স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়িয়ে যেভাবে মাংস খাবেন
দুনিয়া জুড়ে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের ভেতর একটা সাধারণ প্রশ্ন হলো মাংস ভালো নাকি খারাপ? এই বিষয়ে প্রচুর গবেষণা পর্যবেক্ষনের পরেও কিছু পরষ্পর সাংঘর্ষিক ফলাফলের কারণে উত্তরটি আরো ঘোলাটে হয়েছে। তবে কিছু সার্বজনীন তথ্য সমূহের উপর নির্ভর করে মাংস খাওয়ার ব্যপারে কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। আসুন জেনে আসি কতটুকু মাংস খাবেন, কোন মাংস খাবেন, কোনটি বাদ দেবেন সহ আরো প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি।
বাঙালী ঘরে জন্মে হঠাৎ ভেজিটেরিয়ান বা নিরামিষভোজী হয়ে গেছে, এমন লোকের সংখ্য খুবই কম। ভোজন রসিক বাঙালীর কাছে মাংস যেন একটা আবেগের নাম। কিন্তু প্রায়ই শোনা যায়, মাংস খেলে নাকি অসংখ্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে। আবার আমরা মাংস কে পুষ্টিকর হিসেবেই জানি! তবে ব্যাপারটা কি?
এই কথা অনস্বীকার্য যে, মাংস হলো এই গ্রহের সবচেয়ে পুষ্টিকর খাবার। প্রোটিন, ফ্যাট, অ্যামিনো এসিড সহ উচ্চ পুষ্টিমান সমৃদ্ধ খাদ্য হলো মাংস। তবে সমস্যা হলো, মাংসের এই উচ্চ খাদ্যমানই প্রায় সময় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে অতারিক্ত লাল মাংস, যেমন গরু, খাশি, মহিষের মাংস গ্রহণে, ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তটাপ, হার্টের রোগ এমনকি ক্যান্সার হওয়ারো সম্ভাবনা থাকে। পর্যায়ক্রমে আমরা এসব স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমানোর উপায় জানব। চলুন আগে মাংসের উপকারীতা জানা যাক।
মাংস কেন উপকারী?
প্রয়োজনীয় অ্যামিনো এসিড
দেহ গঠনকারী কিছু অ্যামিনো এসিড শুধু মাংস থেকে পাওয়া যায়। তাই শরীরের বৃদ্ধি ও ক্ষয় পূরণের জন্য মাংসের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
উৎকৃষ্ট প্রোটিন
মাংস উৎকৃষ্ট প্রোটিনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস। প্রোটিন হলো সব ধরণের খাদ্য উপাদানের মধ্যে সবচেয়ে উপকারী।
ভিটামিন ও অন্যান্য পুষ্টিগুণ
মাংস বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেলে সমৃদ্ধ। এতে থাকে আয়রন, জিংক, ভিটামিন ডি, ভিটামিন কে, ভিটামিন বি ১২, ভিটামিন এ, ক্যালশিয়াম সহ অন্যান্য পুষ্টিগুণ। এই উপাদান গুলো শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয়, ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুধু প্রাণিজ খাবার থেকেই পাওয়া সম্ভব।
মাংসে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কোথায়?
