রমজানে সুস্থ থাকতে সেহরি ও ইফতারে যা খাবেন
সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন সুষম খাবারের। দরকার পরিমাণমত শস্যজাতীয় খাবার, শাকসবজি, ফলমূল, দুধ, মাছ, মাংস বা ডিম। রমজান মাসেও এর ব্যতিক্রম নয়। সেহরি ও ইফতারেই মেটাতে হবে দরকারি পুষ্টি চাহিদা।

দেশে চলছে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ। সে সাথে শুরু হয়েছে মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে পবিত্র মাস রমাজান। গরম এবং রোজা একসাথে হওয়ায় খাওয়া-দাওয়ার সঠিক নিয়ম মেনে চলা জরুরী। অনেকেই এই সময় ডিহাইড্রেশন, সংক্রমণ এবং তাপজনিত অসুস্থতার মতো শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। তাই এমন খাবার খান যা শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং সমস্যা প্রতিরোধ করে। সারাদিন রোজা রাখার ফলে এবং অতিরিক্ত ঘামের কারণে আপনার শরীরে ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা হতে পারে, তাই এমন খাবার বেছে নিন যা সারা দিন শক্তি দেয়।
রমজানে কী খাওয়া যাবে, কী যাবে না
রমজান মাসের খাবার দাবার অন্যান্য মাসের স্বাভাবিক খাবার থেকে খুব ভিন্ন হওয়া উচিৎ নয় বরং যতটা সম্ভব রোজার মাসে সাধারণ খাবার খাওয়া উচিৎ। যাতে করে আপনার শরীরের ওজন খুব বেশি বেড়ে না যায়, আবার একেবারে কমেও না যায়। রমজানে সেহরি ও ইফতারে পুষ্টি চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ করার জন্য আপনাকে বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। আসুন আমরা জেনে নেই সেহরি ও ইফতারে কী খাওয়া যাবে, কী যাবে না।
১. ধীরে হজম হয় এমন খাবার খেতে হবে
দ্রুত হজম হয় এমন খাবারের পরিবর্তে আপনার বেছে নেওয়া দরকার এমন খাবার যা হজম হতে বেশি সময় লাগে। অর্থাৎ, এমন সব খাবার গ্রহণ করা যা হজম হতে প্রায় ৮ ঘন্টার মতো সময় লাগে। কারণ হজম হতে বেশি সময় নেওয়া খাবারগুলি আপনার রক্তে শর্করার পরিমাণ ধীর গতিতে বাড়ায় যা আপনাকে সুস্থ্য ও ভারসাম্যপূর্ণ শক্তি প্রদান করে। অপরদিকে দ্রুত হজমযোগ্য খাবার খেলে আপনি খেয়াল করবেন আপনার যতটা প্রয়োজন তার থেকে বেশি খাবার খেয়ে ফেলছেন। যার ফলে আপনার বারবার ক্ষুধা অনুভূত হবে।
প্রোটিন ও স্নেহপদার্থ জাতীয় খাদ্য মাছ ও মাংস পুরোপুরি হজম হতে অনেক সময় প্রায় দুদিনও লেগে যায়। অপরদিকে, অত্যধিক আঁশজাতীয় খাদ্য যেমন, সবজি, ফলমূল পুরোপুরি হজম হতে একদিনেরও কম সময় লাগে।
২. আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে
খাবার নির্বাচনে আপনাকে দ্বিতীয় যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে তা হচ্ছে খাদ্যে ফাইবার বা আঁশের উপস্থিতি। মূলত যেসব খাবারে ফাইবার বেশি থাকে সেসব খাবারই হজম প্রক্রিয়াকে আরও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হতে সহায়তা করে।
৩. তেলযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে
আপনাকে অবশ্যই অধিক ভাজা-পোড়া এবং চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। কারণ তেলযুক্ত খাবার বদহজম, বুক জ্বালা-পোড়া করা, শারীরিক ওজন বৃদ্ধিজনিত সমস্যা সৃষ্টির জন্য দায়ী।
