টেস্টিং সল্ট এর কি উপকারিতা আছে? নতুন গবেষণায় কি বলে!
খাবারকে সুস্বাদু করলেও কিন্তু পূর্ববর্তি গবেষণায় দেখা গেছে যে টেস্টিং সল্টের বেশ কিছু ক্ষতিকর দিক রয়েছে, আবার সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো টেস্টিং সল্টের পক্ষে কথা বলছে। তবে মূল বিষয়টা কি? আপনার কি টেস্টিং সল্ট যুক্ত খাবার ত্যাগ করা উচিত? চলুন বিস্তারিত জানার পর একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে।

টেস্টিং সল্ট কি ক্ষতিকর নাকি পুরোটাই মিথ?
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক খাবারেই টেস্টিং সল্ট একটি সাধারণ উপাদান। চিপস, চ্যানাচুর থেকে শুরু করে সয়া সস, টমেটো সস এমনকি বিরিয়ানি, পোলাও, মাংসের মত সুস্বাদু খাবারের রেসিপিতে টেস্টিং সল্ট থাকে।
কিন্তু ১৯৬০ এর দিকে রবার্ট হো ম্যান নামক এক চাইনিজ-অ্যামেরিকান ডাক্তার একটা চাইনিজ রেস্ট্রুরেন্টে খেতে যান। তিনি রেস্ট্রুরেন্টে খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে তার বেশ অনেক আগে থেকেই টেস্টিং সল্টের ব্যাবহার শুরু হয়, বিশেষত চাইনিজ খাবার গুলোতে টেস্টং সল্টের ব্যবহার খুব বেশি ছিলো। পরবর্তিতে রবার্ট New England Journal of Medicine এ সম্পর্কে একটি চিঠি পাঠান। সেই থেকে বিশ্বজুড়ে টেস্টিং সল্টের উপর সতর্কতা জারি হয়।
যেকোন ফাইভ স্টার হোটেলে কোন খাবারেই টেস্টিং সল্ট ব্যাবহার করা হয় না। এরূপ সতর্কতার মূল কারণ সম্ভবত পরবর্তি কিছু গবেষণা খুব স্পষ্ট ভাবে টেস্টিং সল্টের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেছিলো। যদিও গবেষণা গুলো একদম নিখুঁত ছিলো না। তবে বর্তমানের গবেষণা বলছে একদম উল্টো কথা। তারা বলছেন মানুষের উপর টেস্টিং সল্টের আদৌতে খরাপ প্রভাব নেই। যদিও অল্প কিছু মানুষের জন্য এটি কিছু উপসর্গ দেখাতে পারে এবং তা এমনিতেই সেরে যায়।
এই টেস্টং সল্ট নিয়ে ইন্টারনেটেও এত রকম তথ্যের সমাহার, কোনটা ঠিক কোনটা ভুল সেটাই বুঝে ওঠা মুশকিল। চেষ্টা করব সঠিক তথ্য গুলো তুলে ধরতে। সাথেই থাকুন।
টেস্টিং সল্ট কি?
টেস্টিং সল্টকে সংক্ষেপে বলা হয় MSG যার পূর্ণরূপ হলো Monosidium glutamate. এটি টেস্টিং সল্ট এর রাসায়নিক নাম। খাবারের সুগন্ধ ও স্বাদ বাড়াতে টেস্টিং সল্টের জুরি নেই। Monosodium Glutamate পাওয়া যায় L-glutamic এসিড থেকে যা প্রাকৃতিক ভাবে টমেটো, মাশরুম সহ অন্যান্য অনেক খাবারে পাওয়া যায়।
এটি দেখতে ক্রিস্টালের মত, দানাদার ও গন্ধহীন। পানিতে মেশালে গ্লুটামেট ও সোডিয়াম আলাদা হয়ে যায়। এতে খাবার লবনের চাইতে বেশ অনেক কম সোডিয়াম থাকে, তবে অবশ্যই এটা লবণের পরিবর্তে ব্যাবহার্য নয়।
টেস্টিং সল্টের স্বাদকে Umami বলা হয়। উমামি হলো মিষ্টি, টক, নোনতা ও তিতা স্বাদের সংমিশ্রণ। টেস্টিং সল্টে খাবারে এমন এক ধরণের গন্ধ উৎপন্ন করে, যাতে মনে খাবারটা রান্না করতে সুস্বাদু মাংস ব্যাবহার করা হয়েছে।
চাইনিজ ও জাপানিজ খাবারে টেস্টিং সল্টের ব্যাবহার বেশি, যদিও সারা বিশ্বেই এটি বিভিন্ন প্যাকেটজাত খাদ্য উৎপাদনে ব্যাবহার করা হয়। বাংলাদেশেও যা ব্যতিক্রম নয়। চলুন পরবর্তি অংশে টেস্টিং সল্ট সম্পর্কে মূল বিতর্কে আসা যাক।
টেস্টিং সল্ট বিতর্ক
টেস্টিং সল্ট নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে বেশ অনেক আগে থেকেই বিতর্ক চলে আসছে। পূর্বে টেস্টিং সল্ট নিয়ে গবেষণায় বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির সম্ভাবনা উঠে এসেছে। যদিও সম্প্রতিক গবেষণা বলছে এটি সাধারণত নিরাপদ, যদি ব্যাবহারের পরিমাণ ঠিক থাকে।
স্বাভাবিক ক্ষেত্রে হলে নির্দ্বিধায় আধুনিক বিজ্ঞানের উপর ভরসা রাখা যায়। কিন্তু বুদ্ধিমান সত্তা হিসেবে আমারা কোন কিছুই একেবারে সন্দেহহীন ভাবে মেনে নিতে পারি না। এ কথা বলছি কারণ, টেস্টিং সল্টের সাথে জড়িয়ে আছে অসংখ্য প্যাকেটজাত খাদ্য ও রেস্টুরেন্ট কোম্পানী। বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ২ ট্রিলিওন শুধু প্যাকেটজাত খাবার বিক্রি হয়। বড় বড় রেস্টুরেন্টের ফ্রাইড চিকেন থেকে শুরু করে নামিদামী চিপ্স ও স্ন্যাক্স জাতীয় খাবারে এর বহুল ব্যাবহার আছে। এই খাদ্য উৎপাদন ব্যাবসাহীরা এতোই ক্ষমতাধর, তারা চাইলে বিজ্ঞান সুবিধামত পরিবর্তন করতে পারে কিনা সেটাও সন্দেহাতীত নয়। তাই আপনার মনে এখন প্রশ্ন আসতেই পারে-
-
খাদ্যে টেস্টিং সল্ট ব্যবহার কী ক্ষতিকারক?
-
টেস্টিং সল্ট খাওয়ার কোন উপকারিতা রয়েছে?
চলুন টেস্টিং সল্ট বিতর্কের দুটি দিকই জানা যাক।
পুরোনো গবেষণা কি বলছে?
-
টেস্টিং সল্ট ভেঙে গ্লুটামেট উৎপন্ন হয়। গ্লুটামেট এমন একটি উপাদান যা মস্তিষ্কের সিগনালিং এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টেস্টিং সল্ট গ্রহণে শরীরে গ্লুটামেট এর আধিক্য দেখা দেয়। যার ফলে মস্তিষ্কে অতিরিক্ত স্টিমুলেশনের কারণে স্বাভাবিক সিগনালিং ব্যাহত হয়। ফলস্বরুপ ব্রেইনের নিওরন সেল মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
-
বিভন্ন গবেষণায় বলছে টেস্টিং সল্ট সরাসরি ওজন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। যদিও অন্যান্য গবেষণা এর উল্টো কথাও বলছে। একটি বিষয় নিশ্চিৎ টেস্টিং সল্ট খাবারের স্বাদ বাড়ানোর ফলে অতিভোজনের কারণ হতে পারে। যা ওজন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
-
টেস্টিং সল্ট শরীরের এমন কিছু এন্টি অক্সিডেন্টের কাজে বাধা দেয় যা ক্যান্সার সৃষ্টি রোধ করে। এজন্য ক্যান্সারের ট্রিটমেন্ট নেওয়া পেশেন্টকে কোন প্রকার টেন্টিং সল্ট জাতীয় খাবার থেকে বিরত রাখা হয়।
-
এজমা রোগীদের জন্য টেস্টিং সল্ট এজমা বাড়িয়ে তুলতে দায়ী হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে টেস্টিং সল্ট গ্রহণের ৬ ঘন্টার পর এজমার সমস্যা বেড়ে যায়।
-
টেস্টিং সল্ট মাইগ্রেনের সমস্যা বাড়িয়ে তুলতে দায়ী হতে পারে।
-
ইদুররের উপর গবেষণায় দেখা গেছে, টেস্টিং সল্ট তাদের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করছে। যদিও বর্তমান গবেষণায় দেখা গেছে এটি মানুষের উপর এমন কোন প্রভাব ফেলে না।
অর্থাৎ পুরোনো গবেষণাগুলিতে টেস্টিং সল্ট এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কেই বেশী আলোকপাত করা হয়েছে।
টেস্টিং সল্ট নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা
টেস্টিং সল্ট নিয়ে বর্তমান প্রায় সব গবেষণা বলছে, টেন্টিং সল্টের ক্ষতিকর দিক নিয়ে যে তথ্য গুলো আছে তা মিথ এবং ভিত্তিহীন। হেলথলাইনের মত প্রথম সারির স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট টেস্টিং সল্টের সপক্ষে কথা বলছে।
তাছাড়াও FAO, WHO এর ফুড এডিটিভস কমিটি, Food and Drug Administration ও European Food Safety Association বলছে টেস্টিং সল্ট সাধারণ ক্ষেত্রে নিরাপদ এবং এটি নির্দিধায় ব্যাবহার করা যাবে, তবে অবশ্যই পরিমাণ মত ব্যাবহার করা উচিত।
গবেষণা মতে আপনার দৈহিক ওজনের প্রতি কেজিতে আপনি ৩০ মিলিগ্রাম টেস্টিং সল্ট নিরাপদে গ্রহণ করতে পারবেন, যা সাধারণত যতটুকু আমরা খাবারের সাথে গ্রহণ করি তার অনেক বেশি।
অর্থাৎ দেখতেই পারছেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সংস্থা গুলো বলছে এটি নিরাপদ। যদিও সংস্থা গুলো জাতিসংঘের মত "শান্তির" দূত কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রাখবেন কিনা পাঠকের উপর ছেড়ে দিচ্ছি।
টেস্টিং সল্টের একটি পার্শপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সম্প্রতিক গবেষণা নিশ্চিত করেছে। মোটামুটি ১% মানুষ টেস্টিং সল্ট গ্রহণে অসুস্থ্য হয়ে পড়তে পারে। একে MSG symptom complex (MSC) বলা হয়।
MSG symptom complex
এটি সাধারণত খুব অল্প সংখ্যক মানুষের ভেতর দেখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৩ গ্রাম বা তার বেশি MSG গ্রহণ করলে অসুস্থ্য হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়। যদিও আমাদের সাধারণ খাবারে ০.৫ গ্রামের বেশি MSG থাকে না। MSG symptom complex এর উপসর্গ গুলো হলো,
-
মাথাব্যাথা হওয়া
-
গলা মুখ ও ঘাড় লাল হয়ে যাওয়া, গরম লাগা (ফ্লাশিং)
-
ঘেমে যাওয়া
-
মুখে চাপ অনুভব করা
-
অনুভূতিশুন্য অসাড় বোধ করা
-
বুকে ব্যথা করা
-
বমি বমি ভাব হওয়া
-
দুর্বল বোধ করা
এমন উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। মাথাব্যথার জন্য প্যারাসিটামল ও প্রচুর পরিমানে পানি পান ও বিশ্রাম নিলে দ্রুত সেরে যাবে।
পরিশেষ
টেস্টিং সল্ট নিয়ে বিতর্কে, বলতে গেলে টেস্টিং সল্টের সপক্ষই শক্ত অবস্থানে রয়েছে। বড় বড় স্বাস্থ্য সংস্থ্যা গুলো টেস্টিং সল্টের দুর্নাম গুলো মিথ বলে প্রমাণ করছে। সম্ভবত টেস্টিং সল্ট স্বাস্থ্যকর ও অস্বাস্থ্যকর এর মাঝামাঝি কোথাও অবস্থান করছে। তাই হয়ত নিয়মিত খাবারে টেস্টিং সল্ট না রাখাই উচিত হবে। সেই সাথে কখনোই টেস্টিং সল্ট খাবেন না, এমন পণ করাটাও বোধয় ঠিক নয়। মাঝে মধ্যে উপাদেও খাবারের সাথে পরিমিত টেস্টিং সল্ট গ্রহণ করাই যায়।