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সপ্তাহে দুই দিন মাংস খান তাদের চাইতে দৈনিক মাংস খাওয়া মানুষদের অকালমৃত্যুের ঝুঁকি প্রায় ১৮% বেশি। চলুন মাংসের সাথে সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক।
ওজন বৃদ্ধি
মাংসের ক্ষতিকর দিক গুলো নিয়ে নানা লোকের নানা মত থাকলেও এটি যে ওজন বাড়াতে সাহায্য করে তাতে কারো দ্বীমত নেই। ওজন বৃদ্ধি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। অতিরিক্ত মোটা মানুষ প্রায়ই বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভোগেন।
তাছাড়াও ওজন বৃদ্ধিকে স্ট্রোক, উচ্চরক্তচাপ, ডায়বেটিস এর জননী বলা হয়। তাই শুধু ওজন নিয়ন্ত্রণ আপনাকে একগাদা ক্রোনিক ডিজিজ বা জটিল রোগ থেকে নিরাপদ রাখতে পারে। অতিরিক্ত মাংস খেলে ওজন নিয়ন্ত্রন প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে।
হার্টের রোগ
লাল মাংসে রয়েছে উচ্চ মাত্রার স্যাচুরেটেড ফ্যাট। স্যাচুরেটেড ফ্যাট শরীরে LDL নামক ক্ষতিকর কোলেস্টেরল বাড়িয়ে তোলে যা হার্ট ব্লকের মত সমস্যা তৈরি করে থাকে।
উচ্চরক্তচাপ
অনেকের ক্ষেত্রে মাংস খাওয়ার পর রক্তে কিছু উপাদান মিশে যায় যা রক্ত চাপ বাড়িয়ে তোলে। কারো কারো ক্ষেত্রে এই সমস্যা অত্যাধিক বেড়ে যায় এবং সঠিক ও সময়মত চিকিৎসার অভাবে স্ট্রোকও হতে পারে।
ডায়বেটিস
ডায়বেটিস হলো শরীরের এমন একটি রোগ যাতে শরীরে গ্রহণ করা চিনি ভাঙার জন্য প্রয়োজনীয় ইনসুলিন তৈরি হয় না। অতিরিক্ত শর্করা শুধু নয়, রেড মিটও ডায়বেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে অনেকগুন। যুক্তরাষ্ট্রের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা প্রতি দুই দিনে অন্তত একবার করে মাংস খান, তাদের টাইপ ২ ডায়বেটিস হবার সম্ভাবনা প্রায় ৪৮ ভাগ বেশি।
ক্যান্সার
লাল মাংস খাওয়ার ফলে বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার হতে পারে, যার ভেতর কোলন ক্যান্সার সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। এটির প্রকোপ এতোই বেশি যে, প্রায় শতকরা ৪% মানুষকে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়।
বিভিন্ন রকম মাংসের উপকারীতা ও ঝুঁকিসমূহ
মাংস নিয়ে যখন কথা উঠছে, তখন চলুন জেনে আসা যায় কয়েক ধরণের মাংসের প্রকারভেদ ও তা কতটুকু খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত।
মাছ
মাংসের ভেতর মাছে হলো সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিমুক্ত। আপনি যে কোন ধরণের মাছ যত ইচ্ছা তত খেতে পারেন কোন রকম স্বাস্থ্যগত ঝুকি না বাড়িয়েই। বরং মাছে অবস্থিত প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ দেহ গঠনে দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করে।
অবশ্য বর্তমানে, চাষের মাছে কম সময়ে উচ্চ লাভের জন্য হরমোন ফিড, ও এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার বেড়েছে। এর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি সংক্রান্ত আরও গবেষণা প্রয়োজন, কিন্তু পুষ্টির দিক বিবেচনায় হাইব্রিড পদ্ধতিতে চাষের চাইতে প্রাকৃতিক ও প্রাকৃতিক ভাবে চাষের মাছ বেশি স্বাস্থ্যকর।
সাদা মাংস
সাদা মাংসের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার পাখির মাংস অন্তর্গত। আর এর ভেতর আমরা বেশিরভাগ সময়ই মুরগী, হাঁস, কোয়েল ইত্যাদি খেয়ে থাকি। লাল মাংসের চেয়ে সাদা মাংসে ঝুঁকি অনেকাংশেই কম। তবে, অতিরিক্ত খেলে স্থুলতা জনিত সমস্যা তো থাকেই। মাছের মত ফার্মের মুরগীর দেহেও উচ্চ পরিমানে এন্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতু থাকে যা ক্যান্সার সৃষ্টির অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত।
লাল মাংস
লাল মাংস পুষ্টি উপাদানে সবচেয়ে এগিয়ে থাকলেও, বিপদের ঝুঁকিও বেশি। তবে, পরিমিত ভাবে, বেছে বেছে ও সঠিক পদ্ধতিতে লাল মাংস খেলে রোগের ঝুঁকি অনেকাংশেই কমিয়ে আনা যায়।
এই ব্যপারে সব গবেষকেরা নিশ্চিৎ যে, উৎপাদিত মাংসের চেয়ে অর্গানিক উপায়ে চাষ করা সবুজ ঘাস খেয়ে বড় হওয়া পশুর মাংস প্রায় দ্বিগুন কম ক্ষতিকর। চর্বি বেছে পরিমিত প্রাকৃতিক ভাবে লালিত পশুর মাংসে ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে না ও কোলেস্টেরলের মাত্রাও থাকে সহনীয় পরিমাণে।
শহুরে জীবনে যদিও বেছে মাংস কেনা বেশ কষ্টকর। আপনি চেষ্টা করলে কোরবানীর সময় প্রাকৃতিক ভাবে পালিত পশু কিনতে পারেন। এটি স্বাস্থ্যগত দিকে বেশ ভালো প্রভাব রাখতে পারে যেহেতু আমাদের মাংস গ্রহণের বেশিরভাগ অংশ কোরবানীর ঈদকে কেন্দ্র করে।
মাংস ও এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স
এন্টিবায়োটিক মাংস শিল্পের একটি অতি প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য। কিন্তু অতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক পশুর দেহে থেকে যেতে পারে ও তা খাদ্যের মাধ্যমে আমাদের শরীরে চলে আসতে পারে। যার মাধ্যমে এমন ব্যাক্টেরিয়ার সযক্রমন হতে পারে যা কোন এন্টিবায়োটিকের প্রতি সংবেদনশীল নয়। বর্তমান বিশ্বে এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স স্বাস্থ্যখাতের সবচেয়ে বড় উৎকন্ঠার নাম।
সঠিক উপায়ে মাংস নাড়াচাড়া করা ও পর্যাপ্ত তাপের সাথে মাংস রান্না করা এই ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারে।
কতটুকু মাংস খাওয়া নিরাপদ?
কতটুকু মাংস খাওয়া নিরাপদ, সেটা নির্ভররকরে আপনার বয়স, শারিরীক অবস্থা ইত্যদির উপর। ত্রিশ এর পর থেকেই খাওয়া-দাওয়া, বিশেষ করে মাংসটা একটু বুঝে শুনে খাওয়া উচিৎ। যদিও ত্রিশের দিকে শারিরীক সমস্যা গুলো প্রকট ভাবে দেখা দেয় না। তবু চল্লিশ এমনকি পঞ্চাশ এর পরও সুস্থ্য থাকার জন্য ত্রিশের সময় থেকেই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস গড়ে তোলা প্রয়োজন।
সপ্তাহে ৩ দিনের অধিকবার মাংস খাওয়া উচিৎ না এবং সেই মাংসের পরিমান যেন ৩৫০-৫০০ গ্রামের ভেতর থাকে।
কোন ধরণের মাংস নিরাপদ?
মাংস থেকে চর্বি বাদ দিয়ে খাওয়া প্রায় অসম্ভবই বটে। তবে যেটুকু সম্ভব চর্বি বাদ দিয়ে সলিড মাংস খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এতে করে, শরীরে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা অনেকাংসেই নিযন্ত্রণ করা যায়।
পশু কেনার সময় খুব মোটাসোটা পশুর চেয়ে সুঠাম দেহের পশু কিনুুন। স্বাস্থ্য বিবেচনায়, প্রাকৃতিক খাবার দিয়ে যে পশু পালন করা হয় তাতে ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কম।
যেসব সমস্যায় মাংস খাবেন না
যাদের লাল মাংসে এলার্জি রয়েছে তারা স্বাভাবিক ভাবেই মাংস খেতে পারেন না। মাংস না খাওয়ার ব্যপারে সরাসরি কিছু বলাও মানবিক দৃষ্টিতে একটু জটিল। তবু এটুকু বলা যেতে পারে, ডায়াবেটিস, লিভার জটিলতা, এ্যাজমা, কোলন ক্যান্সার, পরিপাকে গোলযোগ সংক্রান্ত কোন রোগ থেকে থাকলে মাংস খাওয়ার ব্যাপারে অতি অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
শেষ কথা
মাংস আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় হলেও, খুব বেশি রেট মিট গ্রহণ অকাল মৃত্যুর কারণ হতে পারে। একটু সংযমের সাথে কিছু দিন পর পর মাংস খেলে ও যতটুকু সম্ভব চর্বি ও অতিরিক্ত রান্না এড়িয়ে মাংস খেলে লাল মাংসে স্বাস্থ্যহানি একদম কমিয়ে আনা সম্ভব।