যেসব ১২ টি খাবারে প্রজনন ক্ষমতা বাড়ে!
প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গর্ভধারণের চেষ্টা করার সময় প্রোটিন, প্রয়োজনীয় চর্বি, খনিজ এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার অবশ্যই থাকা উচিত।
পৃথিবীতে এমন অসংখ্য দম্পতি রয়েছে যারা প্রজনন অক্ষমতার জন্য নিঃসন্তান জীবন যাপন করেন। পুরুষ ও নারীর প্রজনন অক্ষমতা অনেকগুলি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্যে উপস্থিত গুণাগুণ তার মধ্যে একটি। প্রজনন ক্ষমতা ও রোজকার খাদ্য তালিকা একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। আমাদের ডায়েট চার্ট ও তার উপাদান সমূহের আমাদের জননেন্দ্রিয়র উপর সরাসরি প্রভাব রয়েছে। আসুন প্রজননে সহায়ক খাদ্যগুণ রয়েছে এমন কিছু খাবারের কথা জেনে নেই -
আয়রন বা লৌহ সমৃদ্ধ খাবার
হিম (Heme) নামক লৌহঘটিত যৌগ থাকে এমন খাবার মহিলাদের ডিম্বাণু গঠনে সাহায্য করে। মুরগীর মাংস, রেড মিট অর্থাৎ গরু কিংবা খাসীর মাংসে এই উপাদান অধিক পরিমাণে পাওয়া যায়।
সবুজ শাকসবজি
পালং শাক, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকলি ইত্যাদি সবুজ শাক সব্জিতে বিভিন্ন প্রজনন উপযোগী ভিটামিন ও মিনারেল থাকে। তাদের মধ্যে ভিটামিন বি৬ (B6) অন্যতম যা শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
সূর্যমুখী বীজ
সূর্যমুখী বীজে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ই (Vitamin E)। পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ভিটামিন ই খুবই জরুরি। ভিটামিন ই শুক্রাণুর পরিমাণ ও শুক্রাণুর সঞ্চালন ক্ষমতা বাড়ায়। শুক্রাণুতে থাকা ডিএনএর গঠন উন্নত করে।
এক আউন্স পরিমাণ সূর্যমুখী বীজে থাকে-
-
দেহের নিয়মিত প্রয়োজনের ৪৯% ভিটামিন ই
-
নিয়মিত প্রয়োজনের ৩১% সেলেনিয়াম
এছাড়াও এতে থাকে জিংক ও ফলিক এসিড। এমনকি ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড (omega 3) এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড (omega-6) প্রচুর পরিমাণে থাকে।
বাংলাদেশে সূর্যমুখী বীজের ব্যবহার অতটা প্রচলিত না হলেও সূর্যমুখী তেল সহজলভ্য। রান্নায় সয়াবিন কিংবা সরিষার তেলের বদলে সূর্যমুখী তেল ব্যবহার করতে পারেন। যারা নিয়মিত সালাদ খান, তারা সালাদে মিশিয়ে সূর্যমুখী বীজ খেতে পারেন।
বাতাবি লেবু এবং কমলার রস
তাজা ফলের রসে নানা ধরনের পুষ্টিগুণ থাকে। তা তো আমরা সবাই জানি। বাতাবি লেবু যা আমাদের কাছে জাম্বুরা নামে পরিচিত তার রস এবং কমলার রস এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এতে প্রচুর পরিমাণে পলি অ্যামাইন প্রুট্রেসিন থাকে যা সিমেনের গুণগত মান বজায় রাখতে সাহায্য করে। প্রুট্রেসিন ডিম্বাণুতে ক্রোমোজোমাল ত্রুটির সম্ভাবনা প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনে। শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর ক্রোমোজোমের স্বকীয়তা বজায় রাখে।
এসব ফলের রসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে। ভিটামিন সি মহিলাদের শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখে।
প্রতিদিন অথবা দুইদিন পর পর খাদ্যতালিকায় বাতাবিলেবু অথবা কমলা অথবা অন্য যেকোনো লেবু জাতীয় সাইট্রাস ফল রাখার চেষ্টা করুন। ফলের রস খেতে পারেন, স্মুথি বানিয়ে খেতে পারেন, চাইলে সালাদে ব্যবহার করতে পারেন। কিংবা আস্ত ফলটাই খোসা ছাড়িয়ে খেয়ে নিতে পারেন।
চিজ বা পনির
পিজ্জা, পাস্তা কিংবা বার্গারের সাথে চিজ তো আমরা হরহামেশাই খেয়ে থাকি। কিন্তু আপনি জানেন কি এই চিজ বা পনির প্রজনন ক্ষমতার উপর কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে?
বাতাবিলেবু কিংবা কমলার মতই এতে থাকে পলি অ্যামাইন প্রুট্রেসিন। যা মহিলাদের বিশেষ করে পঁয়ত্রিশোর্ধ মহিলাদের প্রজনন ক্ষমতার জন্য খুবই উপকারী।
তবে খাবারে পনির যোগ করার আগে এটা খেয়াল রাখতে হবে যে, পনিরে প্রচুর পরিমাণে ক্যালোরি ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে। তাই কোনো অবস্থাতেই অতিরিক্ত পনির খাওয়া যাবে না।
ননীযুক্ত দুধ, দই এবং আইসক্রিম
আইসক্রিম খেতে কার না ভালো লাগে? দুধ ও বিভিন্ন দুগ্ধজাত খাবার যেমন দই, মাঠা, আইসক্রিম, আগেই উল্লেখিত পনির - সবই মহিলাদের ডিম্বপাতে ভূমিকা রাখে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মহিলারা ননীযুক্ত অর্থাৎ ফুল ক্রিম দুধ, দই, ছানা ও অন্যান্য দুগ্ধজাত খাবার খায় তাদের ডিম্বপাত সংক্রান্ত সমস্যা তুলনামূলক কম হয়ে থাকে।
যারা ডিম্বপাত তথা প্রজনন সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছেন, তাদের অবিলম্বে খাদ্যতালিকায় ননীযুক্ত দুধ যোগ করা উচিত। যদি আপনি লো ফ্যাট দুধ বা ইয়োগার্ট খেতে অভ্যস্ত হন, তবে চেষ্টা করুন সপ্তাহে অন্তত একবার ফুল ফ্যাট আইসক্রিম খাওয়ার।
কলিজা
মুরগি, খাসী কিংবা গরুর কলিজাতে এমন অনেক পুষ্টিগুণ থাকে যা আমাদের প্রজনন ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে।
এতে প্রচুর ভিটামিন এ, ভিটামিন বি - যেমন ভিটামিন বি-১২, রিবোফ্লাভিন, ফলিক এসিড, সেলেনিয়াম থাকে। থাকে কোলিন (Choline) যা শিশুর বিভিন্ন জন্মগত ত্রুটি কমাতে সাহায্য করে, জিংক যা সিমেনের গুনগত মান বাড়ায়, কোএনজাইম Q10 যা ডিম্বাণুর মান এবং শুক্রাণুর সঞ্চালন বাড়িয়ে তোলে।
টমেটো, টমেটো সস কিংবা টমেটো স্যুপ
প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এমন একটি উপাদানের নাম লাইকোপেন যা এক ধরনের এন্টি অক্সিডেন্ট। রান্না করা টমেটোতে এটি প্রচুর পরিমাণে থাকে।
লাইকোপেন মূলত পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। পুরুষের বন্ধ্যাত্ব বা প্রজনন অক্ষমতার সম্ভাব্য চিকিৎসার মধ্যে লাইকোপেন সাপ্লিমেন্টেশন অন্যতম। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ৪ থেকে ৮ মিলিগ্রাম লাইকোপেন এক বছর ধরে সেবন করলে সিমেনে শুক্রাণুর উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়।
প্রশ্ন হলো, কাঁচা টমেটো নাকি রান্না করা টমেটো? যদিও কাঁচা টমেটোতেও লাইকোপেন থাকে, কিন্তু সমপরিমাণ রান্না করা টমেটোতে কাঁচা টমেটোর প্রায় দ্বিগুণ লাইকোপেন থাকে। তাই এক বাটি টক ঝাল টমেটোর স্যুপ শুধু যে আপনার মনকে চাঙ্গা করে তোলে তাই নয়, সাথে সাথে এতে থাকা পুষ্টিগুণ আপনার জননেন্দ্রিয়ের জন্যও অত্যন্ত উপকারী।
ডাল এবং মটরশুঁটি
ডাল এবং মটরশুঁটিতে প্রজননে সহায়ক কিছু পুষ্টিগুণ রয়েছে।
ডালে উচ্চমাত্রায় পলি অ্যামাইন স্পার্মিডিন থাকে যা শুক্রাণু দ্বারা ডিম্বাণু নিষিক্তকরণে সহায়তা করে। ডাল এবং মটরশুঁটিতে ফলিক এসিড থাকে। ফলিক এসিড গর্ভধারণ এবং সুস্থ সবল ভ্রূণের বিকাশে প্রধান ভূমিকা পালন করে। এইজন্য গর্ভাবস্থায় ফলিক এসিড সাপ্লিমেন্টেশন দেয়া হয়। ডাল ও মটরশুঁটিতে আঁশ থাকে যা হরমোনাল ভারসাম্য বজায় রাখে।
আর তাই গর্ভধারণে ইচ্ছুক মহিলা এবং গর্ভবতী মায়েদের খাদ্যতালিকায় নিয়মিত ডাল এবং মটরশুঁটি থাকা উচিত।
ডালিম / আনার / বেদানা
ডালিমের রস এবং বীজ দুটিরই অসংখ্য পুষ্টিগুণ আছে। এতে প্রচুর এন্টি অক্সিডেন্ট থাকায় তা শুক্রাণুর ঘনত্ব এবং সঞ্চালন দুইই বাড়ায়।
বিশেষ করে পঞ্চাশোর্ধ পুরুষদের ক্ষেত্রে শুক্রাণুর পরিমাণ ঠিক থাকলেও সঞ্চালন ক্ষমতা এবং ঘনত্ব কমতে থাকে। এন্টি অক্সিডেন্ট যুক্ত ডালিমের রস এক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম বলে এক গবেষণায় জানা গেছে।
আখরোট
আখরোটে রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড যা প্রজনন স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
এক গবেষণায় ১১৭ জন পুরুষকে দুটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। একটি কন্ট্রোল গ্রুপ, আরেকটি পরীক্ষামূলক বা এক্সপেরিমেন্টাল গ্রুপ। কন্ট্রোল গ্রুপকে রোজকার সাধারণ খাবার খেতে বলা হয়। আর এক্সপেরিমেন্টাল গ্রুপকে সাধারণ খাবারের পাশাপাশি নিয়মিত ৭৫ গ্রাম পরিমাণ আখরোট খেতে বলা হয়। ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এক্সপেরিমেন্টাল গ্রুপের সিমেনে শুক্রাণুর উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে, শুক্রাণুর গঠন ও সঞ্চালন উন্নত হয়েছে। তাই রোজকার ডায়েটে আখরোট এবং অন্যান্য বাদাম জাতীয় খাদ্য যোগ করা উচিত।
ডিম
ডিম এবং বিশেষভাবে ডিমের কুসুম গর্ভধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ বহন করে।
প্রজননে সহায়ক ভিটামিন-বি যা ডিমে প্রচুর পরিমাণে থাকে। এছাড়াও থাকে ওমেগা থ্রি ও কোলিন। ডিম প্রাণীজ প্রোটিনের খুব ভাল উৎস। যা পুরুষ ও মহিলা উভয়েরই প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
দারুচিনি
দারুচিনি আমাদের দেশের রান্নায় গরম মশলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই বিশেষ মশলাটি নানান ঔষধি গুণে পরিপূর্ণ।
একটি র্যান্ডম ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে, নিয়মিত দারুচিনি খেলে তাতে রক্তের গ্লুকোজ লেভেল কমে, ট্রাইগ্লিসারাইড এবং LDL কোলেস্টেরল কমে এবং সর্বোপরি মোট কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমে যায়। এছাড়াও ট্রায়াল অনুসারে, পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম থাকা মহিলারা নিয়মিত দারুচিনি খেলে তাদের রজ:চক্র এবং ডিম্বপাত নিয়মিত হয়।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির সেরা ১০ টি খাবার। [পর্ব - ১]
গর্ভাবস্থার প্রথম মাস : মাতৃত্বের প্রথম স্বাদ
এড়িয়ে চলুন বিশেষ কিছু খাবার
কিছু কিছু খাবার আছে যা প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করে। তাই গর্ভধারণে ইচ্ছুক কিংবা গর্ভাবস্থায় বিশেষ কিছু খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। যেমন :
-
প্রক্রিয়াজাত / টিনজাত খাবার
-
অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার
-
ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়
-
সয়াবড়ি
-
কৃত্রিম রঙ অথবা কৃত্রিম ফ্লেভারযুক্ত খাবার
-
অ্যালকোহল
প্রজনন অক্ষমতা কিংবা বন্ধ্যাত্ব একটি মাল্টি ফ্যাক্টোরিয়াল বিষয়। খাদ্যাভ্যাস তার মধ্যে অন্যতম। বিষয়টা এমন নয় যে, কোনো নির্দিষ্ট খাবার খেলেই গর্ভধারণ নিশ্চিত ও নির্বিঘ্ন হবে। কিংবা কোনো বিশেষ খাবার খেলে আপনি গর্ভধারণে অক্ষম হয়ে পড়বেন বা শুক্রাণুর অনুপস্থিতি বা অস্বাভাবিকতা দেখা দেবে।
অস্বাস্থ্যকর খাবার, বিভিন্ন ধরনের জাংক ফুড, ফাস্ট ফুড থেকে স্থূলতা দেখা দেয়। এই অতিরিক্ত ওজন প্রজনন স্বাস্থ্যকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। আবার প্রজনন ব্যবস্থায় হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখা খুবই জরুরী। কিছু বিশেষ ভিটামিন ও মিনারেল এই কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে। এই বিশেষ 'ফার্টিলিটি সুপারফুড'গুলি আপনার রোজকার খাদ্যতালিকায় যোগ করলে আপনার প্রজনন স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে সেই সাথে প্রজনন অক্ষমতাও অনেকাংশে কমে আসবে। তাই আর দেরি না করে আজ থেকেই এসব খাবার নিয়মিত খাবার চেষ্টা করুন