প্যাকেটজাত খাদ্যের যে ৫টি উপাদান আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক

যে কোন প্যাকেটজাত খাদ্যের পেছনের অংশটি পড়লে আপনি খুব সহজেই এর উপাদান সমূহ জানতে পারবেন। কিন্তু শুধু জানলেই আপনি বিপদ এড়াতে পারছেন না বরং যে কোন প্যাকেটজাত খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয় বেশ অনেকগুলো উপাদান যার প্রায় অর্ধেকের বেশি উপাদান আপনার শরীরের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই আসুন এই সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই যাতে পরবর্তিতে কোন খাবারের গায়ে তা লেখা থাকলে সেটা সহজেই বুঝতে পারি।

আমরা অনেক সময়ই বিভিন্ন প্যাকেটজাত খাবারের প্যাকেটে উপাদানের লিস্ট পড়ে দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু দেখা যায় বেশিরভাগই অপরিচিত মনে হচ্ছে, যেমন ধরুন মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট। এমন খটমটে নামের কিছু পারমানবিক বোমা তৈরির কাজে লাগলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই, সেখানে কিনা সামান্য চিপ্সের প্যাকেটে লেখা!

আসলে বর্তামানে এমন একটা সময়ে আমরা দাঁড়িয়েছি যেখানে প্যাকেটজাত ও প্রস্তুতকৃত খাবার যেন আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশের মতই হয়ে গেছে। আপনি যখন একটা কুকি বিস্কিটের প্যাকেট কিনে খাচ্ছেন, আপনি জানেন না যে তাতে কি পরিমাণ ফ্যাট, প্রোটিন আর কার্বোহাইড্রেট আছে! আবার আপনি হয়ত ভাজা পোড়া কিছু খেলে স্বাস্থ্য সচেতনভাবে টিস্যু দিয়ে অতিরিক্ত তেল মুছে খাওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু প্রস্তুতকৃত বা প্যাকেটজাত খাবারে কতটুকু ফ্যাট, কার্বহাইড্রেট আছে তা নিয়ে খুব একটা সঙ্কিত হতে দেখা যায় না। 

এতে সমস্যা হলো, কি পরিমাণ ক্যালোরি গ্রহণ করছেন আর কোন খাদ্য উপাদান কি পরিমানে গ্রহণ করছেন তা অজানাই থেকে যায়। যার ফলে হতে পারে দ্রুত ওজন বৃদ্ধি, হৃদরোগ, ডায়বেটিস ও অন্যান্য ক্রোনিক ডিজিজ। 

চলুন বিস্তারিত আলোচনার আগে আমরা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল খাবারের নেপথ্যের কিছু কথা জেনে আসি।

ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল খাবারের নেপথ্যে

কখনো ভেবে দেখেছেন? বাসায় যখন কিছু রান্না করছেন তা ফ্রিজে না রাখলে এক-দুই দিন এর বেশি ভালো থাকছে না। কিন্তু অনেক প্রস্তুতকৃত খাবার প্রায় বছরখানিক ভালো থাকে! এই ভালো থাকার নেপথ্যে রয়েছে অনেক রকম প্রিজারভেটিভ। প্রিজারভেটিভ হলো এমন উপাদান যা খাবারের রং, গন্ধ, আকৃতি অনেক দিন ধরে ভালো রাখে ও ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক এর কারণে নষ্ট হওয়া রোধ করে। 

কারখানায় বানানো খাবারের মূল লক্ষ্য থাকে ব্যাবসায় লাভবান হওয়া। সে কারণে খাবারকে আকর্ষণীয় রাখতে ব্যাবহার হয় ফুড কালার ও ফুড ফ্লোভার। তার কোনটা হয়ত প্রাকৃতিক উপাদান থেকে, আবার কোনটি কৃত্রিম ভাবে।

তাহলে আমরা কারখানায় তৈরি খাবারের ভেতর এমন তিনটি উপাদান পাচ্ছি যা সাধারণত আমাদের স্বাভাবিক খাবারে থাকে না। তা হলো-

  • প্রিজারভেটিভ,

  • ফুড কালার ও

  • ফুড ফ্লেভার। 

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বেশিরভাগ প্রিজারভেটিভ, ফুড কালার ও ফুড ফ্লেভার মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কোনটি এলার্জি তৈরি করে, কোনটিতে ক্যান্সার উৎপন্নকারী উপাদান আছে, কোনটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে, কোনটি আবার কোন না কোন রোগের সাথে সংযুক্ত। 

