চিনি খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা!
আসুন আমদের অতি প্রিয় "চিনি" কে জানি। এর শুরু কোথায়? আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চিনির ব্যাবহার ও প্রভাবসমূহ। এবং সার্বিকভাবে চিনির ব্যাবহারে আমাদের করনীয়।
মানুষের কথা থেকে শুরু করে চায়ের কাপে, কোমল পানীয় থেকে ফলফলাদি সর্বত্র মিষ্টির নির্মল আনন্দ। শিশু থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধ আমরা সবাই চিনির মিষ্টি স্বাদ এর সাথে অভ্যস্থ। সেই যে কোনো এক প্রাচীন কালে এর যাত্রা শুরু আমাদের জীবনে, যখন প্রথম পৃথিবীর আলো দেখি আমরা-কোনো এক দাদী বা চাচী বা কোনো এক দাই মা এর মিষ্টি দিয়ে জীবন শুরু যা আর বন্ধ হয়নি।
আমাদের জীবনে চিনির ব্যপকতা বলে বুঝানো যাবে না। চিনি খুব দ্রুত আমাদের শরীরে শক্তি জোগায়, রক্তের নিম্নচাপকে স্বাভাবিক হতে সাহায্য করে, ত্বকের উপকারে আসে, শরীরের কোথাও কেটে গেলে ঠিক করে। যদি আপনি মানসিক বিষন্নতায় ভুগে থাকেন, তাও দূর করবে চিনি। তাছাড়া ত্বকের মরা কোষ দূর করা, হাতের দূর্গন্ধ, ব্লেন্ডারের দাগ দূর করা, বিস্কুট মচমচে রাখা এসব ব্যাপারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা থাকে চিনির। চিনির এত মহামতি গুনাবলি থাকলেও, রয়েছে এর কিছু ক্ষতিকর দিক।
গত কয়েক দশকে বিজ্ঞানী আর ডাক্তারদের মতে জনস্বাস্থ্যের জন্য এক নম্বর সতর্কবার্তায় চিনি বা শর্করা বা সুগার। ডাক্তাররা এজন্য খাদ্য তালিকা থেকে চিনিকে বাদ দিতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
আমার সবাই জানি ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার এর মত অনিরাময়যোগ্য রোগগুলোতে, যারা বেশি মিষ্টি পছন্দ করেন তাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে ডাক্তাররা এও বলেন যে, এসব রোগের জন্য শুধু শর্করা বা চিনিই একমাত্র কারন নয়। যখন উচ্চমাত্রার ক্যালরিযুক্ত খাবারের সাথে চিনি খাওয়া হয়, তখন তা ক্ষতির কারন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চমাত্রার ফ্রুকটোজ বা চিনিযুক্ত পানীয়, জুস, ড্রিংস, মধু বা সাদা চিনি ধমনীর ভিতরে চর্বি জমতে সাহায্য করে, যা হৃদরোগের কারন। লুজান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক লুক টাপির মতে, অতিরিক্ত ক্যালরিই ডায়াবেটিস, স্থুলতা, উচ্চরক্তচাপের কারন এবং সুগার সেই উচ্চ ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবারের একটা অংশ মাত্র।
কিছু কিছু গবেষকদের মতে চিনি বা মিষ্টি খাওয়ার আকর্ষন নেশার মতো। কিছু কিছু জরিপমতে যারা অতিরিক্ত কোমল পানীয়, ফলের রস খান তাদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল। আবার অন্য কিছু গবেষনায় দেখা গেছে চল্লিশোর্ধ মানুষের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে এবং কষ্ট সাধ্য কাজ করতে শর্করা সাহায্য করে। চিনি বা মিষ্টি সম্পর্কে এমন আরও নানা তথ্য রয়েছে যার কোনটা পজেটভ আবার কোনটা নেগেটিভ।এখানে আমরা সংক্ষেপে চিনির আদ্যপান্ত জানার চেষ্টা করব।
