দুধ: একটি সুপারফুড নাকি বিষ? গবেষণা কি বলছে?
দুধ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নাকি খারাপ এই সংক্রান্ত প্রশ্ন আমাদের দেশে খুব প্রচলিত না হলেও, বিশ্বে এটি একটি জনপ্রিয় বিতর্ক। এই প্রবন্ধটিতে এই বিতর্কটিরই মিমাংসা করার চেষ্টা করব। সেই সঙ্গে থাকবে দুধ ইন্ডাস্ট্রি, দুধ খাওয়ার ইতিহাস ও এ সম্পর্কিত আগ্রহ উদ্দীপক তথ্যাবলী। তবে এতটুকু নিশ্চিৎ যে, প্রবন্ধটি পড়ার পরে আপনার দুধ নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যেতে চলেছে।
একটা দৃশ্যপট কল্পনা করুন। বিশ্বজুড়ে ধনেপাতা ব্যাবসায়ীরা একত্রিত হয়ে ঠিক করলেন, ধনেপাতার বিক্রি বাড়িয়ে তোলার জন্য যা যা ব্যাবস্থা নেওয়া যায় তারা করবেন। ফলস্বরুপ হঠাৎ খেয়াল করলেন, সবখানে ধনে পাতার জয়-জয়কার পড়ে গেছে। ডাক্তারেরা বেশি বেশি ধনে পাতা খেতে বলছেন, বিখ্যাত ব্যাক্তিরা মানুষকে ধনেপাতার রেসিপি দেখাচ্ছেন, রাষ্ট্রিয় ভাবে নিয়মিত ধনেপাতা খেতে বলা হচ্ছে। অমক নুডুলস প্রতিষ্ঠান বলছে তাদের নুডুলস ধনেপাতার শক্তি বাড়ায়, তমক স্যুপ প্রতিষ্ঠান বলছে তাদের রেডিমেড স্যুপ ধনেপাতা সমৃদ্ধ ইত্যাদি।
গল্পটা কল্পিত আর উদ্ভট হলেও দুধের বেলায় এমনটাই ঘটছে। দুধ পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী খাবার ইন্ড্রাস্টির মধ্যে একটি। সমস্যা টি হলো, যখন কোন পন্যের প্রচার এত বিশাল ভাবে হয়, তখন এটির খারাপ দিক গুলো ঢাকা পড়ে যেতে থাকে। তবে কেন এত প্রচার? অন্যান্য খাবারের তো এত প্রচারের প্রয়োজন হয় না! আসুন, এর ইতিহাস ও দুধ ইন্ড্রাস্টির পেছনের কিছু কথা জেনেই দুধ ভালো কি খারাপ সেই প্রশ্নে ফিরে যাই।
কেন এই বিতর্ক?
বিশ্বে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ ল্যাক্টোজ ইনটলারেন্স। অর্থাৎ ৭০ ভাগ মানুষ দুধ অথবা দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্য সহজে হজম করতে পারে না। যে সকল মানুষেরা দৈনিক ১৫০ মিলিগ্রাম এর বেশি দুধ হজম করতে পারে না তাদেরকে ল্যাক্টোজ ইনটলারেন্ট বলে।
এত বিশাল সংখ্যক মানুষ যখন দুধ হজম করতে পারে না, সেখানে দুধকে আদর্শ খাবার বলে কেন প্রচার করতে হবে? যেখানে দুধের সম্পুরক অনেক খাবার সমপরিমান পুষ্টিগুন প্রদান করে। প্রশ্নের উত্তরটি খুঁজতে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়।
দুধের ইতিহাস
প্রায় নয় হাজার বছর আগে দক্ষিন আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু অঞ্চলের মানুষ বন্য পশুকে গৃহে পালন করা শুরু করে। সেই থেকেই মানুষ আবিষ্কার করে দুধ একটি পুষ্টিকর খাবার হতে পারে। ধীরে ধীরে মানুষের মাঝে পশুপালনের ঝোঁক বাড়তে থাকে। কিন্তু পৃথিবীর সব জায়গা পশুপালনের জন্য উপযোগী ছিলো না। সব মানুষ পশুপালন করতেও আগ্রহী ছিলো না।
অর্থাৎ হাজার বছর ধরেই সব জাতি ও মানুষ দুধ খেয়ে অভ্যস্ত হতে পারেনি। তবে যে জাতি বা ভূখন্ডের মানুষ পশুপালন তথা দুধ খেয়ে অভ্যস্ত ছিলেন তাদের পাকস্থলি দুধ হজম করার মত ভাবেই বিবর্তিত হয়েছে।
ঠিক এই কারণেই পৃথিবীর প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ ১৫০ মিলি লিটারের বেশি দুধ খেয়ে হজম করতে পারেন না। যদিও বিভিন্ন দেশে দুধ হজমে অক্ষম মানুষের সংখ্যা বিভিন্ন রকম। যেমন আমেরিকায় ২৫ শতাংশ ও চীনে প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষ দুধ হজম করতে পারেন না।
তবে ভালো ব্যাপারটি হলো আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের দেশের মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ দুধ হজমে অক্ষম। যদিও ১০ শতাংশ নিছকই ছোট সংখ্যা নয়। কারণ, আমাদের দেশে প্রয় দেড় কোটি মানুষ দুধ হজমে অক্ষম কিন্তু বেশিরভাগই এ বিষয়টি জানেন না।
দুধ বিপ্লব
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা তাদের দেশ থেকে বিশাল সংখ্যায় সৈন্য পাঠায়। সৈন্যদের প্রয়োজন ছিলো প্রচুর পরিমানে পুষ্টিকর খাবার যা সাগর পেরিয়ে সরবরহ করা যাবে। আমেরিকানরা দুধকে বেছে নিলো। সেখানকার কৃষকেরা দুধের যোগান মেটাতে অন্যান্য পশুপাখি বাদ দিয়ে শুধু গরু পোষা শুরু করলো। যাহোক, যুদ্ধ শেষ হলো, দুধের চাহিদা শেষ হলো। কিন্তু দুধের যোগান রয়েছে প্রচুর। বিশাল একটা ব্যাবসা একদম নিমিষে শেষ হয়ে যাবার যোগাড়।
কিন্তু গরুর ফার্ম মালিকেরা ছিলেন সমাজের কর্তা শ্রেণির লোক, হাতে টাকাও প্রচুর। তাদের একত্রিত চেষ্টায় সরকার দুধের বিক্রির একটি পথ খুঁজতে থাকলো। তারা প্রচার করা শুরু করলো দুধ সবচাইতে পুষ্টিকর খাদ্য। শিশুদের এটা না খাওয়ানো বোকামী। দৈনিক চার গ্লাস করে দুধ খেতে হবে ইত্যাদি। সরকারী ভাবে প্রচার ও বিভিন্ন জনপ্রিয় তারকাদের সহযোগীতায় বিপুল পরিমান দুধ বিক্রি হতে শুরু করলো। তবে এটুকুই যথেষ্ট ছিলো না। তারা সারা বিশ্বে দুধের মার্কেটিং করা শুরু করলো ও দুধ রপ্তানী করা শুরু করলো। এভাবে আমেরিকার দুধ বিপ্লবের ছোঁয়া সারা পৃথিবীতেই দুধের চাহিদা বাড়িয়ে দিলো।
এই ঘটনাটির আগে দুধ খাওয়া যে খুব গুরুত্বপূর্ণ এমনটি কেউ মনে করতো না। বর্তমানেও দুধের নানা রকম বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে দুধ খেতে প্রভাবিত করতে হয় কারণ ডেইরি শিল্পে প্রচুর পরিমাণ বিনিয়োগ হয় এবং এর লাভ নির্ভর করে যথেষ্ট দুধ বিক্রির উপরে।
চলুন এবার দুধের উপকারীতা ও অপকারীতা সম্পর্কে জানা যাক।
আরো পড়ুনঃ লবণের কি আসলে কোন প্রয়োজন আছে?
দুধের উপকারীতা
দুধের পুষ্টিমান যে খুব উন্নত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দুধের উপকারীতার একটা তালিকা দেওয়া হলো:
পুষ্টিমান
এক কাপ দুধ থেকে ১৪৬ ক্যালরি পাওয়া যায়। সাথে প্রটিন, ফ্যাট, ক্যালশিয়াম, ভিটামিন বি ২, ভিটামিন বি ১২, পটাশিয়াম, ফসফরাস ও স্যালেনিয়াম। বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি একসাথে পাওয়া যায় বলে একে আদর্শ খাবার বলা হয়।
আমিষের উৎস
এক কাপ দুধ থেকে ৮ গ্রাম উন্নত মানের আমিষ পাওয়া যায়। তুলনা করলে, একটি ডিম থেকে আপনি পাবেন প্রায় ৫ গ্রাম প্রটিন। দেহ গঠন ও বৃদ্ধিতে আমিষ একটি অপরিহার্য উপাদান।
হাড়ের স্বাস্থ্যে দুধ
হাড়ের সুস্বাস্থের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সবকয়টি উপাদান দুধে রয়েছে। ভিটামিন ডি ও ক্যালশিয়াম হাড়ের পুরত্ব বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। দুধ অস্টিয়পেরেসিস এর ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। যদিও হাড়ের সুস্বাস্থ্যে দুধের ভূমিকা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ।
ওজন হ্রাসে সাহায্য করে
কিছু গবেষণায় দেখা যায় দুধ ওজন হ্রাসে কার্যকরী। ক্যালশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার ওজন হ্রাসে ভূমিকা রাখে। ১৪৫ জন ল্যাতিন শিশুর উপর দুধের ভূমিকা সম্পর্কিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, পরিমিত দুধ বাচ্চাদের ওজন হ্রাসে সহায়ক।
দুধের ব্যবহারযোগ্যতা
সম্ভবত আমাদের খাদ্যে দুধ আর দুগ্ধজাত দ্রব্য যত বেশি ব্যবহার করা হয়, এত বেশি ব্যবহার অন্য কোন উপাদানের নেই। চিজ, ঘি, দই, মিল্ক শেক, ফ্লেভার্ড মিল্ক, চা, কফি তো বটেই, অনেক রান্নাতেও দুধের বহুল ব্যবহার রয়েছে।
তবে দুধে খারাপ কী?
দুধে যতই উপকারী দিক থাকুক, এটি ততটাও আদর্শ খাবার নয় যতটা প্রচার করা হয়।
হাড়ের স্বাস্থ্য
পূর্বে উল্লেখ করেছি দুধে হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণ রয়েছে। এটি সঠিক, কিন্তু তারপরও কিছু বাড়তি কথা থেকে যায়। দুধ ক্যালশিয়াম ছাড়াও প্রটিনের ভালো উৎস। প্রটিন মূলত এমিনো এসিড। আর শরীরকে এই এসিড প্রশমন করতে হয় ক্যালশিয়ামের দিয়ে। আর আমাদের হাড়ের উপাদান হলো ক্যালশিয়াম। অর্থাৎ দুধ ক্যালশিয়াম প্রদান করলেও কিছু ক্যালশিয়াম খরচও করে। অর্থাৎ অতিরিক্ত দুধ পান হাড়ের ভালোর চেয়ে খারাপও করতে পারে।
প্রস্টেট ক্যান্সার
দুধ আর দুধ জাতীয় খাবার প্রস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে তোলে। বিশেষ করে যাদের দুধ হজম করতে সমস্যা হয় তারা নিয়মিত দুধ পান করলে এ ঝুঁকি আরও বেশি।
ল্যাক্টোজ ইনটলারেন্স
পূর্বে উল্লেখ করেছি পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ দুধ হজম করতে পারে না। হজমে অক্ষমতার ফলে নানাবিধ পেটের অসুখ, পাতলা পায়খানা জনিত সমস্যা দেখা দেয়।
কোলেস্টেরল
দুধে বেশ ভালো পরিমানে কোলেস্টেরল থাকে এবং যার সম্পুর্ণটাই ভালো কোলেস্টেরল না। অর্থাৎ দুধ হার্টের রোগের জন্য দায়ী হতে পারে।
বাচ্চাদের অপুষ্টি
এত পুষ্টিকর খাবার থেকে অপুষ্টি হতে পারে? হ্যাঁ পারে। খেয়াল করবেন দুধ খেলে সহজেই পেট ভরে যায়। এতে খেতে অনাগ্রহী বাচ্চারা অন্য কিছু খেতে চাইবে না। ফলাফল, অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাবার যেমন, মাছ, শাকসবজি মাংস এসব খাবারে অনীহা দেখা দেবে। এর ফলে বিভিন্ন প্রকার ভিটামিনের অভাব দেখা দিতে পারে।
দুধে এলার্জি
দুধে পুষ্টিগুনের সাথে বেশ কিছু এন্টিবডি বিদ্যমান যা পশুর বাচ্চার জন্য প্রয়োজনীয়, কিন্তু মানুষের জন্য প্রয়োজন নেই। এ কারণে অনেক মানুষের দুধে এলার্জি জনিত সমস্যা হতে দেখা যায়
এন্টিবায়োটিক
বর্তমানে ডেইরি শিল্প এমন অমানবিক পর্যায়ে চলে গেছে যে, তারা তাদের দুধ ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যে কোন কিছু করতে প্রস্তুত। এত পরিমান দুধের চাহিদা মেটাতে বিকল্প কিছু আছে কিনা সেটাও প্রশ্ন। তবে মূল সমস্যাটি হলো উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রচুর পরিমানে এস্টিবায়োটিক ও হরমোন ব্যবহার করা হয়। যা দুধের সাথেও চলে আশে আমাদের শরীরে।
এন্টিবায়োটিক মূলত ব্যাক্টেরিয়া প্রতিরোধী। প্রতিনিয়ত এমন স্বল্প পরিমানে এন্টিবায়োটিক আমাদের দেহে ঢুকতে থাকলে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্ট ব্যাক্টেরিয়া বর্তমানে একটি বহুল আলোচিত বৈশ্বিক সমস্যা।
ভিডিওঃ এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স: কি এবং কিভাবে হয় এই রেজিস্ট্যান্স?
তবে আমাদের কি করনীয়?
-
দুধ আমাদেন জীবনে বেশ অপরিহার্য একটি খাদ্য। তবে এটিকে আদর্শ মেনে নিয়মিত বেশি বেশি খেতে থাকলে স্বাস্থ্যগত সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে। পরিমিত দুধে সাথে অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ পুষ্টির চাহিদা সম্পুর্ণ রূপে পূরণ করতে পারে।
-
তবে দুধ সবার জন্য নয়। যারা দুধ হজম করতে পারেন না, তাদের দু্ধ খাওয়া থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন।
-
যাদের পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা, হার্টের সমস্যা ও স্থুলতা জনিত সমস্যা আছে তাদের জন্যও দুধ বর্জনীয়।
-
দুধ খাবার ক্ষেত্রে, সম্পুর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে পালন করা গরুর দুধ অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর ও অনেকাংশে ঝুঁকি মুক্ত।
বাচ্চাদের জন্য দুধ কতটা প্রয়োজনীয়?
হজমে সমস্যা না থাকলে বাচ্চাদের দুধ দিতে পারেন, তবে দুধ খাবার অভ্যাস সৃষ্টি না করাই ভালো। দুধ বাচ্চাদের জন্য কখনোই আবশ্যক না। শুধু দুধ খাবার চাইতে কয়েক রকম খাবার একসাথে খেলে বেশি উপকার পাওয়া যায়। ডিম, মিষ্টি আলু, শিমের বিচি, কলিজা, বাদাম ইত্যাদি দেহ গঠনে বেশ উপকারী। হড়ের স্বাস্থ্য ও পরিপূর্ণ বৃদ্ধির জন্য সূর্যের আলো ও খেলাধুলা বহুগুণে বেশি কার্যকর। বাচ্চা দুধ না খেতে চাইলে জোরাজোরি না করে অন্যান্য স্বাস্থ্যকর খাবার দিয়ে পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা উচিৎ।
আরো পড়ুনঃ শিশুর খাদ্যাভ্যাসে পিতা-মাতার ভূমিকা
শেষ কথা, পৃথিবী স্বর্গরাজ্য নয়। প্রতিটি খাবারেরই কিছু খারাপ দিক থাকবে। দুধও তেমন। এর বহুবিধ উপকারীতা থাকলেও সমস্যা গুলো অগ্রাহ্য করা বেকামি। তাই আমাদের উচিৎ, যাই খাই, একটু জেনে বুঝে, পরিমিত খাই।