হ্যাঁ মানসম্মত প্রিজারভেটিভ, ফুড কালার ইত্যাদি যে নেই তা নয়, কিন্তু ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালি লাভবান হতে হলে স্বল্প মূল্যের প্রডাক্ট ব্যাবহার করাটাই তাদের কাছে অধিক যুক্তিযুক্ত। বিশ্বজুড়ে খাবারের বিলিওন ডলারের ইন্ড্রাস্ট্রি গড়ে উঠেছে, এবং তারা এত শক্তিশালি, বিশ্ব খাদ্য সংস্থাকেও কোন ক্ষতিকর খাদ্য উপাদান বাদ দিতে হলে তাদের সাথে অনেকদফা সম্মেলনে বসতে হয়। আরো খারাপ ব্যপার হচ্ছে কারখানায় তৈরি খাবার গুলো শিশুদের জন্য বেশি খারাপ হয়ে থাকে, আর শিশুরাই এই ধরণের খাবারের উপর বেশি আকর্ষিত হয়। 

ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল খাবারের সাধারণ ক্ষতিকর উপাদান 

চলুন এবার প্রস্তুতকৃত খাবারে কোন কোন সাধারণ উপাদান গুলো আমাদের স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে তার একটি তালিকা করা যাক।

১. ট্রান্স ফ্যাট

ট্রান্স ফ্যাট একধরণের ক্ষতিকর ফ্যাট যা তেলের সাথে হাইড্রোজেন যোগ করে তৈরি করা হয়। এটি দেহে খারাপ কোলেস্টেরল এর মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। বিশ্বজুড়ে হার্টের রোগ বেড়ে যাওয়ার সবচাইতে বড় কারণ হলো ট্রান্সফ্যাট। আশঙ্কার ব্যাপার হলো আমাদের খাবারের অধিকাংশই  ট্রান্সফ্যাট রয়েছে। প্রাকৃতিক ভাবে রেড মিটে ট্রান্সফ্যাট থাকে। কিন্তু ভোজ্য তেল, দুগ্ধজাত খাবার, বেকারী, তেলে ভাজা যেকোনো খাবার ও ফাস্টফুডে অত্যান্ত বেশি পরিমাণে ট্রান্স ফ্যাট থাকে যা আমাদের দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর ফলে হৃদরোগ, ডায়বেটিস, স্ট্রোক সহ বিভিন্ন জটিল রোগ আমাদের দেহে বাসা বাঁধে। ট্রান্স ফ্যাট নিয়ে বিস্তর ভাবে জানানোর জন্য পুরো একটা প্রবন্ধই প্রয়োজন। আপাতত জেনে রাখুন, যেকোন তৈলাক্ত ও বেকারীতে তৈরি খাবারই ক্রোনিক ডিজিজ তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

২. টেস্টিং সল্ট

টেস্টিং সল্ট আমাদের দেশে বিভিন্ন প্যাকেটজাত খাবারে ব্যাবহার করা হয়। এমনকি বিভিন্ন খাবারের রেসিপিতেও টেস্টিংসল্ট বিদ্যমান। এরই বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট। খুব বেশি পরিমাণে টেস্টিং সল্ট গ্রহণ করলে অসুস্থ্য হয়ে পড়তে পারেন। এটি মস্তিষ্কের স্বাভাবিক সিংগনালিং এ বিঘ্ন ঘটাতে পারে  তাছাড়াও এটির সাথে ওজন বৃদ্ধি ও ক্যান্সার হওয়ারও যোগসূত্র নিয়ে বিতর্ক আছে। 

৩. প্রিজারভেটিভ

প্রিজারভেটিভ ছাড়া কোন প্যাকেটজাত খাবার নেই। আর এমন খুব কম প্রিজারভেটিভ আছে যা ক্ষতিকর নয়। আসুন কয়েকটা খুব সাধারণ প্রিজারভেটিভ সম্পর্কে জেনে নেই।

সোডিয়াম বেনজনেট 

কার্বোনেটেড ড্রিংক, সস, মেয়োনিজ, জ্যাম এ ধরণের খাবারে প্রায়সয়ই সোডিয়াম বেনজনেট প্রিজারবেটিভটি ব্যাবহার করা হয়। এই প্রিজারভেটিভটি অনেকের ক্ষেত্রে এলার্জি তৈরি করতে পারে। তাছাড়াও বাচ্চাদের ক্ষেত্রে হাইপারএক্টিভিটি ও মনোযোগের সমস্যা তৈরি করতে পারে।

পটাশিয়াম নাইট্রেট

প্রসেসড মিট প্রডাক্টে পটাশিয়াম নাইট্রেট একটি অন্যতম পিজারভেটিভ। দীর্ঘ সময় এটির ব্যাবহারে পাকস্থলীতে ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

এছাড়াও যেকোনো nitrates, benzoates, sulfites, sorbates, parabens, formaldehyde, BHT, BHA জাতীয় প্রিজারভেটিভ শরীরের বিভিন্ন রোগ সৃষ্টির কারণ হতে পারে।

৪. ফুড কালার

বর্তমানে বাইরে প্রস্তুতকৃত খাবার গ্রহণ করে কৃত্তিম ফুড কালার থেকে বেঁচে থাকা সহজ নয়। সাধারণত যে খাবারটিতে ফুড কালার ব্যাবহার করা হয়না বলে মনে হয়, তাতেও কিছু না কিছু ফুড কালার থাকে। বিস্কুট, চ্যানাচুর, চিপ্সসহ বেশিরভাগ খাবারেই রয়েছে এর ব্যাবহার। আর বাচ্চাদের খাবার যেমন চকলেট, আইসক্রিম, ক্যান্ডিতে তো ফুড কালার এর ছড়াছড়ি। সাধারণত যদি সঠিক নিয়ম মত ফুড কালার ইউজ করা হয় তবে বিপদের ঝুঁকি কমলেও, কিছু কিছু ফুড কালারে ঝুঁকি থেকেই যায়। যেমন, Red 40, Yellow 5, and Yellow 6 ফুড কালারে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কার্সোজেনিক পদার্থ থাকতে পারে। তাছাড়াও বিভিন্ন টিউমার ও অন্যান্য রোগের কারণ হতে পারে Red 3, citrus red, blue 2 ইত্যাদি ফুড কালার। যদিও এতো কিছু মনে রাখার চাইতে সবমিলিয়ে প্রস্তুতকৃত খাবার গ্রহণ যতটা সম্ভব কমিয়ে দেওয়াই কমাতে পারে স্বাস্থ্য ঝুঁকি।

৫. ফুড ফ্লেভার

ফুড ফ্লেভার প্রস্তুতকৃত খাদ্যের দুনিয়ায় এক ম্যাজিকের নাম। কুমড়ার পাল্পে কৃত্তিম রং ও ম্যাংগো ফ্লেভার যোগ করলে হয়ে যাচ্ছে ম্যাংগ জুস! এমনি ভাবে যত কৃত্তিম খাবার আমরা গ্রহণ করি সবকিছুতেই কোন না কোন কৃত্তিম গন্ধ যোগ করা হয়। এসব ফ্লেভার বাড়ানোর উপাদান অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে থাকে। অনেক কৃত্তিম ফ্লেভারের সাথে পরিপাক স্বাস্থ্য, অতি ভোজন এমনকি ক্যান্সার এর যোগসূত্র পাওয়া গেছে। তাই যতটা সম্ভব কৃত্তিম ফ্লেভার যুক্ত খাবার এড়িয়ে স্বাস্থ্যকর প্রাকৃতিক খাবার গ্রহণ করা উচিত।

পরিশেষ

সত্যি বলতে খুব চেষ্টা করলেও একেবারে প্রস্তুতকৃত খাবার বর্জন করা সম্ভব হয় না। যদিও কখনো-সখোনো অল্প পরিমাণে প্রস্তুতকৃত খাবার গ্রহণ করলে তাতে ক্ষতির সম্ভাবনা কম থাকে। কিন্তু সম্পুর্ণভাবে প্রস্তুতকৃত খাবারের উপর নির্ভরশীলতা ডেকে আনতে পারে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা। আসুন রংচঙে বিজ্ঞাপনে না ভুলে নিজেদের খাবার সম্পর্কে সচেতন হই।

 

আরও পড়ুন-

জাঙ্ক ফুডে লুকিয়ে থাকে যে ৬ টি ক্ষতিকর উপাদান

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles