রোজায় হৃদরোগীদের ডায়েট যেমন হওয়া উচিৎ

একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের খাদ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং একজন হার্টের রোগীর খাদ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া একটু ভিন্ন। হার্টের সমস্যা যাদের রয়েছে তাদের খাদ্য গ্রহণে বেশ সচেতন থাকতে হবে। রোজা রাখার কারণে রক্তে অতিরিক্ত ফ্যাট কমে যায় যা হার্টের রোগীর জন্য বেশ উপকারী।

রমজান মাস আত্মশুদ্ধির মাস, পরিবর্তনের মাস, সংযমের মাস। সমগ্র মুসলিম উম্মাহ'র কাছে এই মাস বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য উত্তম মাস রমজান মাস। সকল প্রকার বদঅভ্যাস ও খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা ও পরিশুদ্ধ করার উত্তম সময় মাহে রমজান। নিজের চরিত্রকে পরিবর্তন করার পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন আনতে হবে। অস্বাস্থ্যকর খাবারে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে, শরীরে নানা রকমের সমস্যা দেখা দেয়, ফলে ইবাদত করতেও অসুবিধা হয়। তাই নিয়ম মেনে সঠিক ও পরিমিত খাবারের অভ্যাস গড়ে তোলাই উত্তম। 

প্রতিনিয়ত হার্টের রোগের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। হার্টের রোগীরা নানা ধরনের সমস্যায় ভুগে থাকেন। তবে নিয়মতান্ত্রিক জীবন, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাসের কারণে হার্টের রোগীরাও সুন্দর ভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন এবং রমজান পালন করতে পারবেন। 

সেহেরিতে যে খাবারগুলো খাওয়া যেতে পারে

ভাত

ভাতকে যথাসম্ভব নরম করে খেতে হবে। 

শাকসবজি

হার্টের রোগীদের খাদ্য তালিকায় আঁশ জাতীয় খাদ্য থাকা জরুরি যা বিভিন্ন প্রকার সবজিতে পাওয়া যায়। এছাড়া এমন শাকসবজি খাওয়া উচিত যেনো শরীরে পানির চাহিদা পূরণ হয়। যেমন লাউ,চিচিঙ্গা, ঝিঙা,পটল,বাঁধাকপি,ফুলকপি,বীটরুট ইত্যাদি। এছাড়া ঢেড়শ,বরবটি,সিম,কচুর লতিও খাওয়া যেতে পারে। শাকের ক্ষেত্রে পুইশাক খাওয়া যেতে পারে। 

মাছ

মাছে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও ভিটামিন যা শরীরের ঘাটতি পূরণ করে। মাছ খেলে মাছের মাথা বা ডিম বাদ দিয়ে খেতে হবে। সামুদ্রিক মাছ,ছোট মাছ,মাছের তেল এক্ষেত্রে উপকারী।

মাংস

মাংসের ক্ষেত্রে মুরগির মাংস খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া কবুতরের মাংস,পাখির মাংসও বেশ উপকারী। তবে,রেড মিট ও অরগান মিট খাওয়া যাবে না। সকল প্রকার প্রোটিন জাতীয় খাবার হিসাব করে খেতে হবে। বেশি বা কম হলে বিভিন্ন রকমের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

দুধ

স্কিমড মিল্ক, ঘরে তৈরি করা পনির, ফ্যাট ছাড়া দুধ খাওয়া যেতে পারে। 

অনেকেই রাতে খেয়ে আর সেহেরিতে খেতে উঠেন না। পরবর্তীতে সেহেরি না খেয়েই সারাদিন রোজা রাখেন। এই কাজটি করা যাবে না। প্রয়োজনে রাতে অল্প পরিমাণ খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে এবং সেহেরিতে উঠে আবার খেতে হবে। 

ইফতারে যে খাবারগুলো খাওয়া যেতে পারে

খেজুর

ইফতারে খেজুর শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তি যোগাতে পারে।পানির সাথে খেজুর সারাদিনের ক্লান্তিকে খুব সহজেই দূর করে দিতে পারে। ইফতার খেজুর দিয়ে শুরু করা উচিত।

শরবত

চিনি ছাড়া শরবত তৈরি করে খেতে হবে। চিনির বিকল্প হিসেবে শরবতে খেজুর খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া করলার জুস,ইসুবগুলের ভুসি খাওয়া যেতে পারে। এগুলো রক্তের কোলেস্টেরল কমিয়ে দেয়। 

পানি

যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে পানি খাওয়া যূয় না,তাই ইফতারে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে যেনো শরীরে পানির ঘাটতি পূরণ হয়।

ফল

তাজা ও ফরমালিন মুক্ত ফলমূল খেতে হবে।বেশি রসযুক্ত ফল খেলে ভালো হয়।কারণ,এতে ফলে থাকা পানি শরীরে পানির ঘাটতি পূরণ করে। ডাবের পানি, কমলার রস,পেয়ারা,পেঁপে,জাম্বুরা,আমলকি, ডালিম,আপেল,নাশপাতি,আঙ্গুর  এক্ষেত্রে খুবই উপকারী।এগুলো একদিকে যেমন শরীরে পানির ঘাটতি পূরণ করে, তেমনি অন্যদিকে শরীরে প্রয়োজনীয়  ভিটামিন যোগাতে সাহায্য করে। দৈনিক ২-৩ রকমের ফল খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া, টক ফল কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে।

সালাদ

বিভিন্ন রকম ফলমূল দিয়ে সালাদ খাওয়া  যেতে পারে।তবে,লবণের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। সালাদে বাদাম দিলে তা খেতে ভালো লাগবে।

শাকসবজি

ভাজা পোড়া খাবার ত্যাগ করে ইফতারে ভাতের সাথে শাকসবজি খাওয়া যেতে পারে। তবে,শাকসবজি যেনো তাজা ও ফরমালিন মুক্ত হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। 

টক দই

টক দই শরীরে ফ্যাটের মাত্রা কমিয়ে দেয়,তাই এটি বেশ উপকারী।আবার,দইয়ের সাথে চিড়া মিশিয়েও খাওয়া যেতে পারে। 

চিড়া

চিড়া ভিজিয়ে পানি বা দই দিয়ে খাওয়া যেতে পারে। আবার,সাথে কলাও দেওয়া যায়।

ডিম

ডিম খাওয়ার ক্ষেত্রে ডিমের কুসুম খাওয়া যাবে না। ডিমের সাদা অংশ খেতে হবে। কারণ,ডিমের কুসুমে রয়েছে অধিক মাত্রায় কোলেস্টেরল। 

নুডলস

বিভিন্ন রকম সবজি ও ডিমের সাদা অংশ দিয়ে নুডলস খাওয়া যেতে পারে।তবে,এক্ষেত্রে কম মসলা ব্যবহার করতে হবে।

ছোলা

ছোলা কাঁচা বা তেলমুক্ত সিদ্ধ ছোলা খেতে হবে। 

বাদাম

কাজুবাদাম,আখরোট, চিনাবাদাম,কুমড়ার বীজ,তিলের বীজ,সিমের বীজ পরিমাণ মতো খাওয়া যেতে পারে।

রাতের খাবারে যে খাবারগুলো খাওয়া যেতে পারে

ভাত

শর্করা জাতীয় খাবারের প্রধান উৎস ভাত।ভাত এই শর্করার চাহিদা মেটাবে।তবে,ভাতের বিকল্প হিসেবে চাইলে মটরশুটি,ব্রাইন রাইস,ওটমিল, গমের রুটি খাওয়া যেতে পারে। ভাতের সাথে বিভিন্ন রকমের সবজি ও ডাল নিয়মিত খেতে হবে। বিশেষ করে ছোলার ডাল খাওয়া যেতে পারে।

মাছ/মাংস/ডিম/দুধ

চর্বি ছাড়া মাংস খাওয়া সবচেয়ে উত্তম।দুধের ক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে তা যেনো চর্বি ছাড়া হয়।মাছ,মাংস,ডিম,দুধ প্রোটিনের অন্যতম উৎস যা প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করে থাকে। 

রুটি

রুটি খেলে তা নরম খেতে হবে।

এছাড়া ওটস, সবজির স্যুপ ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। 

পানীয়

পানীয় হিসেবে দুধ চা পরিহার করে আদা চা বা গ্রীন টি খাওয়া যেতে পারে। 

হার্টের রোগীদের যে খাবারগুলো খাওয়া উচিত নয়

  • বেশি লবণ জাতীয় খাবার ত্যাগ করা উচিত। অনেক খাবদর সাথে অতিরিক্ত লবণ নিয়ে থাকে যা বেশ ক্ষতিকর।এই অভ্যাস থাকলে তা ত্যাগ করতে হবে। ডুবো তেলে ভাজা খাবার গ্রহণ করা যাবে না। যেমন:বেগুনি,পেঁয়াজু, আলুর চপ,ডিমের চপ।যদি খেতেই হয়,তবে ইফতারে এক বা 

  • পেঁয়াজু বা এক মুঠো ছোলা খাওয়া যেতে পারে। তবে,না খাওয়াই উত্তম।বিকল্প হিসেবে তেল ছাড়া কাঁচা  কলার চপ খাওয়া যেতে পারে।যেহেতু এটি তেলে ভাজা হয় না, তাই এতে ক্ষতি নেই।

  • বিভিন্ন রকমের সস-যেমন,টমেটো সস,সয়াসস,ফিশ সস,ওয়েস্টার সস খাওয়া কমাতে হবে।

  • একবারে অতিরিক্ত খাবার খাওয়া যাবে না। অল্প অল্প করে খেতে হবে। 

  • বেকারির খাবার খাওয়া যাবে না। যেমন:পাউরুটি।

  • ফাস্টফুড,চা-কফি খাওয়া যাবে না।বিকল্প হিসেবে  গ্রীন টি খাওয়া যেতে পারে। 

  • কোনো রকম সফট ড্রিংকস খাওয়া যাবে না। সিগারেট ও মদ পানের অভ্যাস থাকলে তাও বাদ দিতে হবে। 

  • চর্বিযুক্ত ঘি,বাটার খাওয়া বন্ধ করতে হবে। এছাড়াও চিপস,লজেন্স খাওয়া পরিহার করতে হবে।

  • অতিরিক্ত চিনি বা চিনি জাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না। প্রয়োজনে ব্রাউন সুগার খাওয়া যেতে পারে। 

  • প্রক্রিয়াজাত ফ্রোজেন খাবার খাওয়া যাবে না। 

  • অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়া যাবে না। খাওয়ার পর মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস থাকলে তা পরিত্যাগ করতে হবে। 

  • ময়দা থেকে তৈরি করা খাবার পরিহার করতে হবে। 

  • কলিজা,মগজ,নেহারি ইত্যাদি খাবার বর্জন করতে হবে। 

  • চিংড়িতে প্রচুর পরিমাণে কোলেস্টেরল আছে। সাড়ে তিন গ্রাম আউন্সের চিংড়ি মাছে ১৮৯ গ্রাম কোলেস্টেরল আছে। তাই চিংড়ি খাওয়া পরিহার করতে হবে। 

  • অতিরিক্ত তেল খাওয়া ক্ষতিকর।তবে,নারকেল তেল,জলপাই তেল,মাছের তেল,অ্যাভোকেডোর তেল,সূর্যমুখী তেল,বাদাম তেল,রাইস ব্রাউন অয়েল,তিলের তেল স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তবে,রান্নার জন্য তেল হিসেবে অলিভ অয়েল সবচেয়ে উপকারী। 

  • চানাচুর, মুড়ি,ফুচকা অর্থাৎ সকল ধরনের স্ট্রিট ফুড অথবা বাইরের খাবার পরিহার করতে হবে। 

  • অধিক পরিমাণ ঝাল খাবার খাওয়া বর্জন করতে হবে। 

  • আচার খাওয়া ত্যাগ করতে হবে।​​

  • ময়দা থেকে তৈরি খাবার কুকিজ, কেক,বিস্কুট এসব খাবার কমাতে হবে।

  • নারিকেল খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ,নারিকেল হার্টের রোগীর জন্য খুবই ক্ষতিকরস

কিছু পরামর্শ

  • কিছু জিনিস ​খাওয়া একেবারেই বন্ধ হয় দেওয়া উচিত না যেমন, লবণ খাওয়া একেবারে কমিয়ে দিলে শরীরে ঘাটতি দেখা দিবে।

  • হার্টের রোগীদের অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে রোজা রাখা ও খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে।

  • এছাড়া হার্টের রোগীদের যে ঔষধ রয়েছে তা সময়মতো খেতে হবে। ঔষধ খাওয়ার জন্য ইফতার ও সেহেরির সময়কে দুই ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে।

  • এই সকল খাবারের পাশাপাশি নিয়মিত হাঁটা ও শরীর চর্চাও করতে হবে।

  • রক্তে সুগার ও কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক আছে কিনা তা চেক করে দেখতে হবে।

  • রোজার সময় হার্টের রোগীরা ইফতারের পরে হাঁটতে পারেন।

  • এছাড়া কোনো বিষয় মানসিক চাপ নেওয়া যাবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে হবে।

সবার ক্ষেত্রে যে ডায়েট চার্ট এক হবে এমনও নয়। বিভিন্ন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে ডায়েট চার্ট ভিন্ন ভিন্ন হবে যেমন- বয়স,লিঙ্গ,রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ ইত্যাদির উপর। নিয়মতান্ত্রিক ভাবে জীবনযাপন না করলে আরো বড় বড় রোগ ও সমস্যার সৃষ্টি হয়। কিছু হার্টের রোগীর আছে যাদের রোজা রাখার ফলে রক্তে সুগার বা কোলেস্টেরল অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।তাদের জন্য ডাক্তাররা রোজা না রাখারই পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে,গবেষণায় দেখা গেছে, রোজা হার্টের রোগীর জন্য বেশ উপকারী। 

​স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। শরীর সুস্থ থাকলেই মন ভালো থাকে।এজন্য দরকার নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন। সুষম ও পরিমিত খাবার এবং নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই তাদের সুস্থ রাখতে পারবে।

Default user image

মিল্কি রেজা, লেখক, আস্থা লাইফ

পড়াশুনা ইংরেজী সাহিত্যে। শিল্পচর্চা আমার নেশা, আর লেখাটা নেশা থেকে এখন পেশা। সৃষ্টিশীলতার মধ্যে থাকতে পছন্দ করি। ভালো এবং আরো ভালো লিখতে চাই।

Related Articles