জাঙ্ক ফুডে লুকিয়ে থাকে যে ৬ টি ক্ষতিকর উপাদান
আপনি হয়ত জানেন জাঙ্ক ফুড হচ্ছে উচ্চ ক্যালোরি যুক্ত খাবার যা শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ও দ্রুত ওজন বৃদ্ধির জন্য দায়ী এবং শুধু তাই নয়, এটি বিভিন্ন জটিল রোগের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। তবে শুধু উচ্চ ক্যালোরিই বিপদ নয়, এসব খাবারের লুকিয়ে থাকে মারাত্মক ক্ষতিকর কিছু উপাদান যা আমি-আপনি সহ অনেকেরই অজানা।

আদরের সন্তানকে নিয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে আইসক্রিম, চিপস কিংবা চকলেট কিনে দিচ্ছেন, অথবা বাচ্চা কাঁদলে সময়ের অভাবে চিপস, চকলেট বা আইসক্রিম ধরিয়ে দিয়ে শান্ত করছেন। এর ফলে হয়তো আপনি আপনার সন্তানকে সাময়িকভাবে আনন্দ দিতে পারছেন ঠিকই, কিন্তু অজান্তেই তার স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করছেন। কেননা এসব খাদ্যে লুকিয়ে আছে মারাত্মক ক্ষতিকর কিছু উপাদান। এই প্রবন্ধে সেই উপাদান গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
জাঙ্কফুড বা ফাস্টফুড আসক্তি কেন হয়?
জাঙ্কফুডের প্রতি আকর্ষণ মোটামুটি সব বয়সের মানুষের মধ্যেই বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। এর অন্যতম একটি কারণ হলো এসব খাদ্যে চিনির পরিমাণ বেশি থাকে যা গ্রহণের ফলে মস্তিষ্কে ডোপামিন হরমোন নিঃসরণ হয় যার কারণে এসব খাবার গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে যায়। এছাড়াও মানুষ যখন স্ট্রেসে থাকে মন ভালো করার জন্য এ ধরণের খাবার খেয়ে থাকে কিন্তু তারা টেরই পাচ্ছেন না এসব খাবার সাময়িকভাবে মানসিক প্রশান্তি দিলেও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি করছে। চিকিৎসকরা বলছেন প্রতিনিয়ত এসব খাদ্য গ্রহণ করতে থাকলে ডায়াবেটিস, হাইপার-টেনশন ও হার্ট-ডিজিজের মত ভয়াবহ বিভিন্ন রোগকে আপনার শরীর আমন্ত্রণ জানাবে দেহে বাসা বাঁধার জন্য।
মূল আলোচনায় যাবার আগে ফাস্টফুড ও জাঙ্ক ফুড সম্পর্কে একটু ধারণা নেয়া যাক।
জাঙ্ক ফুড কী?
সহজ করে বলতে গেলে জাঙ্ক ফুড হচ্ছে উচ্চ ক্যালোরি সম্পন্ন এবং পুষ্টি গুণহীন কিংবা সামান্য পুষ্টি উপাদান যুক্ত খাদ্য, যাতে ফ্যাট, চিনি এবং লবণের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি থাকে।
অন্যদিকে যেসব খাবার দ্রুত তৈরি এবং পরিবেশন করা হয় সেসব খাবারকে আমরা ফাস্টফুড হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি।
ফাস্ট ফুড এবং জাঙ্ক ফুড কি এক?
ফাস্ট ফুড কিংবা জাঙ্ক ফুডের নাম শুনলে নিশ্চয়ই আপনার চোখের সামনে পিৎজ্জা, বার্গার, পাস্তা ইত্যাদি খাবারের ছবি ভেসে ওঠে। দুটি খাবারের কথা মনে পরলে একই অনুভূতি হওয়া সত্বেও এই দুটি খাবারের মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ফাস্ট ফুড তৎক্ষণাৎ তৈরি করে খাওয়া হয় আর জাঙ্ক ফুড যে কোন সময় খাওয়ার জন্য প্যাকেট-জাত করে সংরক্ষণ করা হয় যেমন আচার, চকলেট, চানাচুর, চিপস, আইসক্রিম, কোমল পানীয় ইত্যাদি। বলা যায় প্রায় সব ফাস্ট ফুডই জাঙ্ক ফুড কিন্তু সব জাঙ্ক ফুড ফাস্ট ফুড না।
কেন ক্ষতিকর উপাদান যোগ করা হয়?
সাধারণত প্রক্রিয়াজাত কিংবা প্যাকেট-জাত খাবার গুলো দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার জন্য বিভিন্ন ক্যামিকেল যোগ করা হয়। এছাড়াও খাদ্যের রং ধরে রাখতে,খাদ্য থেকে বিভিন্ন অণুজীব ধংস করতে, খাদ্যকে আকর্ষণীয় করে তুলতে, ভিন্ন স্বাদ যোগ করতে,খাদ্যকে সতেজ রাখতে সর্বপোরি খাদ্যের গ্রহণ যোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন উপাদান যোগ করা হয়।
জাঙ্ক ফুডের ক্ষতিকর উপাদানগুলো কি কি?
জাঙ্ক ফুডে লুকিয়ে থাকে এমন ক্ষতিকর উপাদানগুলি হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের ক্যামিক্যাল, আর্টিফিশিয়াল সুইটনার, কার্সিনোজেনিক পদার্থ, মাইক্রোপ্লাস্টিক, হেভি মেটাল, বিস্ফোরক পদার্থ। আসুন এই ক্ষতিকর উপাদানগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই।
১. ক্ষতিকারক ক্যামিকেল
-
পটাশিয়াম গ্লুটামেট
গ্লুটামিক এসিডে যে সোডিয়াম লবণ থাকে সেটিই হচ্ছে পটাশিয়াম গ্লুটামেট যেটি কিনা ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) কর্তৃক ডেঞ্জারাস ফুড ইনডিগ্রিডিয়েন্ট হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এটি মূলত খাবারের ফ্লেভার বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হয়। পটাশিয়াম গ্লুটামেট যুক্ত খাবার অতিমাত্রায় গ্রহণ করে ফেললে মাথা ব্যথা ও ক্ষেত্র বিশেষে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
-
সালফাইট
সালফাইট সাধারণত ফলের জুস ও ফল দিয়ে তৈরি ডেইরি ডেজার্ট আইটেম দীর্ঘদিন সংরক্ষণ ও অণুজীবের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ব্যাবহার করা হয়।
এটি গ্রহণের ফলে ত্বক সংক্রমিত হতে পারে যেমন চুলকানি দেখা দিতে পারে।
-
সোডিয়াম বেনজোয়েট ও পটাশিয়াম বেনজোয়েট
সাধারণত ফুড প্রিজারভেটিভ হিসেবে (মোল্ডের বৃদ্ধি প্রতিহত করতে) কোমল পানীয়, সফট ড্রিংকস কোল্ড ড্রিংকসে ব্যাবহার করা হয়। যখন কোমল পানীয় বোতলজাত করতে হিট দেয়া হয় ও এর সাথে প্রিজারভেটিভ হিসেবে ভিটামিন সি যোগ করা হয়, তখন এগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব আরো প্রকট হয়।
-
ফুড এডিটিভস
ফুড এডিটিভস খাদ্যকে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে, তাজা রাখতে, স্বাদ বাড়াতে ও দেখতে আকর্ষণীয় করে তুলতে সাহায্য করে। যেমন চিনি, লবণ, সালফার অক্সাইড। ফুড এডিটিভস যুক্ত খাবার হাই ক্যালোরি যুক্ত ও পুষ্টি-মূল্যহীন হয়ে থাকে যা নিঃসন্দেহে ক্ষতিকর।
-
ফুড কালার
খাদ্যকে আকর্ষণীয় করার জন্য বিভিন্ন রঙ ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে ক্যান্ডি ও বেকড পণ্যে এর কোন পুষ্টিগুণ তো নেই-ই বরং ক্যান্সার ও অ্যালার্জি সৃষ্টির জন্য দায়ী।
-
ক্যারামেল
বিভিন্ন কেক ও সস তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এছাড়াও ১০০ এর বেশি ফর্মুলা তৈরি হয় এটি থেকে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সামান্য পরিমাণ ক্যারামেলের ব্যবহারও ভিটামিন বি ৬ শোষনে বাধা দেয়।
-
বিউটালেটেড হাইড্রোঅক্সিয়ানিসেল
এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং খাবার দীর্ঘদিন সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়। পটেটো চিপস ও চুইংগাম তৈরিতে ব্যাবহার করা হয়। বিভিন্ন কসমেটিকস, হেয়ার প্রোডাক্ট ও লুব্রিকেন্ট হিসেবেও ব্যবহৃত হয় এই উপাদানটি। এই উপাদানযুক্ত খাবার গ্রহণের ফলে টিউমার হতে পারে।
২. আর্টিফিশিয়াল সুইটনার
আর্টিফিশিয়াল সুইটনার হিসেবে অ্যাসপারটেম ও স্যাকারিন খুবই পরিচিত। প্রায় সব জাঙ্ক ফুড, ফাস্ট ফুডে কম বেশি এগুলো যোগ করা হয়। এগুলো হাই ক্যালোরিযুক্ত এবং কোন নিউট্রিশন ভ্যালু নেই বরং দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সম্প্রতি গবেষণায় অ্যাসপারটেমে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী জীবাণু পাওয়া গিয়েছে।
৩. কার্সিনোজেনিক পদার্থ
এগুলো এমন কিছু উপাদান যা মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। খাদ্য শিল্পে ব্যবহৃত একটি কার্সিনোজেন হলো টাইটেনিয়াম অক্সাইড যা খাবারের রং সাদা ও ঝকঝকে করে তোলে। শুধু তাই নয় চুইংগাম ও বিভিন্ন ক্যান্ডিতেও এর ব্যবহার রয়েছে।
৪. মাইক্রোপ্লাস্টিক
অধিকাংশ জাঙ্ক ফুডের মধ্যেই প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ পাওয়া গিয়েছে যা হরমোনাল ইমব্যালেন্স, ইনফার্টিলিটি এবং শিশুদের শিখন প্রক্রিয়া, মনোযোগ ও আচরণকে প্রভাবিত করে। সাধারণত এসব উপাদন খাদ্য প্যাকেজিং, হ্যান্ডেলিং ও বিভিন্ন সরঞ্জাম থেকে খাবারে যোগ হয়।
৫. হেভি মেটাল
ডার্ক চকলেট আমাদের সবারই প্রিয় এবং এর অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতাও রয়েছে তবে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণায় এর মধ্যে ক্যাডমিয়াম ও লেডের মত ভারী ধাতু পাওয়া গিয়েছে। লেড শিশুদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বিশেষ করে বাড়ন্ত শিশু যাদের বয়স ৬ বছরের কম। লেডের প্রভাবে শিশুদের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়, ডিলে স্পিচ হয়, বুদ্ধিমত্তা হ্রাস পায়, অমনোযোগী ভাব দেখা যায়। শুধু শিশুদের নয় বড়দেরও এর প্রভাবে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায় ও তলপেটে ব্যথা হয়। ডার্ক চকলেট তৈরির জন্য যে কোকোয়া বিন ব্যবহৃত হয় সেগুলোর ড্রাইং প্রসেস সাধারণত রাস্তার পাশে হয় ফলে গাড়ির ধোঁয়া থেকে লেড কোকোয়াতে প্রবেশ করে।
৬. বিস্ফোরক পদার্থ
পটাশিয়াম ব্রোমেট সাধারণত বিস্ফোরক পদার্থ হিসেবে পরিচিত তবে বর্তমানে এটি আটা বা ময়দায় মেশানো হয় বেকড পণ্য তৈরির জন্য। এটি খামিরের সেইপ সুন্দর রাখতে সাহায্য করে। ল্যাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে এই উপাদানটি ক্যান্সার ও থাইরয়েডের সমস্যা সৃষ্টি করে।
পরিশেষে
নিশ্চয়ই লেখাটি পড়ে ভয় পেয়ে গেছেন ভয় পাবারই কথা যেহেতু এতো এতো ক্ষতিকর দিক রয়েছে তাই যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে এসব খাবার। বাইরের খাবার ও প্যাকেট-জাত খাদ্য এড়িয়ে বাড়িতে বানানো অর্গানিক খাবার খাওয়া হতে পারে সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি। পছন্দের খাবার বাদ দেয়াটা কষ্টকর বটে, তবে মনে রাখতে হবে আপনার খাবার যত স্বাস্থ্যকর হবে আপনার সুস্থ থাকার সম্ভাবনা ততই বেড়ে যাবে।