ল্যাকটিন মুক্ত ডায়েট - পর্ব ২: আপনার স্বাস্থ্যের জন্য এটি ভালো না খারাপ?

সম্প্রতি বিশ্বে ল্যাকটিন ফ্রি ডায়েট স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের মাঝে এক বিশেষ আলোড়ন তৈরি করেছে। এ বিষয়ক একটি প্রবন্ধ আমাদের সাইটে পূর্বে প্রকাশিত হয়েছে। তবে, পূর্বের প্রবন্ধটিতে এই তত্ত্বের উদ্ভাবকদের ভাষ্যমত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য চিকিৎসাবিজ্ঞানী এই তত্ত্বটি কিভাবে দেখছেন সেই সঙ্গে ল্যাকটিন তত্ত্বের খুঁত, সত্যতা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে এই বিশ্লেষনাত্বক প্রবন্ধ।

ল্যাকটিন মুক্ত ডায়েট - পর্ব ১ঃ খাদ্যাভাসের নতুন তত্ত্ব

ল্যাকটিন হলো এক প্রকার উদ্ভিজ্জ প্রোটিন যা আমাদের খাদ্যাভ্যাসের একটি বড় অংশ জুড়ে বিদ্যমান। ল্যাকটিন বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে এবং এর ক্ষতিকর দিকেরর সাথে কিছু উপকারী দিকও বিদ্যমান। যদিও কিছু গবেষক দাবি করেন ল্যাকটিন বিহীন খাদ্যাভাস আমাদের স্বাস্থ্যের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করতে পারে। যদিও বর্তমান বিজ্ঞান মতে এই পদ্ধতিটি সন্দেহাতীত নয়। চলুন প্রথমে ল্যাকটিন তত্ত্ব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ভাবে জানা যাক। পরবর্তীতে এ তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানব।  

ল্যাকটিন তত্ত্ব কি বলে?

ল্যাকটিন তত্ত্বের উদ্ভাবক হচ্ছেন প্রফেসর গান্ড্রি, যিনি একজন আমেরিকান চিকিৎসা গবেষক ও উদ্ভাবক। তার গবেষণা মতে, ল্যাকটিন হলো এক প্রকার উদ্ভিজ্জ প্রোটিন যা আমাদের জন্য অত্যান্ত ক্ষতিকর ও প্রাত্যহিক অসুখ-বিসুখ যেমন ওজন বেড়ে যাওয়া, দুর্বলতা, অনিদ্রা, পেটে সমস্যা, এলার্জি, চর্মরোগ ইত্যাদির জন্য দায়ী। সেই সাথে ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ ও হার্টের রোগের মত জটিল রোগের সাথে ল্যাকটিনে যোগসূত্র রয়েছে। যদিও অনেক আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানী তার উদ্ভাবনকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে না ও এই বিষয়ে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন বলে ধারনা করেন। প্রফেসর গান্ড্রির মতে, ল্যাকটিন জাতীয় খাবার বর্জন ও বিউটারেট জাতীয় খাবার গ্রহনই হতে পারে সুস্বাস্থ্যের সাথে দীর্ঘজীবনের মূল চাবিকাঠি। 

ল্যাকটিন তত্ত্ব মতে ল্যাকটিন ও বিউটারেট এর কার্যপদ্ধতি

প্রফেসর গান্ড্রির মতে, ল্যাকটিন আমাদের খাদ্যের পুষ্টি শোষণ ত্রুটিপূর্ণ করে তোলে, যার কারণে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা তৈরি করে। আমাদের খাদ্যের পুষ্টি উপাদান শোষিত হয় আমাদের অন্ত্রে। তত্ত্ব মতে, ল্যাকটিন আমাদের অন্ত্রের পাতলা পর্দায় ক্ষত সৃষ্টি করে। এই ক্ষত আমাদের দেহের খাদ্য শোষণ ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ করে তোলে। খাদ্যের পুষ্টি শোষণের সময় এই ছিদ্র যেমন পুষ্টি উপাদান শোষনে বাধা দেয়, সেই সাথে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মলের কনা বা বর্জ্য আমাদের রক্তের সাথে মিশে যায়। রক্ত এই বর্জ্য সারা দেহে ছড়িয়ে দেয় ও বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে। নিয়মিত 

ল্যাকটিন জাতীয় খাদ্য গ্রহণ ছেটো-খাটো শারিরীক সমস্যা থেকে শুরু করে, ক্যান্সার উচ্চ রক্তচাপ এর মত জটিল রোগের ঝুঁকি বহুগুন বাড়িয়ে দেয়। নিন্মক্ত খাদ্য গুলোতে প্রচুর পরিমাণে ল্যাকটিন উপস্থিত থাকে,