চিনির উৎপত্তির ইতিহাস
যতদূর জানা যায়, প্রায় ৬০০০ খ্রিস্টপূর্ব হতে দক্ষিন এশিয়া এবং দক্ষিন-পূর্ব এশিয়াতে গ্রীষ্মপ্রধান দেশে চিনির উৎপত্তি হয়। চিনি উৎপন্ন হয় আখ বা ইক্ষুর নির্যাস থেকে।জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ বছর আগে অন্নের অন্বেষনে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে ইক্ষুও অভিভাসিত হয় প্রসান্ত মহাসাগরের পূর্বদিকে।
ভারতীয় মহাদেশে “ইক্ষু’’ তথ্য জানা যায় অথর্ববেদ থেকে। খ্রিস্টপূর্ব (১৫০০-৮০০) সালে রচিত এ গ্রন্থে ‘’ইক্ষু’’কে মিষ্টি আকর্ষনকারী প্রতীক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
চিনির উৎস
সুক্রোজ এর সর্বপরিচিত নাম হলো চিনি, যা বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় এর গুরুত্বপূর্ন পুষ্টি উপাদান। চিনি সাধারনত আখ এবং এক জাতীয় ‘’সুগার বীট’’ নামক গুল্ম জাতীয় কান্ড থেকে পাওয়া যায়। বিভিন্ন ফল, বাদাম ও সবজিতে চিনি রয়েছে, যা প্রায় ১০%। কিন্তু আখ বা সুগার বীট এ প্রায় ১৬% পর্যন্ত চিনি রয়েছে। যে কারনে আখ বা সুগার বীটের চাষই চিনি প্রাপ্তির সহজলভ্য পন্থা।
-
আখঃ আখ একধরনের বহুবর্ষজীবী গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ, যা গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়ায় জন্মায়। বহুবর্ষজীবী বলতে যা কয়েক বছর বাঁচে বা বছর বছর রোপণ করতে হয় না। যখন আখ কাটা হয় তখন তা মূল থেকে কিছুটা উপরে কাটা হয় এবং তা থেকে নতুন চারা গজায়। ১০-১২ মাসে আখ কাটা হয়। আখ প্রায় ১০-২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়।
-
সুগার বীটঃ সুগার বীট হলো একধরনের রাইজোম জাতীয় কান্ড।উর্বর জমি, ঠান্ডা আবহাওয়ায় এই ফসলটি জন্মে এবং প্রায় ৫ মাস সময় লাগে। ঘরের আঙ্গিনায় বা সাধারন ভাবে উৎপাদিত যে সব মূল জাতীয় ফসল আমরা দেখে থাকি ‘’সুগার বীট’’ এদের থেকে আকারে অনেক বড় হয়। প্রায় ৩-৫ পাউন্ড পর্যন্ত ওজন হয় পূর্নাঙ্গ বয়সে।
চিনির প্রকারভেদ
ব্যবহার ও রঙ এর বিবেচনায় চিনি নানান রকমের। যদিও সব চিনিই আখ বা সুগার বীট এর নির্যাস থেকেই হয়।এই নির্যাস থেকে অপদ্রব্য পৃথকীকরন, দানায় রূপান্তর, শুকানো এবং চিনির মিষ্টতা কেমন হবে তার উপর নির্ভর করে চিনির রকমফের হয়। চিনির স্ফটিক বা দানার আকার আকৃতি বা পরিমাপ নির্ভর করে এর নানা ধরনের খাদ্য ও পানীয়তে এর ব্যবহার এর উপর।
চিনির রঙ প্রাথমিক ভাবে নির্ভর করে চিনিতে কি পরিমান গুর রয়েছে বা পছন্দ সই ফ্লেভার বা আর্দ্রতার জন্য কেমন ও কতটুকু মিক্সার আখ এর নির্যাস এর সাথে মিশানো হয়েছে। আখ এর নির্যাসকে কত তাপমাত্রায় দানাদার রূপ দেওয়া হলো তার উপর ও চিনির রঙ নির্ভর করে। কিছু চিনি রয়েছে শুধুই খাদ্য শিল্পে ব্যবহার হয় এবং তা সাধারণত বাজারে পাওয়া যায় না।
১. সাদা চিনিঃ সাদা চিনির মধ্যও কিছু রকমফের রয়েছে। উৎপাদন এবং ব্যবহার এর ধরন অনুযায়ী এই চিনি বিভিন্ন নামে পরিচিত,
-
নিয়মিত বা সাদা কণিকাকার
-
গুড়া চিনি
-
ফলের চিনি
-
বেকারির চিনি
-
অতি মিহি চিনি
-
মোটা চিনি
-
বালু চিনি,
সাদা চিনির কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে,
-
সহজলভ্যতা
-
সর্বাধিক পরিচিত উপাদান যা রান্না বা অন্যান্য কাজে ব্যবহার হয়
-
এর দানাগুলো ছোট হওয়াতে সহজে বহনযোগ্য,
২. বাদামী চিনিঃ বাদামী চিনির কয়েকটি রূপভেদ রয়েছে। যেমন,
-
হালকা বা ভারী বাদামী চিনি
-
অপরিশোধিত (আখ এর নির্যাস) বাদামি চিনি
-
আর্দ্র চিনি
বাদামী চিনি তৈরী হয় আখের নির্যাস থেকে বা ঝোলা গুড় বা সাদা চিনির সাথে গুড় মিশিয়ে। হালকা বাদামী চিনি সসেস বা রান্নার কাজে ব্যবহার হয়। ভারী বাদামি রঙ এর চিনি হালকা রঙ এর চিনির চেয়ে অনেক গাড় এবং এর ব্যবহার ও ভিন্ন। বিভিন্ন ধরনের শস্য দানা, বারবি কিউ বা বিভিন্ন কড়া গন্ধের খাবার তৈরিতে ভারী বাদামী চিনি ব্যবহার করা হয়। বাদামী চিনি সাদা চিনির চেয়ে বেশি আর্দ্র এবং আঠাল। এ কারনে বাদামী চিনি বিভিন্ন ধরনের চুষে খাওয়া যায় এমন খাদ্যে ব্যবহার হয়।
৩. তরল চিনিঃ তরল চিনি হলো চিনির আর একটি রূপভেদ। এটি সাদা কনিকার চিনির সাথে পানি মিশিয়ে তৈরি করা হয়। এটি পানির সাথে ১:১ অনুপাতে মিশিয়ে তৈরি করা হয়। তরল চিনি বিভিন্ন ধরনের কোমল পানীয় তৈরিতে ব্যবহার হয়।
চিনির গুরুত্বপুর্ন প্রভাবসমূহ
আমরা জানি যে, এক চা চামচ চিনিতে ক্যালরির হিসেবে ১৫ ক্যালরি থাকে। চিনি কখন নষ্ট হয় না, তাই চিনির কোনও মেয়াদ উত্তীর্ন তারিখ থাকে না। সেজন্য আমাদের জীবনের নানা ক্ষেত্রে চিনির ব্যাবহার পরিলক্ষিত হয়।
চিনির গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার এর মধ্যে স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা, রূপচর্চা, বাসাবাড়ি ও বাগান পরিচর্চা, কৃষি ও শিল্পকারখানা তে উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া চিনির রয়েছে অনেক ঔষধী গুন। চিনির এই ব্যবহার এর উপকারী ও অপকারী দুইটি দিকই রয়েছে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে চিনির প্রভাব
চিনি হলো একধরনের কার্বহাইড্রেট।মানব শরীরে কার্বহাইড্রেট হলো শক্তির প্রথম উৎস। বিভিন্ন ধরনের খাদ্য ও খাদ্য উপাদান এর মত চিনির ও কিছু বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা রয়েছে। যা মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি বিবেচনা করে খাবার পছন্দ করতে সাহায্য করে। মানুষ চিনি ব্যবহারে সাধারনত যে সব স্বাস্থ্য বিষয়ক বিষয় বিবেচনা করে তা হলো,
১. ডায়াবেটিসঃ এই রোগটি আমাদের কাছে অতি পরিচিত। শুধু আমাদের কাছে নয়। সারা বিশ্বেই ডায়াবেটিস শব্দটি বহুল পরিচিত। শুধু আমেরিকাতে প্রায় ৩ কোটি মানুষ ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত। এই সংখ্যা আমাদের দেশেও কম নয় প্রায় ৭১ লাখ। যা প্রতিদিন বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ডায়াবেটিস এখন একটি মহামারি রোগ। ডায়াবেটিস নিয়ে আমাদের যত ভুল্ ধারনা রয়েছে তার মধ্যে চিনি বেশি বা কম খাওয়া।চিনি বেশি খেলে ডায়াবেটিস হবে আর কম খেলে হবে না, এই হলো আমাদের ধারনা। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে ডায়াবেটিস এর সাথে চিনির কোন সম্পর্ক নাই। আমাদের অগ্নাশয় হতে এক ধরনের হরমোন নির্গত হয়,যার নাম ইনসুলিন। এই ইনসুলিন এর কাজ হলো রক্তের সুগার বা চিনি কোষে পৌছে দেওয়া। আমাদের অগ্নাশয় থেকে হরমোন কম নির্গত হলে রক্তে সুগার বা চিনির পরিমান বেড়ে যায়। রক্তে সুগার এর পরিমান বেড়ে গেলে তখন আমরা তাকে ডায়াবেটিস বলি।
ডায়াবেটিস রোগ মূলত দুই ধরনেরঃ
টাইপ-১, এই ধরনের ডায়াবেটিস মূলত ইনসুলিন এর অভাবে হয়।মূলত শরীরে ইনসুলিন এর উৎপাদন কমে গেলে এই ধরনের ডায়াবেটিস হয়।এক্ষেত্রে শরীরে সুগার নিয়ন্ত্রন করতে শরীরে বাড়তি ইনসুলিন গ্রহন করতে হয়।
টাইপ-২, এই ধরনের ডায়াবেটিস রক্তে যথেষ্ট ইনসুলিন থাকার পরও কিছু শারীরিক অসুবিধার কারনে হয়। এটি সাধারনত বেশি বয়সে ধরা পড়ে এবং সঠিক ডায়েটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করা যায়।
তাই বলা যায় ডায়াবেটিস এর সাথে চিনির সম্পর্ক নাই বরং সুস্থ্য থাকার জন্য চিনি খুব দরকারি।
২. অতিরিক্ত ওজন বা স্থুলতাঃ স্থুলতা একটি জটিল সমস্যা এবং এর সাথে অনেক গুলো বিষয় জড়িত। স্থুলতার জন্য সাধারনত অতিরিক্ত ক্যালরিযুক্ত খাবার, বংশগত বা কম শারীরিক কাজ করা দায়ী। তাছাড়া অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, শর্করা, প্রোটিন, অ্যালকোহল, অন্যান্য নানান কার্বহাইড্রেট ইত্যাদি ও স্থুলতার জন্য দায়ী। চিনি হলো খাবারে ক্যালরির একটি উৎস। অতিরিক্ত ক্যালরিযুক্ত খাবার, কার্বহাইড্রেট বা চিনি স্থুলতা বৃদ্ধিতে ও অন্যান্য নানান রোগের ঝুকি বাড়ায়। একারনে মানুষ চিনিকে স্বাস্থ্যের জন্য ঝুকিপূর্ণ মনে করে। যদিও আমেরিকার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বা ইউরোপের খাদ্য সংস্থা স্থুলতার সাথে চিনি সম্পৃক্ততার প্রমান নাই বলে বিভিন্ন গবেষনায় উল্লেখ করে।
৩. দাঁতের স্বাস্থ্যঃ দাঁতের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় চিনির কিছু অপকারি দিক রয়েছে। দাঁতের ক্ষয় রোগের জন্য মূলত চিনি অনেকটা দায়ী। আমরা যদি ঘনঘন মিষ্টি জাতীয় খাবার খাই, তবে খাবারের চিনি আমাদের মুখের ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে ভেঙ্গে এসিড উৎপন্ন করে যা দাঁতের ক্ষয় রোগের জন্য দায়ী। একারনে ডাক্তাররা দিনে অন্তত দুইবার দাঁত ব্রাশ করতে বলেন যাতে করে আমাদের দাঁত ক্ষয় রোগ হতে রক্ষা পায়।
৪. হৃদরোগঃ হৃদরোগ হলো সারা বিশ্বে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী একটি রোগ। যে বিষয়গুলো হৃদরোগ এর জন্য দায়ী তা হলো,
-
রক্তে চর্বি বৃদ্ধি পাওয়া
-
উচ্চ রক্তচাপ
-
ডায়াবেটিস
-
কায়িক পরিশ্রম না করা
-
স্থুলতা
-
ধূমপান করা
খাবারের পুষ্টিমান বিবেচনা না করেই খাবার গ্রহন এই রোগ এর জন্য দায়ী হলেও চিনি কতটুকু হৃদরোগ এর জন্য দায়ী এ ব্যপারে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সন্দিহান। তাদের মতে কার্ডিওভাস্কুলার ডিজেস(CVD) এর জন্য চিনি যে দায়ী তা বিতর্কের বিষয়। তবে চিনি যে স্থুলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক, তাতে বলাই যায় চিনি হৃদরোগ এর জন্য দায়ী।
শিশুদের উপর চিনির প্রভাব
বাচ্চারা মিষ্টি বা চিনি জতীয় খাবার খেতে পছন্দ করে,এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে সারা বিশ্বে।কিন্তু বাচ্চাদের স্থুলতা, দাঁত ও চোখের সমস্যার কারনে শিশুদের খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে শিশু ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন।
রয়্যাল কলেজ অব পেডিয়াট্রিকস অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ, ব্রিটেন এর একটি গবেষনা পত্র এমন তথ্য প্রকাশ করেছে যে, শিশু বয়সে বাচ্চাদের মিষ্টি জাতীয় খাবার নিয়ন্ত্রন করা গেলে এবং ঐ বয়সে সবজি খাওয়ার অভ্যাস করা গেলে তা শিশুদের সুষম খাদ্যের যোগান দেবে।
সারা দুনিয়ার মত যুক্তরাজ্যের শিশুদের মধ্যে স্থুলতা বেড়ে যাওয়া ঠেকাতে ২০৩০ সালকে লক্ষ্য রেখে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহন করেছে। তার মধ্যে রয়েছে, বাচ্চাদের মিষ্টি জাতীয় খাবার খেতে নিরুৎসাহিত করা, শিশু খাদ্যে চিনির পরিমান নির্দিষ্ট করে দেওয়া, চিনির উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করা ইত্যাদি।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, মিষ্টি জাতীয় পানীয় শিশুদের খেতে দেওয়া একদমই উচিত নয়। যে সব খাবার এ চিনি একদম নেই বলে লেবেল সেঁটে দেওয়া আছে, তাও শিশুদের দিতে ডাক্তাররা নিষেধ করে থাকেন। এসব খাবার এর মধ্যে ক্যান জাতীয় বিভিন্ন পানীয় ও খাদ্য রয়েছে। এসব খাবার এর পরিবর্তে ফলমূল ও মিষ্টি ছাড়া দুধ জাতীয় খাবার বাচ্চাদের দিতে ডাক্তাররা নির্দেশ দিয়ে থাকেন। গবেষক প্রফেসর মেরি ফিউট্রেল বলেছেন বাচ্চাদের বুকের দুধ খাওয়া ছাড়ানোর জন্য বাবা-মা এরা অনেক সময় বাচ্চাদের মিষ্টি জাতীয় খাবার খেতে অভ্যাস করে থাকেন, যা থেকে মিষ্টির আসক্তি তৈরী হয় বাচ্চাদের। বাজারে প্রচলিত অনেক প্যাকেটজাত ও টিনজাত শিশু খাদ্যে হাই এনার্জি ও মিষ্টি থাকে। তাই শিশু বিশেষজ্ঞরা মিষ্টি জাতীয় খাবার দিতে নিষেধ করেন।