৪. প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল পানি। এ বছর রমজানের শুরুটা হয়েছে গরমের সময়। প্রায় ১৪ ঘণ্টা পানি পান না করার কারণে অনেকের শরীরে পানির ঘাটতি দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে বয়স্ক, ডায়াবেটিস ও কিডনির অসুখে যারা ভুগছেন তাদের মধ্যে এই সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বেশি। পানিশূন্যতা হলে শরীরে কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন- অতিরিক্ত মুখ ও ত্বক শুকিয়ে যাওয়া, মাথা ঘোরা, কোষ্টকাঠিন্য ইত্যাদি।য়
শরীরে আর্দ্রতা বজায় রাখতে পানির বিকল্প নেই। সেহরি ও ইফতার মিলিয়ে কমপক্ষে ৮ থেকে ১২ গ্লাস পানি পান করাটা প্রত্যেকের জন্য জরুরী। এছাড়া ইফতারে শরীরের পানিশূন্যতা দূর করতে যেসব ফল এবং শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে পানি আছে যেমন, শসা, তরমুজ, ডাব ,নাশপাতি,বাঙগী ,আঙ্গুর ইত্যাদি খেতে পারেন।
সেহরিতে কি খাওয়া উচিত
সেহরির সময় হচ্ছে দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাবার, তাই এটি যেন কোনোভাবেই বাদ না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যদিও সারা দিনের ক্ষুধা সেহরির মাধ্যমে নিবারণ করা সম্ভব নয়, কিন্তু আমরা যদি খাবার নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটু খেয়াল রাখি তাহলে অনায়াসেই ক্ষুধাকে বিলম্বিত করতে পারি। সেহরির খাবার নির্বাচনে নজর দিতে হবে একই সাথে আমিষ, জটিল শর্করা ও খাদ্য আঁশের প্রতি। সেহরিতে যে খাবারগুলি অনেকসময় ধরে আপনার শরীরে পুষ্টি জোগাবে তা হচ্ছে,-
-
ভাত এক থেকে দেড় কাপ (সম্ভব হলে লাল চালের ভাত খাবেন)।
-
সাথে মিক্সড সবজি ১ কাপ, মাছ অথবা মুরগি ১ টুকরো, ডাল এক কাপ , সালাদ ১ বাটি।
-
শেষে দই অথবা ননীবিহীন দুধ ১ কাপ।
ইফতারে কি খাওয়া উচিত
অনেক ঘণ্টা না খেয়ে থাকার পর প্রথম খাবারই হল ইফতার। তাই অবশ্যই আপনাকে নরম, সহজে হজমযোগ্য, পুষ্টিকর খাবার ইফতার মেন্যুতে রাখতে হবে।
সারাদিন রোজা রাখার পর স্বাভাবিকভাবেই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যায়। সেজন্য ইফতারের শুরুটা হওয়া দরকার কিছুটা দ্রুত হজম হয় এমন ধরনের শর্করাজাতীয় খাবার দিয়ে।
-
শর্করাজাতীয় খাবার হিসেবে ভাত, রুটি, নুডলস, আলুর চপ, খিচুড়ি, চিড়া, সাগু, মুড়ি ইত্যাদি রাখা যেতে পারে।
-
এছাড়া দীর্ঘক্ষণ খাবারবিহীন অবস্থায় থাকার কারণে আমাদের পরিপাকতন্ত্রকে খাদ্য পরিপাকের জন্য প্রস্তুত করতে প্রয়োজন হয় হালকা গরম তরল খাবার, যেমন স্যুপ জাতীয় খাবার।
-
সেই সাথে দরকার পর্যাপ্ত পরিমাণ পানির।
ইফতারের সময়কার খাবারকে দু’ভাগে ভাগ করে খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত । ইফতারের সময় হলে কিছু খেয়ে রোজা ভেঙে আবার মাগরিবের নামাজের পর খেতে পারেন। কারণ, একসঙ্গে খেলে বেশি খাবার খাওয়া হয়ে যাবে। এতে নানা রকম জটিলতা তৈরি হয়ে আপনার শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়তে পারে।। ইফতারে অবশ্যই ভাজাপোড়া খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে।
ইফতারের শুরুতে যা খাবেন
-
প্রথমেই খেজুর ৩ থেকে ৪ টা,
-
হালকা গরম ভেজিটেবল অথবা চিকেন স্যুপ ১বাটি,
-
ছোলা সেদ্ধ আধ বাটি,
-
যে কোনো ফলের জুস ১ গ্লাস
-
তরল পানীয় হিসেবে গুড়ের শরবত, ঘরের তৈরি চিনি ছাড়া ফলের জুস, ডাবের পানি, ইসবগুল বা তোকমার শরবত, রুহ আফজা, লেবু পানি ও দইয়ের লাচ্ছি রাখা যেতে পারে।
মাগরিবের নামাজের পর যা খাবেন
-
পায়েস/দই চিঁড়ে অথবা ওটস ১ বাটি,
-
কলা অথবা আপেল ১টা
-
তবে এসব খাবার কেউ খেতে না পারলে এক গ্লাস শরবত, দুইটা খেজুর, ডাল-চাল ও সবজির তৈরি খিচুড়ি এবং ফলের সালাদ ইফতার মেন্যু হিসেবে রাখতে পারেন । এটি একটি স্বাস্থ্যকর ইফতার মেন্যু।
-
এ ছাড়া রমজানে সুস্থতা নিশ্চিত করতে ইফতারের ২ঘন্টা পর ১৫-২০ মিনিট হাঁটাহাঁটি করা ভালো।
রাতের খাবারে যা খাবেন
রমজানে আপনাকে যে তিন বেলা খাবার থেকে পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে হয় তার মধ্যে রাতের খাবার একটা। রোজার সময় তারাবি নামাজের পর সাধারণত রাতের খাবার খাওয়া হয়।
-
রাতের খাবারের মেন্যু হালকা হওয়া উচিত। এতে সঠিক পরিমাণের খাবার সেহরিতে গ্রহণ করা সম্ভব হয়। তাছাড়া রাতে একটু হালকা খাবার খেলে ঘুম ভালো হয় এবং ওজন বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমে।
-
খাবারে সব রকমের ফুড গ্রুপ থেকে কিছুটা রাখা দরকার।
-
দুধ-রুটি-ফল, রুটি-সবজি-ডিম, রুটি-ডাল-সবজি, চিড়া- দুধ-কলা, ওটস-দুধ, সাগু-দুধ অথবা সবজি ও মাংস দিয়ে তৈরি স্যুপ ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। আপনি এই খাবারগুলির যেকোনো একটা বেছে নিতে পারেন।
-
তবে যারা সারাদিন রোজা রেখে এসব খাবারে অভ্যস্ত নয় তারা চাইলে রাতের খাবারে ভাত ১/২কাপ, মাছ অথবা মুরগি ১টুকরো, সবজি ১ কাপ ও সালাদ ১ বাটি খেতে পারেন।
সুষম খাবার নিয়ন্ত্রণ করবেন যেভাবে
-
মনে রাখবেন ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। কোনোভাবেই ডিহাইড্রেটেড হওয়া যাবে না।
-
সেহেরি বা ইফতারে অতিরিক্ত মসলা ও লবনযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। কারন এসব খাবার শরীরে অতিরিক্ত পানির চাহিদা তৈরী করে।
-
আবার কেক ,পেস্ট্রি এবং বিভিন্ন মিস্টি জাতীয় খাবার খাবার শরীরে পানির চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। সেহরীতে মিস্টি জাতীয় খাবার খেলে শরীরের শক্তি কমে যেতে পারে। এ কারণে রোজার সময় অতিরিক্ত চিনি দিয়ে তৈরি মিস্টি খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। বরং এর পরিবর্তে মিস্টি ফল খান ।
-
ইফতার বা সেহরিতে কম্ বেশি চা-কফি সবাই পান করেন । তবে অতিরিক্ত ক্যাফেইন জাতীয় খাবার খেলে ঘন ঘন পানি পিপাসা পায় এটাও মনে রাখতে হবে।
পরিশেষ
গরমে এরই মধ্যে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। এ কারণে যতটা সম্ভব রোদ এড়িয়ে চলুন। কারণ অতিরিক্ত পানিশূন্যতা হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়তে পারে। তাই সুস্থ থাকতে ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার খান। সেই সঙ্গে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় যোগ করুন স্বাস্থ্যসম্মত খাবার।