যে ১১ টি খাবারে শর্করার পরিমান বেশি থাকে!
অতিরিক্ত চিনি খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই অনেকে এখন চিনির পরিমাণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছেন, তবে আপনি নিজের অজান্তেই কিছু খাবারের মাধ্যমে অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ করে ফেলছেন। এর অন্যতম কারণ হল অনেক খাবারের মধ্যে গোপন শর্করা রয়েছে, যা আপনি কখনও মিষ্টি হিসেবে বিবেচনা করেন না। প্রকৃতপক্ষে, হালকা বা লো ফ্যাট খাবারগুলিতে তাদের নিয়মিত অংশের তুলনায় বেশি পরিমাণে চিনি থাকে।
যে কোন শুভ অনুষ্ঠানে মিষ্টিমুখ করা বিশ্বের সকল দেশের, সকল সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য একটি ঐতিহ্যবাহী প্রথা। বিয়ে, জন্মদিন, নানা রকম ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান মোট কথায় মানুষ খুশি হলেই মিষ্টিমুখ করায় বা করতে চায়। নানা রকম মুখরোচক উপাদেয় মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় খাবারগুলো হচ্ছে - রসগোল্লা, কালোজাম, চমচম, ক্ষীরের মিষ্টি, ছানার মিষ্টি, বুরিন্দা, জিলাপি, পেস্ট্রি কেক, পায়েস, ফিরনি, ফালুদা, ফ্রুট কেক, নানা রকমের পিঠা ইত্যাদি। এছাড়া চকলেট, আইসক্রিম সকল বয়সের মানুষের জন্য খুবই পছন্দের। তবে অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়া মানব শরীরের জন্য মোটেও সুখকর নয়।
তাছাড়া মিষ্টিজাতীয় খাবারগুলো ছাড়াও আমাদের প্রাত্যহিক খাবার থেকে প্রাকৃতিক ভাবেই আমাদের শরীরে মিষ্টি বা শর্করা প্রবেশ করে। আর আমাদের দৈনন্দিন খাবারের মধ্যে শর্করা অন্যতম প্রধান খাদ্য। এই শর্করা জাতীয় খাবারের দ্বারা আমাদের শরীরে শক্তি অর্জিত হয় এবং এতে রয়েছে প্রচুর পরিমানে চিনি বা গ্লুকোজ, আঁশ ও শ্বেতসার।
তাই আমাদের খাবারের তালিকা থেকে একটু একটু করে চিনির পরিমাণ কমিয়ে ফেলতে হবে। কারণ গবেষনায় দেখা গিয়েছে যে, এই চিনি ডায়বেটিস, ওজন বৃদ্ধি, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার সহ নানাবিধ জটিল রোগের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এছাড়া চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার আমাদের শরীরের মেটাবলিজম প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটায়।
আসুন জেনে এমন কিছু খাবার সম্পর্কে যাতে লুকানো চিনির পরিমাণ অপ্রত্যাশিতভাবে অনেক বেশী -
ফলের রস
একটি পুরো ফলের মতো ফলের রসেও কিছুটা ভিটামিন এবং খনিজ থাকে। কিন্তু স্বাস্থ্যকর মনে হলেও এই ভিটামিন এবং খনিজগুলি প্রচুর পরিমাণে চিনি এবং খুব অল্প পরিমাণে ফাইবারের উপস্থিতি থাকে।
এক গ্লাস ফলের রস তৈরি করতে সাধারণত প্রচুর পরিমাণে ফলের দরকার হয়, তাই পুরো ফল খেলে আপনি যতটুকু চিনি গ্রহণ করতেন তার চেয়েও অনেক বেশী চিনি গ্রহণ করবেন এক গ্লাস ফলের রসে। এভাবে আপনি খুব দ্রুত প্রচুর পরিমাণে চিনি গ্রহণ করে ফেলতে পারেন।
আসলে, ফলের রসে ঠিক তত পরিমাণে চিনি থাকতে পারে যতটা কোক বা পেপসির মত চিনিযুক্ত পানীয়তে রয়েছে।
আমাদের উচিৎ হবে পুরো ফলটি খাওয়া এবং ফলের রস যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা।
চকোলেট দুধ
সাধারণত বাচ্চারা দুধ খেতে চায় না। শুধু বাচ্চারাই নয় বড়রাও অনেকে দুধ খেতে চায় না। নানা রকম অজুহাতে দুধ খাওয়াটাকে এড়াতে চায়। কিন্তু চকলেট সবারই পছন্দ। তাই দুধের সাথে চকলেট মিশিয়ে দিলে সবাই খুব মজা করে খেয়ে নেয়।
সাধারণত চকোলেট দুধ এমন দুধ যা কোকো দিয়ে স্বাদযুক্ত এবং চিনি দিয়ে মিষ্টি করা হয়েছে।
আমরা জানি দুধ নিজেই একটি খুব পুষ্টিকর পানীয়। এতে রয়েছে প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম এবং প্রোটিন যা হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য দুর্দান্ত।
কিন্তু চকোলেট দুধে থাকে প্রচুর পরিমাণ চিনি। কারণ দুধের সমস্ত পুষ্টিকর গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও, ৮ আউন্স বা ২৩০ মিলিলিটার চকোলেট দুধে থাকে অতিরিক্ত ১১.৪ গ্রাম বা ২.৯ চা চামচ চিনি।
তাই চকলেট দুধ খাওয়া মোটেও স্বাস্থ্য সম্মত নয়। এতে ওজন বৃদ্ধির প্রবনতাও বাড়ে।
আইসক্রিম
আইসক্রিম বড় ছোট সকলেরই জন্য খুবই মজাদার এবং খুবই লোভনীয় একটি খাবার। আর এই আইসক্রিম তৈরি হয় চকোলেট, মিষ্টি, দুধ, ক্রীম ইত্যাদি ক্যালরি সমৃদ্ধ উপাদান দিয়ে। এই সব লোভনীয় খাবারের মাধ্যমে খুব সহজেই আমাদের শরীরে মিষ্টি প্রবেশ করে নানা রকম রোগের সৃষ্টি করে।
বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত আইসক্রিম আপনার পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। একটি আইসক্রিমে ২০ গ্রাম অবধি চিনি থাকে যা একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোক একদিনে সর্বোচ্চ পরিমাণ খেতে পারেন। এটির সাথে ক্ষতিকারক ট্রান্স ফ্যাটগুলিও যুক্ত থাকে।
যে খাবার খেলে বাড়বে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
ক্যান্ডিবার
আগেই বলেছি যে চকলেট, ক্যান্ডিবার এগুলো ছোটদের তো বটেই বড়দের কাছেও দারুণ পছন্দের। মাঝে মাঝে এগুলি খাওয়া আপনার জন্য সহনীয়। তবে অতিরিক্ত কিছুই সুখকর নয়। কারণ একটি নিয়মিত ক্যান্ডিবারে ট্রান্স ফ্যাট এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক উপাদান ছাড়াও ৭ চা চামচ পরিমাণ চিনি থাকে। তাই পরিমিত গ্রহণ করাই শ্রেয়।
কেচআপ
এটি অনেকের কাছে একটি বিশাল চমক যে, মিষ্টি না এমন কিছুতে কীভাবে এতে চিনি থাকে? এটি খুব সহজ কারণ চিনি একটি দুর্দান্ত প্রিজারভেটিভ এবং এতে ভিনেগার এবং টমেটোর মত টক স্বাদ থাকা সত্ত্বেও কাজ করে। আপনার ফ্রাইগুলির সাথে কিছুটা কেচাপ রাখা খারাপ কিছু না, কেবল মনে রাখবেন যে এক টেবিল চামচ কেচাপে পুরো এক চা চামচ চিনি রয়েছে।
লো ফ্যাট দই
দই অত্যন্ত পুষ্টিকর হতে পারে। তবে সব দই সমানভাবে তৈরি হয় না।
অন্যান্য অনেক লো ফ্যাট পণ্যগুলির মতো স্বাদ বাড়ানোর জন্য কম ফ্যাটযুক্ত দইয়ে অতিরিক্ত চিনি যুক্ত থাকে।
উদাহরণস্বরূপ, এক কাপ বা ২৪৫ গ্রাম লো ফ্যাট দইতে ৪৫ গ্রাম চিনি থাকতে পারে, যা প্রায় ১১ চা চামচ চিনির সমপরিমাণ। সত্যি অবিশ্বাস্য!
এছাড়া, লো ফ্যাটযুক্ত দইতে ফুল ফ্যাট দইয়ের মতো স্বাস্থ্য উপকারিতা নেই।
ফ্লাভারেড কফি
ফ্লাভারেড কফি এখনকার একটি জনপ্রিয় ট্রেন্ড, তবে এই পানীয়গুলিতে লুকানো শর্করা্র পরিমাণ বিস্ময়কর হতে পারে।
একটি বড় ফ্লাভারেড কফির মধ্যে ৪৫ গ্রাম পর্যন্ত চিনি থাকতে পারে, যা প্রায় ১১ চা চামচ চিনির সমতুল্য
আইস টি
আইস টি সাধারণত চিনি মিশিয়ে মিষ্টি করা হয় বা ফ্লাভারেড মিশিয়ে স্বাদযুক্ত করা হয়।
এটি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন রূপ এবং স্বাদে জনপ্রিয়, তবে চিনির পরিমাণ প্রায় একই।
বেশিরভাগ বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত আইস টিতে প্রতি ১২ আউন্স বা ৩৪০ মিলিলিটারে রয়েছে প্রায় ৩৫ গ্রাম চিনি, যা একটি কোকের বোতলের চিনির সমপরিমাণ।
ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল
সিরিয়াল হল প্রক্রিয়াজাত খাদ্যশস্য যা দুধ, কলা, দই ইত্যাদির সাথে খাওয়া হয়। এটি একটি জনপ্রিয়, দ্রুত এবং সহজে প্রস্তুতকৃত সকালের খাবার।
তবে সিরিয়ালের নিয়মিত ব্যবহার আপনার শরীরে চিনির আধিক্য বাড়িয়ে দিবে।
কিছু সিরিয়ালে, বিশেষত বাচ্চাদের জন্য তৈরি সিরিয়ালে প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকে। কিছু ক্ষেত্রে মাত্র ৩৪ গ্রাম সিরিয়ালের মধ্যে ১২ গ্রাম বা ৩ চা চামচ চিনি থাকে।
তাই সিরিয়াল কেনার আগে চিনির পরিমাণ দেখে নিবেন।
তবে সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে, সকালে একটু আগে ওঠুন এবং ডিমের মতো উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবারের সাথে স্বাস্থ্যকর নাস্তা সেরে ফেলুন। এতে আপানর ওজন হ্রাস করতে দারুণভাবে সহায়তা করবে।
আপনি সঠিক তেল দিয়ে রান্না করছেন তো?
প্যাকেটজাত স্যুপ
স্যুপ খুবই পুষ্টিকর ও উপকারী খাবার। মার্কেটে বিভিন্ন রকমের স্যুপ রয়েছে যেমন, ভেজিটেবল স্যুপ, চিকেন স্যুপ, থাই স্যুপ, এগ স্যুপ ইত্যাদি। আর এই স্যুপকে সুস্বাদু করার জন্য ব্যবহার করা হয় নানা রকমে সস, টেষ্টিং সল্ট, কর্ণফ্লাওয়ার, ক্রিম, চিনি ইত্যাদি। আর এইসব উপাদানে থাকে লুকানো শর্করা বা চিনি।
তবে ঘরে তৈরি করে স্যুপ খাওয়াটাই স্বাস্থ্যকর। কারণ প্যাকেটজাত স্যুপগুলোতে চিনি, টেস্টিং সল্ট থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
স্মুথি
স্মুথি খুবই মজাদার এক প্রকার পানীয়। দোকানের স্মুথি গুলো খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু তাতে থাকে চিনি ও অন্যান্য মিষ্টি জাতীয় উপাদান। এর ফলে ক্যালরিতে পরিপূর্ণ থাকে স্মুথি। তবে ঘরে বানানো স্মুথি পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত হয়।
যে কোন খাবারের সাথে আলাদা করে চিনি মিশেয়ে খাওয়া স্বাস্থ্যকে নানা রকম ক্ষতির সম্মুখীন করে। এছাড়াও সাদা চিনি আমাদের খাবারের প্রতি আসক্তি ও রুচি বাড়িয়ে দেয়। দাঁতের এনামেল ক্ষয় করে, আর এতে ক্যালরি অনেক থাকলেও আঁশ, ভিটামিন, খনিজ ইত্যাদি দরকারি উপাদান নেই বললেই চলে।
আমাদের যে কোন খাবারেই মধ্যেই রয়েছে চিনি তা প্রাকৃতিকভাবেই আমরা পাই। সুতরাং এরপরও আলাদা করে মিষ্টি খাওয়া বিশেষ করে সাদা চিনি খাওয়া শরীরের জন্য যথেষ্ট ক্ষতিকর। কারন বাড়তি চিনি শরীরে চর্বি হিসাবে জমা হতে থাকে। কারন চিনি ক্ষিদা বাড়ায়। ফলে বেশি খাওয়ার ফলে দ্রুত ওজন বৃদ্ধি পায়।
সুস্থ ও প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মানুষ দিনে তিন থেকে চার চামচের বেশি চিনি খাওয়া ঠিক না। তবে চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার বেশি খাওয়া উচিত নয়। চিনির বিকল্প হিসাবে আমরা মধু, লো ক্যালরি সুগার, গুড় ইত্যাদি খেয়ে থাকি। কিন্তু কোন রকম মিষ্টিই স্বাস্থ্যকর না। তাই আমাদের কম চিনি বা মিষ্টি খাওয়ার অনুশীলন করা উচিত।