  • শিম, ও বাদাম জাতীয় খাদ্য যেমন চিনা বাদাম, মটরশুটি, শিম, ডাল। 

  • মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া ও কুমড়া শাক।

  •  টমেটো, আলু, বেগুন, ক্যাপসিকাম

  • কামরাঙা, স্ট্রবেরি, আনারস, শসা।

  • শস্য জাতীয় খাবার যেমন গম, ভু্টা, লাল চাল, সরিষা।

  • ল্যাকটিন সমৃদ্ধ খাবার খায় এমন পশুর মাংশ ও দুধ।

ল্যাকটিন তত্ত্ব এই সমস্যা গুলো থেকে নিস্তারের পথ বলে দেয়। বিউটারেট নামক একটি উপাদান অন্ত্রের ক্ষত সাররিয়ে তোলে ও অন্ত্রে একটি রক্ষাকারী পর্দার সৃষ্টি করে। বিউটারেট হলো এক প্রকার এন্টিঅক্সিডেন্ট যার কাজ হলো দেহের কোষগুলো সতেজ রাখা। তাছাড়াও ল্যাকটিন তত্ত্ব বিউটারেটকে অত্যান্ত উপকারী ও প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে ব্যাখ্যা করে। 

বিউটারেট উৎপন্ন হয়, অন্ত্রে উপকারী ব্যাক্টেরিয়ার উপস্থিতি থেকে। কিছু খাবার অন্ত্রে উপকারী ব্যাক্টেরিয়াকে পুষ্টি যুগিয়ে তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি, তথা বিউটারেট উৎপন্ন হতে সাহায্য করে। খাদ্য গুলো হলো,

  • রসুন

  • পেঁয়াজ

  • লাল আটা

  • ওটস

  • বার্লি

  • এসপারাগাস

  • কলা

  • নারকেল

ল্যাকটিন তত্ত্বের মূল কথা হলো, ল্যাকটিন সমৃদ্ধ খাবার সম্পুর্ণ বর্জন, ও পর্যাপ্ত বিউটারেট গ্রহণ করলে, আপনি ১০ বছর কম বয়সী অনুভব করবেন, ছোটখাটো সকল স্বাস্থ্য সমস্যা নিমেষে দূর হবে ও দীর্ঘজীবন লাভ করবেন ইত্যাদি। যদিও অনেক চিকিৎসা বিজ্ঞানী এ তত্বের সাথে একমত নন। 

ল্যাকটিন তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা

ল্যাকটিন তত্ত্ব বিজ্ঞান সম্পন্ন ধারণা প্রকাশ করে যদিও এটির কোন স্পষ্ট প্রমান নেই। অসংখ্য মানুষ এমনকি ড. গান্ড্রিও এই পদ্ধতিতে উপকার পেয়েছেন বলে দাবী করলেও, অন্যান্য বিশেষজ্ঞেরা এটির সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করেন। ল্যাকটিন তত্ত্বের সীমাবদ্ধতাগুলো নিন্মরূপ-

১) ল্যাকটিন তত্ত্ব ঢালাও ভাবে সকল প্রকার ল্যাকটিনকে ক্ষতিকর বলের প্রচার করে। যদিও ল্যাকটিনের কিছু উপকারী দিকও রয়েছে। ল্যাকটিন এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। পরিমিত ল্যাকটিন কার্ববোহাইড্রেট এর শোষণ কমিয়ে দেয় যা রক্তে দ্রুত চিনির মাত্রা বেড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। পরিমিত পরিমান ল্যাকটিন অন্ত্রে ক্যান্সার সেল ধ্বংস করতে সাহায্য করে।

২) ল্যাকটিন তত্ত্ব ল্যাকটিনের প্রকারভেদ বিশ্লেষণ করে না। কিছু ল্যাকটিন মানুষের দেহে কোন প্রভাবই রাখে না, কিছু ল্যাকটিনের উপকারী দিক রয়েছে এবং কিছু ল্যাকটিন স্বাস্থ্যের জন্য অত্যান্ত ক্ষতকর, এক কথায় বিষাক্ত হয়ে থাকে।

৩) ল্যাকটিন সেইসব মানুষের ক্ষেত্রে বেশি সমস্যা সৃষ্টি করে, যাদের স্পর্শকাতর অন্ত্র রয়েছে। সেক্ষেত্রে কারো কোন খাবারে সমস্যা থাকলে সে নিজে থেকেই টের পাবে ঠিক কোন খাবারের জন্য সে অসুস্থ বোধ করছে। সাধারণত খাবার পর যদি কোন সমস্যা না হয় তাহলে আদৌতে কোন সমস্যা হচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞদের মত।

৪) ল্যাকটিন তত্ত্ব খাবারের ল্যাকটিনেরর ক্ষতিকর দিক ব্যাখ্যা করে এবং ল্যাকটিন জাতীয় খাদ্য বর্জন করতে বলে। অথচ কিছু বিশেষজ্ঞের মতে ল্যাকটিন জাতীয় খাদ্যের ল্যাকটিন প্রায় ৮০-৯৫ শতাংশ দূর করা যায় সঠিক পদ্ধতিতে রান্নার করে। যার ফলে আমাদের শরীরে খুবই স্বাস্থ্যকর মাত্রার ল্যাকটিন প্রবেশ করে, যা মোটেও ঝুঁকিপূর্ণ নয়। ২০-৩০ মিনিট উচ্চতাপে রান্না করলে খাদ্যের ৯০ শতাংশ ল্যাকটিন দূর হয়ে যায়। অতিরিক্ত ল্যাকটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন শিম, আস্ত গম, কাচা সয়াবিন প্রেশার কুক করে ল্যাকটিন দূর করা যায়।

যদিও সীমাবদ্ধতা আছে তারপরো ল্যাকটিন তত্ত্বের মূল বিষয়গুলো মিথ্যা নয়। ল্যাকটিন আসলে খাদ্যের পুষ্টি শোষণ এর ব্যাঘাত ঘটিয়ে থাকে। সেন্সিটিভ অন্ত্রের কারো গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারন হতে পারে ল্যাকটিন। স্বাস্থ্য সচেতনতার নামে কাচা সবজি সালাদ হিসেবে খাওয়ার প্রচলন বেশ আগে থেকেই। তবে সঠিক জ্ঞান ছাড়া এই এরকম অভ্যাস খুবই বিপদজ্জনক হতে পারে। কারন ল্যাকটিন সমৃদ্ধ কাচা সবজিতে ৮০-৯০ গুন বেশি ল্যাকটিন থাকে। অতিরিক্ত ল্যাকটিন আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারীতাও কমিয়ে দেয় বলে প্রমানিত। এখন মূল প্রশ্নে আসা যাক।

দৈনন্দিন জীবনে ল্যাকটিন তত্ত্ব কি কতটুকু কার্যকর? 

কার্যকারীতা বিশ্লেষণ এর জন্য ল্যাকটিন তত্ত্বের একটি প্রধান সীমাবদ্ধতা পূর্বে উল্লেখ করিনি। তা হলো পুষ্টি স্বল্পতার ঝুঁকি। আমাদের খাদ্যাভাসের ৩০ শতাংশ খাবারে কম-বেশি ল্যাকটিন উপস্থিত। একটি গবেষণায় দেখা গেছে ল্যাকটিন সমৃদ্ধ খাবার বর্জন করলে ভিটামিন এ, বি কমপ্লেক্স, সি ও উপকারী উদ্ভিজ্জ প্রটিন এর উৎস বেশ কমে যায়। যার ফলে বিভিন্ন পুষ্টিহীনতা ও রোগব্যাধি হবার সম্ভাবনা থাকে। ল্যাকটিন সমৃদ্ধ খাবারগুলো সাধারনত উচ্চ আঁশযুক্ত হয়ে থাকে, ল্যাকটিন বাদে খাবার গ্রহণের ফলে যদি আঁশযুক্ত খাবারের ঘাঢতি হয়ে থাকে তার ফলাফল গিয়ে দাঁড়ায় কোষ্ঠকাঠিন্যে। 

উপর্যপরি, দৈনন্দিন ব্যস্ত জীবনে এ ধরনের ডায়েট প্লান মেনে চলা রীতিমত কঠিন সাধ্য। নিশ্চই বুঝতে পারছেন, এই তত্ত্বের পক্ষে বিপক্ষে বিভিন্ন সুবিধা অসুবিধা রয়েছে। তাহলে চলুন একটু স্বারমর্মের সাথে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যাক।

আপনার কি করনীয়?

ল্যাকটিন তত্ত্ব যেমন সম্পুর্ণ ভাবে প্রমানিত নয়, তেমনি ভুল প্রমাণের জন্য যথেষ্ট গবেষণা এখনো হয়নি। ল্যাকটিন এর ক্ষতিকর প্রভাব যদিও প্রমাণিত। তারপরও খাদ্য থেকে ল্যাকটিন বাদ দেওয়ার ফলাফল এখনো অনুমান নির্ভর। পুষ্টির চাহিদা ঠিক রেখে ল্যাকটিন তত্ত্ব অনুসরনের তেমন কোন খারাপ প্রভাব নেই। আপনি চাইলে স্বাস্থ্যকর জীবনের প্রত্যাশায় ল্যাকটিন তত্ত্ব অনুস্বরন করতে পারেন। আবার যদি আগ্রহী না হন, অন্তত সঠিক উপায়ে রান্না করা খাবার খেলে ল্যাকটিন নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles