সুস্বাস্থ্যে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর সম্পর্ক কী?

টিভিতে দুধের বিজ্ঞাপন আর আর অন্যান্য স্বাস্থ্য বিষয়ক শো গুলোর বদৌলতে প্রায় সব মানুষ জানেন ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি মানব স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এরা কিভাবে কাজ করে, কিভাবে উৎপন্ন হয় সেই গল্পটা জানলে মানব শরীরের লোমহর্ষক নিপুণতার উপর বিস্ময় জাগে। চলুন ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম সম্পর্কে স্কুলের বায়োলোজি বই এর মত সহজ কিছু তথ্য জানা যাক।

ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম দুটোই আমাদের শরীরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানের অন্তর্গত। ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম দুটো উপাদানই আলাদা আলাদা ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এই দুটো উপাদানের ভেতরকার সম্পর্ক মানব শরীরে কিছু অত্যন্ত জরুরি কাজ সম্পাদন করে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই দিকটি এড়িয়ে যাওয়া হয়। এই প্রবন্ধটি পড়লে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর অভাব সহজেই ধরতে পারা যাবে ও সেই থেকে হওয়া শারিরীক সমস্যাগুলোও বুঝে ফেলা যাবে ঝটপট। যদিও বিষয়টা একটু গভীর, তবু গল্পচ্ছলে পড়লে আনন্দদায়কই হবার কথা। তবে চলুন শুরু করা যাক।

ভিটামিন ডি কি?

ভিটামিন ডি হলো একটি চর্বিতে দ্রবনীয় পুষ্টি উপাদান যা মানব শরীরে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফেট শোষণে সাহায্য সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শরীরবৃত্তিয় কাজে সহয়তা করে। ভিটামিন ডি খাবার ও সূর্যের আলো থেকে পাওয়া যায়। সকাল দশটা থেকে তিনটা পর্যন্ত রোদ, দশ থেকে পনেরো মিনিট পোহালে শরীরে যথেষ্ট ভিটামিন ডি উৎপন্ন হয়।

ভিটামিন ডি এর স্বল্পতা হলে কি হয়?

ভিটামিন ডি এর স্বল্পতা দেখা দিলে নিন্মক্ত উপসর্গ গুলো দেখা দেয়-

  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া।

  • অবসাদ ও ক্লান্তি ভাব।

  • ব্যাক পেইন ও হাড়ে ব্যথা হওয়া।

  • ডিপ্রেশন।

  • ক্ষত শুকাতে দেরী হওয়া।

  • হাড় ক্ষয় হওয়া।

  • চুল পড়া।

  • পেশিতে ব্যাথা ইত্যাদি।

ভিটামিন ডি স্বল্পতা বোঝার উপায় আরো জানতে পড়ুন, ভিটামিন ডি-এর অভাবে যে ১২ টি লক্ষন দেখা দিতে পারে

ভিটামিন ডি থাকে যেসব খাদ্যে

ভিটামিন ডি খুব বেশি প্রকার খাদ্যে পাওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের ত্বকে অবস্থিত কোষ সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে ভিটামিন ডি প্রস্তুত করে। ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার-

  • তেল সমৃদ্ধ মাছ।

  • কলিজা।

  • লাল মাংস।

  • ডিমের কুসুম ইত্যাদি।

এবার আসুন ক্যালসিয়াম সম্পর্কে সাধারণ ধারণা নেওয়া যাক।

ক্যালসিয়াম কি?

ক্যালসিয়াম একটি ইলোক্ট্রলাইট যা দাঁত, হাড় ও বিভিন্ন শরীরবৃত্তিয় কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শরীরের ৯৯ ভাগ ক্যালসিয়াম আমাদের হাড়ে থাকে অর্থাৎ আমাদের কংকালতন্ত্র মূলত ক্যালসিয়াম দিয়ে তৈরি। বাকী এক ভাগ ক্যালসিয়াম থাকে আমাদের রক্তরস ও পেশিতে।

ক্যালসিয়াম স্বল্পতার লক্ষণ 

ক্যালসিয়াম স্বল্পতার কারণে নিন্মক্ত সমস্যা গুলো দেখা দিতে পারে।

  • শরীরে অসাড় ভাব

  • অস্থি ও আঙ্গুলের জয়েন্ট কশে আসা

  • মাসল ক্রামপস বা পেশিতে টান লাগা

  • খাবারে অরূচি

  • দুর্বল ও ভঙ্গুর নখ

  • খাবার বা পানীয় গিলতে সমস্যা হওয়া ইত্যাদি।

ক্যালসিয়ামের এর উৎস

ক্যালসিয়াম এমন একটি উপাদান যা সাধারণত শাকসবজি থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরণের খাবারে সামান্য হলেও অবস্থান করে। যদিও বেশিরভাগ খাবারই ক্যালসিয়ামের ভালো উৎস না।

শিশুদের বেড়ে ওঠা, নারীদের গর্ভাবস্থা ও বয়স্কদের জন্য ক্যালসিয়ামের গুরুত্ব অভাবনীয়। শিশুদের হাড় গঠনে প্রচুর ক্যালসিয়াম লাগে। অন্যদিকে নারীদের সন্তান জন্মদানকালে প্রচুর পরিমান ক্যালসিয়াম প্রয়োজন পড়ে। আর বয়স্কদের হাড় খুব দ্রুত ক্ষয় হয়ে যেতে থাকে তাই তাদের হাড়ের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে, সাধারণের চেয়ে বেশি ক্যালসিয়াম প্রয়োজন হয়।

তাই এই সময়গুলোতে খুব বেশি বেশি ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার গ্রহণ অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমস্যাটি হচ্ছে ক্যালসিয়াম শরীরে ঠিকভাবে শোষিত হতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে হয়, যার জন্য ভিটামিন ডি অত্যাবশ্যক। পরবর্তি অংশে ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়ামের সম্পর্কটি জানার আগে, ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার সম্পর্কে জানা যাক।

  • দুধ

  • পনির

  • দুগ্ধজাত খাদ্য

  • সয়াবিন

  • বাদাম

  • মাংস ও

  • বড় মাছে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকে।

মানব শরীরে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি শোষণ ও এদের সম্পর্ক

মানব শরীরে যেকোন পুষ্টি উপাদন গ্রহণ করলেই তা মানব শরীরের কাজে লাগবে এমন নয়। তা হওয়ার জন্য প্রয়োজন সঠিক ভাবে সে পুষ্টি উপাদান শোষিত হওয়া প্রয়োজন। 

একই ভাবে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি-র ও শরীরে শেষিত হওয়ার নির্দিষ্ট কার্যপদ্ধতি রয়েছে। ভিটামিনন ডি ক্যালসিয়াম তৈরি করতে প্রত্যক্ষ ভাবে সাহায্য করে। ঠিক এখানেই ক্যালসিয়ামের শোষণের পেছনে ভিটামিন ডি এর ভূমিকা রয়েছে। চলুন ধাপে ধাপে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করা যাক। বিষয়টি বুঝতে পারলে আমাদের শরীরে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর কার্যকলাপ বুঝতে পারব, যার ফলে শুষ্ঠভাবে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ ও উপাদান গুলোর অভাব মেটানো সহজ হবে।

ভিটামিন ডি শোষণ পদ্ধতি

খাদ্য বা সূর্যের আলো থেকে পাওয়া ভিটামিন ডি বিভিন্ন ধাপে পরিবর্তিত হয়ে তা শরীরবৃত্তিয় বিভিন্ন কাজে সহায়তা করে। ভিটামিন ডি এর কার্যকরী উপাদানটির নাম হলো cholecalciferol. 

এই উপাদানটি শুরুতেই শোষণ উপযোগী নয়। প্রথমে উপাদানটি লিভারে গিয়ে Calcifediol এ পরিবর্তিত হয়। 

Calcifediol এরপর কিডনীতে প্রবেশ করে calcitriol এ রূপান্তরিত হয়, যা শরীরবৃত্তিয় বিভিন্ন কাজে ব্যাবহার হতে পারে। 

অর্থাৎ আমরা জানলাম যে ভিটামিন ডি সুষ্ঠভাবে শোষণের জন্য সুস্থ্য যকৃত ও কিডনী প্রয়োজন।

ক্যালসিয়াম শোষণ পদ্ধতি

ক্যালসিয়াম আমাদের রক্তে শোষিত হয় আমাদের ক্ষুদ্রান্তে। যেটি শোষণ করতে শরীরের শক্তি ব্যায় করতে হয়। Calicitrol কিডনী থেকে উৎপন্ন হয়ে ক্ষুদ্রান্তে চলে আসে ও ক্যালসিয়ামকে আরো দ্রবনীয় করে তুলতে সাহায্য করে, যা ক্যালসিয়াম শোষণের একটি অতি প্রয়োজনীয় ধাপ।

অর্থাৎ পর্যাপ্ত পরিমান ক্যালসিয়াম শোষিত হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন ডি গ্রহন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। তা না হলে ক্যালসিয়াম শোষিত না হয়েই দেহ থেকে বের হয়ে যায়। 

আমাদের দেহে ভিটামিন ডি এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামের মত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান শোষণে সাহায্য করা।

ক্যালসিয়ামের অভাবে কিভাবে হাড় ক্ষয়গ্রস্থ হয়?

পূর্বে উল্লেখ করেছি, আমাদের শরীরের হাড়ে ৯৯% ক্যালসিয়াম সঞ্চিত থাকে, ও রক্তরসে ১%. কিন্তু শরীরে যখন ক্যালসিয়ামের ঘাঢতি দেখা দিতে থাকে তখন, শরীর হাড়ে সঞ্চিত ক্যালসিয়াম রক্তে প্রবেশ করে, যার ফলে হাড় দুর্বল ও ক্ষয়গ্রস্থ হয়ে পড়ে। যেহেতু ভিটামিন ডি এর অভাবে ক্যালসিয়াম শোষিত হতে পারে না, অর্থাৎ ক্যালসিয়াম ঠিকভাবে শোষিত হতে ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়াও অতি গুরুত্বপূর্ণ।

ক্যালসিয়াম শোষণ ত্বরান্তিত করে যে যে উপাদান

নিচের উপাদান গুলো শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণ বাড়িয়ে তোলে।

Calcitriol

এটি ভিটটামিন ডি হতে কিডনীতে উৎপন্ন হয় ও ক্যালসিয়ামকে দ্রবীভূত করে গ্রহণ উপযোগী করে তোলে। ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খেলেই Calcitriol এর আধিক্য বাড়ে।

Lysine এবং Arginine

লাইসিন ও আর্জিনিন দুটোই এমিনো এসিড যা ক্যালসিয়ামের শোষণ বাড়িয়ে তোলে। 

লাল মাংস, মুরগী, কাকড়া, চিংড়ি, মাছ ও দুধে প্রচুর পরিমাণ লাইসিন থাকে।

অন্যদিকে মাছ, মাংস, বাদাম, লাল আটা ও দুধে প্রচুর পরিমাণে আর্জিনিন পাওয়া যায়।

এসিড জাতীয় খাবার

এসিড জাতীয় খাবার ক্ষুদ্রান্তের এসিডিটি বাড়িয়ে তোলে যা ক্যালসিয়াম শোষণের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে। অতএব লেবু বা টক জাতীয় খাবার ক্যালসিয়াম শোষণের জন্য ভালো। এজন্যই প্রসূতি মায়েদের অধিক টক জাতীয় খাবার খাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।

ক্যালসিয়াম শোষণ কমায় যে উপাদানগুলি

নিচের উপাদান বা খাবার গুলো ক্যালসিয়াম শোষণে বাধা প্রদান করে। তাই অধিক পরিমাণে এসব খাবার গ্রহণ করা ক্যালসিয়ামের ঘাঢ়তি তৈরি করতে পারে।

অক্সালেটস

অক্সালেট ক্যালসিয়ামের সাথে যুক্ত হয়ে ক্যালসিয়াম অক্সালেট তৈরি করে যা আমাদের শরীর শোষণ করতে পারে না। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম গ্রহণ করার পরও যদি শরীরে অক্সালেটের পরিমাণ বেড়ে যায় তবে ক্যালসিয়ামের ঘাঢ়তি দেখা দিতে পারে। 

অক্সালেট যুক্ত খাবার গুলো হলো- আলু, পালংশাক, গমের ভুষি, বাদাম, চা, বিট, টমেটো ও স্ট্রবেরি।

ফসফেট

দৈনন্দিন খাবারে যদি ক্যালসিয়ামের চেয়ে ফসফেটের পরিমাণ বেড়ে যায় তবে তা ক্যালসিয়াম ফসফেট তৈরি করে ও দীর্ঘদিন হলে ক্যালসিয়াম ঘাঢ়তির কারণ হতে পারে। খাবারে ক্যালসিয়াম ও ফসফেটের অনুপাত হওয়া উচিৎ ১:২ থেকে ২:১ পর্যন্ত।

সংক্ষেপে যা জানলাম

  • ভিটামিন ডি কার্যকারী হতে যকৃত ও কিডনীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

  • ভিটামিন ডি ক্যালসিয়াম শোষণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে।

  • শুধু ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট বা সাপ্লিমেন্টে ঘাঢ়তি পূরণ হবে না যদি না যথেষ্ট ভিটামিন ডি গ্রহণ করা না যায়।

  • প্রটিন জাতীয় খাদ্য ভিটামিন ডি এর উৎস 

  • এসিড সমৃদ্ধ খাবার ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে

  • অক্সালেট ও ফসফরাস সমৃদ্ধ খাবার ক্যালসিয়াম শোষণ বাধাগ্রস্থ করে।

শেষ কথা

জীবনভর আপনি কতটুকু সঠিকভাবে ক্যালসিয়াম গ্রহণ করেছিলেন তার উপর নির্ভর করবে বাধ্যক্যে আপনি কতটুকু স্বাচ্ছন্দে চলাচল ও জীবনযাপন করতে পারছেন। তাই ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি কোনটিকেই অবহেলা নয়।

আরও পড়ুনঃ

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles