বর্ষাকালের ডায়েট - সুস্থ থাকতে করণীয়
বর্ষাকাল মানেই রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। এই সময়টাতে আমরা কী খাই এবং কি পান করি সে ব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্ক থাকা খুবই জরুরি। তাই এই ঋতুর সৌন্দর্যকে উপভোগ করার জন্য আপনার জন্য আজ থাকছে বর্ষার ডায়েট প্ল্যান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।

বর্ষা মৌসুমে প্রকৃতিতে একটা স্নিগ্ধ পরিবেশ বিরাজ করে। এই সময় অনেক বেশি ঝড় বৃষ্টির সাথে একটা ভ্যাপসা গরমের অনুভূত হয়ে থাকে। তথাপি এই সময় রোগ জীবাণুর প্রাদুর্ভাবও বেড়ে যায় অনেকাংশে। আর তখন খাওয়া-দাওয়া থেকে সব কিছুতেই বাড়তি সতর্কতা মেনে চলতে হয়। মূলত বর্ষাকালে কি খাবার খাবেন, কি বাদ দিবেন, খাদ্যতালিকা কেমন হবে, কোন খাবারে পুষ্টিগুণ বেশি এবং কোন খাবার ক্ষতিকর তা জানতে আজকের লেখাটি আপনার জন্য খুবই কার্যকরী।
বর্ষাকালের স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকার গুরুত্ব
বর্ষাকালে আপনার খাদ্যতালিকা তৈরিতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এইসময় আপনার খাদ্যতালিকা কেমন হবে তা জানতে একজন পুষ্টিবিদের সহায়তা নিতে পারেন। কেননা এই সময় কোন খাবারগুলো আপনার শরীরের জন্য উপকারী এবং কোনগুলি ক্ষতিকারক তা জানা প্রয়োজন। মূলত টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বর্ষাকালে কিছু খাবার স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে এবং সংক্রমণও ছড়াতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রতিবেদনটিতে বর্ষার সময় কিছু খাবার যেমন- নির্দিষ্ট কিছু শাক, ভাজাপোড়া, সামুদ্রিক মাছ, মাশরুম, কোল্ড ড্রিংকস, রাস্তার খাবার ইত্যাদি এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আবহাওয়ার সাথে সামঞ্জস্য করে পুষ্টির চাহিদা পূরণ
বর্ষাকালে আপনার পুষ্টির চাহিদা মেটাতে যেসব খাবার খাওয়া উচিত, তা জেনে নেওয়া প্রয়োজন। এই সময় আবহাওয়ার সাথে সামঞ্জস্য করে ডায়েট চার্ট তৈরি করতে পারলে ভালো হয়। মূলত বর্ষাকালে পুষ্টির চাহিদা পূরণ এবং রোগ প্রতিরোধ করতে-
-
প্রোটিনযুক্ত খাবার
-
অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ ফলমূল
-
ফাইবার বা আঁশ যুক্ত খাবার ইত্যাদি খেতে হবে।
সেক্ষেত্রে ডাল, ডিম, বাদাম, চেরি, জাম, খেজুর, কিশমিশ, কাজু বাদাম, কাঠ বাদাম ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
রোগ প্রতিরোধী ও শক্তি বৃদ্ধিকারী যে খাবারগুলো খাদ্যতালিকায় রাখবেন
বর্ষাকালে আপনার শরীরের শক্তি বৃদ্ধি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন যুক্ত খাবার খেতে হবে। এই সময় আপনার খাদ্যতালিকায় সুষম খাবার যুক্ত করতে হবে। সেক্ষেত্রে এই সময় যেসব খাবার খেতে পারেন-
১. টক জাতীয় ফলমূল
সাধারণত লেবু, লটকন, কমলা, আমড়া, কামরাঙ্গা, আঙ্গুর ইত্যাদি সাইট্রাস ফল ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার। এই ফলমূলগুলি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে পরিচিত। আর তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এমনকি এই ধরনের ফলমূল শ্বেত রক্তকণিকা উৎপাদনকে উদ্দীপিত করে, রোগ ও সংক্রমণ প্রতিরোধ করে থাকে। এছাড়াও এই সাইট্রাস ফলের ক্ষারীয় বৈশিষ্ট্য দেহে স্বাস্থ্যকর পিএইচের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।
২. স্বাস্থ্যকর চা
চায়ে থাকা বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদ-রাসায়নিক উপাদান যেমন, পলিফেনলস এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের শরীরকে ইনফেকশনজনিত রোগ থেকে দেহকে সুরক্ষা দেয়। আর তাইতো বর্ষাকালে আদা চা, গ্রিন টি, তুলসী চা, মসলা চা ইত্যাদি পান করতে পারেন।
মূলত গ্রিন টি তরল শরীরের বিভিন্ন অংশের কর্মক্ষমতা বাড়ায় এবং ওজন কমায়। এই উচ্চমাত্রার অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ তরল পানীয় আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ ভুমিকা পালন করে থাকে।
৩. বেরি জাতীয় ফলমূল
সাধারণত বেরি জাতীয় ফলমূল যেমন- জাম (ব্ল্যাক বেরি), স্ট্রবেরি, লটকন, আমলকি (গুস বেরি), ব্লুবেরি, চেরি ইত্যাদি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ এবং তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মূলত এইসব ফলে চিনির পরিমাণ কম থাকে। এছাড়াও এই ধরণের ফলমূল ফাইবার বা আঁশ যুক্ত এবং যা বর্ষাকালে স্বাস্থ্যকর পিএইচ ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে উপকারী ভূমিকা পালন করে।
৪. সবুজ শাক-সবজি
এই মৌসুমে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি কিংবা মিনারেল যুক্ত শাকসবজি যেমন- বিভিন্ন ধরণের শাক, লাউ, পটল, করল্লা, চালকুমড়া, কাকরোল, পেপে, শসা, বড়বাটি, মিষ্টি কুমড়া, কচু, বিটরুট, ঝিঙে, শশা, ঢেড়স প্রভৃতি বেশি করে খাওয়া উচিত। মূলত নিয়মিত ভাবে এই শাকসবজি গুলো খেলে তা আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে এবং হজমশক্তি উন্নত করতে সহায়তা করবে।
৫. স্যুপ জাতীয় খাবার
এই বর্ষার সময় স্যুপ একটি উপকারী খাবার। সেক্ষেত্রে টেস্টিং সল্ট বাদ দিয়ে ডিম বা মুরগী, আদা, রসুন এবং বিভিন্ন সবজি দিয়ে স্যুপ রেঁধে খেতে পারেন।
৬. পেঁয়াজ এবং টমেটো
সাধারণত পেঁয়াজ এবং গ্রীষ্মকালীন টমেটো বেশিরভাগ খাবারের মধ্যে দিয়ে খাওয়া হয়। মূলত এগুলো খাবারের স্বাদ এবং স্বাস্থ্য-উপকারী ক্ষারীয় বৈশিষ্ট্য যুক্ত করে থাকে। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ পেঁয়াজ এবং টমেটো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। আর তাইতো বর্ষার সময় এই খাবার দুটো খেলে তা রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধ করতে যেসব খাবার এড়িয়ে চলতে হবে
বর্ষাকালে পানিবাহিত রোগ বেড়ে যায়। তাই, এই সময় পানিবাহিত রোগ থেকে রক্ষা পেতে যেসব বিষয় মেনে চলতে হবে, তা হল-
-
বর্ষাকালে বাইরের বিশেষ করে রাস্তার ধারের ফল অথবা সবজির রস খাওয়া যাবে না। এইসময় বাইরের ফলের রস, ঘোল, কুলফি, আখের রস ইত্যাদি এড়িয়ে চললে ভালো হয়। কেননা এখন রাস্তার ধারের এইসব পানীয় খেলে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
-
বর্ষায় কিছু শাকসবজি যেমন- পুঁইশাক, পালংশাক, ডাঁটাশাক, কলমি শাক, ব্রকলি ইত্যাদিতে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে পেটের সমস্যা থাকলে এই জাতীয় শাকসবজি খাওয়া থেকে বিরত থাকা ভালো।
কেননা বর্ষাকালে গাছের পাতায় পোকামাকড় বেশি থাকে এবং যা খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করা যায় না। আর এর ফলে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সহজেই দেহে প্রবেশ করতে পারে। এমনকি এই জীবাণুযুক্ত শাক আমাদের পাকস্থলীর জন্য খুব বেশি বিপজ্জনক এবং এই কারণে ডায়রিয়া ও খাদ্যে বিষক্রিয়া পর্যন্তও ঘটতে পারে।
তাই এই সময়ে বেছে বেছে শাক খাওয়া উচিৎ। আর খেতে হলে প্রথমে যত্নসহকারে পানিতে পরিষ্কার করতে হবে এবং পরে ভালোভাবে সেদ্ধ করে রান্না করতে হবে।
-
সাধারণত অনেকক্ষণ যাবৎ কেটে রাখা ফলমূল খাওয়া উচিত না। কেননা বাতাসের সংস্পর্শে তার ওপর ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া জন্মায় এবং যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর।
-
বর্ষাকালে বাইরের খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। এই সময় কোল্ড ড্রিংকস খাবেন না। কেননা তা দেহে খনিজের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে থাকে। আর এর ফলে হজমের সমস্যা কিংবা পেটে ইনফেকশনও হতে পারে।
-
সাধারণত খাবার উচ্চ তাপে ভালো করে রান্না করে খেলে ভালো হয়। এক্ষেত্রে বর্ষাকালে কাঁচা ও অর্ধ সিদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। কেননা বর্ষায় এই ধরনের খাবার খেলে জন্ডিস, টাইফয়েড ইত্যাদির আশঙ্কা অনেকটা বেড়ে যায়।
বৃষ্টির দিনে সুস্থ থাকতে প্রয়োজনীয় টিপস
বর্ষাকালে টানা বৃষ্টিতে গরম থেকে স্বস্তি মিললেও ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, টাইফয়েডের মতো রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। সেজন্য এমন পরিস্থিতিতে সর্তকতা অবলম্বন করে চলা উচিত। মূলত এই পরিবর্তনশীল ঋতুতে সুস্থ থাকতে কিছু টিপস মেনে চলতে হবে, যেমন-
পানিশূণ্যতা রোধে বেশী করে পানি পান করুন
আমাদের শরীরের প্রায় ৭০ শতাংশই হচ্ছে পানি কিন্তু আমরা এই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টির কথাই ভুলে যাই। বর্ষার সময় আর্দ্রতা বেশী থাকার কারণে আমাদের শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি বের হয়ে যায় এবং অবিরাম ঘাম হতে থাকে।
এই সময়ে লোকেদের পর্যাপ্ত পানি পান না করার একটি কারণ হল তারা ক্রমাগত চারপাশে পানির আধিক্য দেখতে পায়। তাই তারা মনে করে তাদের শরীরেও পর্যাপ্ত পানি আছে। এছাড়াও, তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালের চেয়ে তত বেশি না হওয়ার কারণে তৃষ্ণাটা কম বোধ হয়। তাই পানি বেশী করে পান করুন।
বিশুদ্ধ পানি পান করুন
সাধারণত সবসময় পানি ভালোভাবে ফুটিয়ে পান করা উচিত। কেননা পানি ফুটিয়ে খেলে এতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়ে যায়। এছাড়াও প্রতিদিন সকালে হালকা গরম পানিতে লেবুর রস মিশিয়ে পান করলে, এতে দেহে থাকা ক্ষতিকারক ভাইরাসও দূর হয়ে যাবে।
মৌসুমি ফলমূল খান
আমাদের দেশে বর্ষাকালে প্রচুর পরিমাণে মৌসুমি ফল দেখতে পাওয়া যায় যেমন, আম, কাঠাল, আনারস, লটকন, বিলাতি গাব, পেয়ারা, জাম ইত্যাদি। স্বাস্থ্য ভালো রাখতে আপনারা এই ফলগুলো খেতে পারেন। কেননা এই ফলমূল দেহের সংক্রমণ এবং অ্যালার্জি থেকে রক্ষা করতে বেশ কার্যকরী। এছাড়াও আপনার ইমিউনিটি বাড়াতে এই ফলগুলি দারুণ ভূমিকা রাখে।
কাঁচা খাবার এড়িয়ে চলুন
এইসময় কাঁচা খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। বর্ষাকালে দেহে উপস্থিত মেটাবলিজম অনেকটা ধীরে ধীরে কাজ করে। আর যার কারণে খাবার দেরিতে হজম হয়ে থাকে। সেজন্য এই ঋতুতে বাইরের জুস এবং সালাদ না খাওয়াই ভালো। এছাড়াও এখন দীর্ঘ সময় ধরে কাটা ফলমূল খাওয়া উচিত নয়।
মুখরোচক খাবার খান, স্বাস্থ্যের ক্ষতি না করে
সাধারণত বর্ষাকালে খিচুড়ি এবং তেলে ভাজা খাবার খাওয়ার ইচ্ছা জাগে। এটা আসলে হয় আমাদের হরমোনের কারণে।
কেননা বৃষ্টির দিনে সূর্যের আলো কম থাকায় শরীরে সেরোটোনিন হরমোনের মাত্রা কমে যায়। এই সেরোটোনিন হল একটি নিউরো ট্রান্সমিটার, যা কিনা প্রাকৃতিকগত ভাবে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আবার চর্বিজাতীয় খাবারে উপস্থিত থাকা ট্রিপ্টোফ্যান নামক অ্যামিনো অ্যাসিডের কারণে সেরোটোনিনের বৃদ্ধি ঘটে। আর তাইতো দেহের ভারসাম্য রক্ষা করতে চর্বিজাতীয় খাবার খেতে ইচ্ছা জাগে।
এক্ষেত্রে তেলে না ভেজেও সেই ধরণের খাবার যেমন- তেলে ভাজা সমুচার পরিবর্তে বেকড সমুচা, ছোলার সাথে সালাদ মিক্স করে, আবার পপকর্ন কিংবা মিষ্টি আলু ইত্যাদিও খাওয়া যেতে পারে।
বর্ষাকালে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। আর যার ফলে ফুড পয়জনিং, ইনফেকশন, ডায়রিয়া ইত্যাদি রোগ বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে এই সময় চাল, ডাল, অল্প ঘি এবং সবজি দিয়ে খিচুড়ি খাওয়া যায়। কেননা এই সবজি খিচুড়িতে সব ধরনের ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টস থাকে এবং তা পরিপাকনালীকে সুস্থ-সবল রাখে।
পরিশেষে
স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে আসলে আমাদের কোন কিছুই ভালো লাগে না। আর অসুস্থতার কারণে যদি আপনি বর্ষাটাকেই উপভোগ করতে না পারেন তবে তা ভীষণ মন খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই বর্ষার খাবার নিয়ে বিশেষভাবে সতর্ক থাকুন।