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায়, এসব নিয়ন্ত্রণের জন্য আপনাকে ঔষধ খেতে হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) হৃদরোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, ব্যায়াম করা এবং তামাক ত্যাগ করার পাশাপাশি রক্তচাপ, কোলেস্টেরল এবং রক্তের সুগার এসবের ঝুঁকির কারণ নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষনকেও গুরুত্ব দিয়েছে। আমেরিকান কলেজ অফ কার্ডিওলজির জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে জানা যায়, দৈনন্দিন জীবনে এইসকল পরিবর্তন হৃদরোগের ঝুঁকি ৮০% পর্যন্ত কমাতে পারে।

১৫। দৈনিক খাবারের তালিকা তৈরি করুন

আপনার খাবার তালিকায় কোন খাবারগুলি রাখতে হবে এবং কোন খাবারগুলি পরিহার করতে হবে তা আপনি ভালো জানেন। তাই এখনই সময় এসেছে আপনার পরিকল্পনা কার্যকর করুন। উপরে তালিকাভুক্ত খাবার গুলো থেকে দৈনিক মেনু তৈরি করুন। প্রতিবেলার খাবার অথবা হালকা নাস্তার জন্য খাবার নির্বাচন করার সময় অবশ্যই শাকসবজি, ফলমূল এবং সম্পূর্ণ শস্য জাতীয় খবার যেমন বার্লি, খই, গমের রুটি, ওটস, বাদামী চাল ইত্যাদির প্রতি জোর দিন। অসাস্বস্থ্যকর চর্বিযুক্ত প্রোটিন উৎস পরিহার করুন, স্বাস্থ্যকর চর্বি যোগ করুন এবং অতিরিক্ত লবণাক্ত খাবারকে সীমাবদ্ধ করুন। আপনি আপনার তালিকা তৈরি করার সময় প্রতিদিনকার পছন্দগুলিতে ভিন্নতা আনতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি এক বেলাতে শাকসবজি খান, তবে পরের বেলাতে মাছ রাখতে পারেন এবং সকালে গমের রুটি খেতে পারেন। খাবারে বিভিন্নতা আপনার খাবারকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। 

সবসময় মনে রাখবেন, সঠিক পরিকল্পনা ও কয়েকটি সহজ বিকল্পের সাহায্যে আপনি আপনার হার্টকে সুস্থ্য রাখতে পারবেন, নিজে সুস্থ্য থাকতে পারবেন। কারণ আগেই বলেছি “প্রতিকারের থেকে প্রতিরোধ উত্তম।”

Default user image

মোঃ ইকবাল হোসেন নয়ন, লেখক, আস্থা লাইফ

লিখতে পছন্দ করেন। সাধারণত তিনি তার কল্পনা থেকে কবিতা, রম্যরচনা এবং বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলি সম্পর্কে লেখালেখি করে থাকেন। তার পছন্দের একটি কাজ ব্লগে লেখা এবং অতীতে তার লেখা কিছু অনলাইন ভিত্তিক ম্যাগাজিনে প্রকাশ হয়েছে। তিনি এখন ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় এর ফার্মাসি বিভাগে স্নাতকোত্তর এ অধ্যয়নরত আছেন। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার স্নাতক শেষ করেছেন। ফার্মাসি বিভাগের শিক্ষার্থী হওয়ার কারণে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত লেখায় তাঁর আগ্রহ এখন প্রবল। তিনি অবসর সময়ে গান শুনতে এবং বই পড়তে পছন্দ করেন। সাধারণত লেখার প্রতি তাঁর আগ্রহ বই এবং ব্লগ পড়া থেকে আসে। তাঁর প্রিয় বইগুলির মধ্যে রয়েছে ভ্রমণকাহিনী, কিছু কবিতার বই এবং সায়েন্সফিকশন যা তাকে তাঁর কল্পনার জগতে প্রবেশ করতে সহায়তা করে। লেখালেখি করার জন্য তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হলো সোশ্যাল সাইটগুলি, যেখানে সে নিজের লেখা লিখতে পারে।

Related Articles