রমজানে কালোজিরার ২৫টি ঔষধি গুণাগুণ ও খাওয়ার নিয়ম
বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধক ও প্রতিষেধক হিসেবে কালোজিরার অবদান বলে শেষ করা যাবে না। মহানবী (সা.) কালোজিরাকে মৃত্যু ব্যতীত সকল রোগের ঔষধ বলেছেন। সাহাবীরাও সবসময় সকলকে কালোজিরা সাথে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। এজন্য কালোজিরাকে সকল রোগের মহৌষধ বলা হয়।
রমজান মাস আত্মশুদ্ধির মাস। আত্মশুদ্ধি ও সংযমের এই পবিত্র মাসে নিজেকে পরিশুষ্ক করার পাশাপাশি নিজের স্বাস্থ্যেরও খেয়াল রাখা জরুরি। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ইবাদত করার জন্য আত্নিক সুস্থতার পাশাপাশি শারিরীক সুস্থতাও প্রয়োজন। কেননা শরীর সুস্থ না থাকলে কোনো ইবাদত করাই সম্ভব হবে না। আর শারীরিক সুস্থতা ঠিক রাখতে বিভিন্ন ধরনের উপাদান ভূমিকা রাখে। এমনই এক কার্যকরী উপাদান হচ্ছে কালোজিরা যার উপকারী দিক বলে শেষ করা যাবে না।
কালোজিরা আমাদের জন্য একটি নিয়ামত। রমজানে কালোজিরা সেবনের ফলে শরীর ভালো থাকে,নানা ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
কালোজিরায় যে উপাদানগুলি বিদ্যমান থাকে
কালোজিরায় বেশ কিছু উপকারী উপাদান রয়েছে। যেমন-
-
ফসফরাস ও ফসফেট
-
লৌহ
-
কার্বোহাইড্রেট এবং প্রোটিন
-
ভিটামিন এ, বি, বি২ এবং সি
-
নিয়াসিন
-
ক্যালসিয়াম,আয়রণ, কপার, জিংক
-
ফোলাসিন, নাইজেলোন, থাইমোকিনোন
-
লিনোলিক অ্যাসিড
-
ওলিক অ্যাসিড
-
সেলেনিয়াম ইত্যাদি।
কালোজিরা সেবনের উপকারিতা
রোজার কালোজিরা সেবনের বহুমুখী উপকারিতা রয়েছে। যেমন-
১. ক্লান্তি ও দূর্বলতা দূরীকরণে
সারাদিন রোজা রাখার পর শরীর বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এই ক্লান্তি দূর করার জন্য কালোজিরা সেবন করা যেতে পারে। কালোজিরা দিয়ে লাল চা খেলে এই ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।
২. অনিদ্রার সমাধানে
অনেকেই অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। ফলে রমজানে সেহেরির সময় উঠতে সমস্যা হয়। কালোজিরা সেবনের ফলে অনিদ্রার এই সমস্যা দূর হয়। সেহেরিতে ভাতের সাথে এক কোয়া রসুন ও কালোজিরা শুকনো গুড়া খেলে উপকার পাওয়া যাবে।
৩. অলসতা দূরীকরণে
রোজা রেখে অনেক সময় কোনো কাজ করতে ইচ্ছে করে না, অলসতা শরীরে ভর করে। কালোজিরা এই অলসতা দূর করে। শসা, টমেটো, গাজর, কাঁচা মরিচ, লবণ, সরিষার তেল ও সামান্য কালোজিরা দিয়ে সালাদ বানিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
৪. মাথা ব্যথার সমস্যা সমাধানে
ইফতারের পর মাথা ধরা খুবই সাধারণ সমস্যা। মাথা ধরা, মাথা ঝিমঝিম করা ইত্যাদি সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কালোজিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর জন্য সপ্তাহে তিনদিন চা চামচের সমান করে এক চা চামচ কালোজিরা খাওয়া যেতে পারে।
৫. চুলের যত্নে
রোজার সময় সারাদিন পানি পান করা হয় না। ফলে, চুল পড়াও বেড়ে যায়। কালোজিরা এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়। এছাড়া কালোজিরা চুলের বৃদ্ধিতে, চুলের গোড়া শক্ত করতে সহায়তা করে।
৬. স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে
রমজান মাস ইবাদতের মাস। অন্য সব মাসের থেকে মুমিন এই মাসে ইবাদত করে বেশি। এসময় কোরআন শরীফ হিফজ করতে চায়, কেউবা বিভিন্ন দোআ বা সূরা মুখস্থ করতে চায়। অনেকেই কোনো পড়া, দোয়া বা সূরা মনে রাখতে পারে না, দ্রুত ভুলে যায়। এই সমস্যা সমাধানে কালোজিরার ভূমিকা রয়েছে। কালোজিরা নিয়মিত খেলে দেহে ঠিকভাবে রক্ত সঞ্চালন হয়। ফলে, মস্তিষ্কেও রক্ত সঞ্চালন ঠিকমতো হয় যা স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। রাতে রুটি খেলে সেই রুটির মধ্যে কালোজিরা দিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এজন্য রুটি বানানোর সময় আটার সাথে কালোজিরা মিশিয়ে রুটি বানালে খেতে ভালো লাগবে।
৭. অরুচির সমস্যায়
রমজানে অনেক সময় খাবার গ্রহণের জন্য কোনো রুচি থাকে না, ফলে ঠিকমতো খাওয়া যায় না। কালোজিরা রুচি বাড়াতে সাহায্য করে। কালোজিরা ভর্তার সাথে ভাত খেলে রুচি বৃদ্ধি পাবে।
৮. মেদ নিয়ন্ত্রণে
রমজানে তেল ও ফ্যাট জাতীয় খাবার খাওয়ার ফলে শরীরে মেদ জমে যায়। মেদ নিয়ন্ত্রণে কালোজিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন চায়ের সঙ্গে কালোজিরা মিশিয়ে খেলে শরীরের বাড়তি মেদ কমে যায়।
৯. হৃদরোগে
হৃদরোগীদের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সবসময়ই যত্নবান হতে হয়, রমজানেও ঠিক তাই। হৃদরোগের ক্ষেত্রে কালোজিরা বেশ উপকারী। হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কালোজিরা শুকনা করে ভেজে সাদা ভাতের সাথে খেতে পারে।
১০. গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায়
ইফতারে বিভিন্ন ভাজা-পোড়া খাবার খাওয়ার ফলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে প্রতিদিন এক কাপ দুধের সাথে এক চামচ কালোজিরার তেল ৫-৭ দিন সেবন করলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা কমে যায়।
১১. চোখের সমস্যা
চোখের সমস্যা সমাধানে কালোজিরা বেশ উপকারী। ইফতারে এক চা চামচ কালোজিরা এক কাপ গাজরের রসের সঙ্গে সেবন করলে চোখের সমস্যা দূর হয়ে যায়।
১২. উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কালোজিরা সাহায্য করে। ইফতারে গরম পানীয় বা চা এর সাথে যেমন-র'চা এর সাথে কালোজিরা খেলে রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে। এছাড়া ভাতের সাথে কালোজিরা ভর্তা কিংবা কালোজিরা শুকনা করে গুড়া করে খাওয়া যায়। এক চামচ কালোজিরার তেলে এক চামচ মধু মিশিয়ে খেলেও এক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যায়।
১৩. জ্বর হলে
অনেক সময় রোজা রেখে সারাদিন না খেয়ে থাকার ফলে জ্বর জ্বর অনুভূত হয়। এরকম সমস্যা কাটিয়ে উঠতে কালোজিরা কার্যকরী ভূমিকা রাখে। সেক্ষেত্রে ইফতারে এক টেবিল চামচ কালোজিরার তেল সেবন করলে উপকার পাওয়া যায়। আবার, এক চামচ কালোজিরার সাথে দুই চামচ মধু, তিন চামচ তুলসী পাতার রস মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়।
১৪. ব্যথা উপশমে
রোজা রেখে সারাদিন পরিশ্রম করলে রাতে শরীর ব্যথা হয়। বিভিন্ন রকমের ব্যথা উপশমে কালোজিরা তেল সেবন করলে উপকার পাওয়া যায়। যেমন, বাত, পিঠ ও অন্যান্য ব্যথা। এক চামচ হলুদের রস, এক চামচ মধু, এক চামচ কালোজিরার তেল সেহেরি ও ইফতারে খেলে এক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যায়।
১৫. দাঁতের সমস্যায়
ইফতারে ঠান্ডা শরবত বা পানি খাওয়ার ফলে দাঁত শিরশির করে। এছাড়াও অনেক সময় দাঁত দিয়ে রক্ত পড়ে। সেক্ষেত্রে ইফতারে কালোজিরার সাথে দই মিশিয়ে খেলে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
১৬. ওজন নিয়ন্ত্রণে
ইফতারে প্রতিদিন ফ্যাট জাতীয় খাবার খাওয়ার ফলে ওজন বেড়ে যায়। এই ওজন কমানোর ক্ষেত্রে কালোজিরা বেশ উপকারী। ওজন কমানোর জন্য ইফতারে উষ্ণ গরম পানি, লেবু, মধু ও কালোজিরা মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়।
১৭. স্বাদ বৃদ্ধিতে
যেকোনো খাবারে কালোজিরা ব্যবহার করলে খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি পায়। যেমন: রমজানে রাতের খাবারে লাল রুটির সাথে কালোজিরা খাওয়া যেতে পারে । এতে যেমন খাবারের স্বাদ ও ঘ্রাণ বৃদ্ধি পায়, তেমনি খাবারের পুষ্টিগুণও অনেকটাই বেড়ে যায়।
১৮. রোগ প্রতিরোধে
রমজানে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরো কার্যকরী করে তুলতে কালোজিরা সাহায্য করে। শরীরের যেকোনো জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে কালোজিরা ভূমিকা রাখে। আলুর চচ্চড়ি, মাছের পাতলা ঝোল ইত্যাদি খাবারে কালোজিরা ব্যবহার করা যেতে পারে।
১৯. পেট খারাপ সমাধানে
ইফতারে অনেক খাবার একসাথে খাওয়ার ফলে অনেক সময় পেট খারাপ হয়। সেক্ষেত্রে কালোজিরা সুস্থ হতে সহায়তা করে। কালোজিরা ভেজে গুড়া করে তা দুধের সাথে সেহেরির সময় খেলে উপকার পাওয়া যায়।
২০. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে
রমজানে ইফতার বা সেহেরিতে নিয়মিত কালোজিরা সেবন করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। কারণ, কালোজিরা রক্তের গ্লুকোজ কমিয়ে দেয়। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
২১. সর্দি -কাশির সমস্যা সমাধানে
ঋতু ও আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে সর্দি -কাশি পিছু লেগেই থাকে। সকালে বৃষ্টি তো দুপুরে রোদ, বিকালে গরম তো রাতে ঠান্ডা। এ যেনো নিত্যদিনের কাহিনি। এসময় সর্দি-কাশি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে ইফতারে এক চামচ মধুর সঙ্গে কালোজিরা তেল মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়। আবার, এক কাপ লাল চায়ের সাথে আধ চা চামচ কালোজিরা তেল মিশিয়ে খেলেও উপকার পাওয়া যায়। বুকে কফ জমলে কালোজিরা খেলে আরাম পাওয়া যায়।
২২. শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানীর সমস্যায়
শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানীর সমস্যা থাকলে কালোজিরা খেলে তাতে আরাম পাওয়া যায়। রমজানে সেহেরি বা রাতের খাবারে কালোজিরা ভর্তা বা ভাতের সাথে কালোজিরা খেলে স্বস্তি মিলে।
২৩. মায়েদের বুকের দুধ বৃদ্ধিতে
যেসব মায়েরা ব্রেস্টফিডিং করান, তাদের জন্য কালোজিরা খুবই উপকারী। তারা ইফতার, সেহেরি ও রাতের খাবারে কালোজিরা রাখলে, ব্রেস্টফিডিং এ সমস্যা হয় না। সেক্ষেত্রে সেহেরি ও রাতের খাবারে যেকোনো তরকারি বা ডালের সাথে কালোজিরা ভর্তা বা শুকনো গুড়া খাওয়া যেতে পারে।
২৪. সংক্রমণ রোধে
ক্ষত-ঘা শুকাতে, বিভিন্ন সংক্রামক রোগ থেকে মুক্তি দিতে কালোজিরা সাহায্য করে।
২৫. অন্যান্য
এছাড়া, শিশুদের স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধিতে, আর্থাইটিস ও মাংসপেশির ব্যথা কমাতে, প্রসবকালীন ব্যথা কমাতে, মাইগ্রেনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে কালোজিরার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।
কালোজিরা তেল
শুধুমাত্র কালোজিরা সেবনেই যে উপকার হয় এমন নয়।কালোজিরা থেকে তৈরি তেলও বেশ উপকারী। কালোজিরা তেল ব্যবহারের ফলে চুল পড়া বন্ধ হয়।মাথাব্যথা দূর করতে কালোজিরা তেলের মালিশ কার্যকরী। এছাড়া হাঁপানির সমস্যা দূর করতে বুকে ও পিঠে কালোজিরার তেল মালিশে উপকার পাওয়া যায়।
কালোজিরার এতসব উপকারীতা থাকা সত্ত্বেও তা পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে। অতিরিক্ত কোনো কিছু ভালো নয় যেমন, গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত কালোজিরা খাওয়া যাবে না। অতিরিক্ত কালোজিরা সেবনের ফলে গর্ভপাত হতে পারে। আবার,২ বছরের নিচে বয়সী বাচ্চাদের কালোজিরা খাওয়ানো যাবে না। অনেকেই কালোজিরা হজম করতে পারে না, তাদের কালোজিরা খাওয়া বন্ধ রাখতে হবে। ভেজাল কালোজিরা খাওয়া যাবে না। আর সর্বক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়াই শ্রেয়।