চিকিৎসকেরা বলেন, দুই বছরের একটি শিশু দিনে যে সব খাবার খাবে তার ৫% এর বেশি মিষ্টি জাতীয় খাবার হওয়া উচিৎ না। কিন্তু এই মুহূর্তে যুক্তরাজ্যের একজন শিশু দিনে ১১% এর বেশি চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খেয়ে থাকে। যুক্তরাজ্যে প্রতিবছর পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ২৩% দাঁতের সমস্যায় ভোগে, বাংলাদেশে এর সঠিক হিসাব না থাকলেও এর সংখ্যা যে আশংকাজনক তা বিভিন্ন প্রতিবেদন উঠে আসছে। তাই শিশু ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বাচ্চাদের মিষ্টি জাতীয় খাবার খেতে নানা রকম বিধি নিষেধ আরোপ করে থাকেন। এছাড়া বাচ্চাদের প্রচুর কায়িক শ্রম ও খেলাধুলা করতে আগ্রহী করে তুলতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
গবেষকরা জানাচ্ছেন,শিশুদের খাবারে অরুচির প্রধান কারণ অতিরিক্ত চিনি খাওয়া। চিনির মধ্যে থাকা ক্যালরি শিশুদের খিদে নষ্ট ফেলে আর তাতেই আসে খাবারে অরুচি। এর ফলে শিশুর শরীরে ভিটামিন, ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দেয়। তাই দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়ে আপনার সন্তান।
প্রাপ্ত বয়স্কদের উপর চিনির প্রভাব
বড়দের চিনি বিষয়ক সতর্কতা আরও বেশি প্রয়োজন। কেন প্রয়োজন? চিনি খাওয়ার যে অভ্যাস আপনি ছোটো বয়সে তৈরী করেছেন নিশ্চয়ই তা আপনি এখনো ধরে রেখেছেন। নিশ্চয়ই তা থেকে আপনার হয় দাঁতের ক্ষয় রোগ বা স্থুলতার মত জটিল কোনো সমস্যা তৈরি হয়েছে।আর দাতের ক্ষয় বা স্থুলতা থেকে যে হৃদরোগ এর মত ঘটনা ঘটে তা আমরা নিশ্চই জানি। তাছাড়া যারা ডায়াবেটিস এর মত জটিল রোগ এ আক্রান্ত তাদের চিনি বিষয় সচেতনার কথা ইতমধ্যে আলোচনা হয়েছে। দাঁতের ক্ষয় বা স্থুলতা বা ডায়াবেটিস এর সাথে চিনির সম্পৃক্ততা নিয়ে অনেক কথা হলো। এবার একটি ছোটো ঘটনা বলি, মেটাবলিক সিন্ড্রোম চক্রে সাধারনত কোলেস্টরল, প্রেসার, সুগার তিনটি বিষয়ই বিষেশভাবে থাকে। এই কোলেস্টরল, প্রেসার, সুগার হলো একই প্রোগ্রামের তিনটি পর্ব মাত্র। আমরা কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রন এর জন্য ডিম-মাংস এরিয়ে চলি। কিন্তু কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রন করার জন্য আমরা যতটা চিন্তিত, চিনি নিয়ন্ত্রন করার জন্য ততটা উদাসীন। ব্রিটিশ পুষ্টিবিদ প্রফেসর জন ইয়াদকিন ১৯৭২ সালে তার "পিওর, হোয়াইট অ্যান্ড ডেডলি" বইয়ে প্রথম চিনি বিষয়ে সতর্কতার কথা বলেন। তবে তার এই লেখা বা সতর্কতা কখনো আলোর মুখ দেখেনি। ষাটের দশকে "লো-ফ্যাট ডায়েট" হলো স্বাস্থ্যসম্মত ডায়েট, এই হুজুগে বিশ্বজুড়ে প্রফেসর ইয়াদকিন এর চিনি বিষয়ক গবেষনা হারিয়ে যায়। বড় বড় চিনি শিল্প প্রতিষ্ঠান এর কর্তা ব্যক্তিরা বড় অংকের অর্থনৈতিক লেনদেন এর মাধ্যমে চিনির ক্ষতিকর দিক প্রকাশ করতে বাধ সাধতেন। ডিমের কোলেস্ট্রল বা প্রানিজ চর্বি নিয়ে ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীদের যে সতর্কতা, চিনি নিয়ে তার চেয়ে বেশি সতর্ক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রভাবশালী গবেষনা প্রতিষ্ঠান বা গবেষকদের অসততার জন্য ভোক্তাদের ধারণাই পাল্টে যায়। যার ফলে বিশ্বব্যাপী সফট ড্রিংকস আর তথাকথিত এনার্জি ড্রিংকস এর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যবসায়ীদের পকেটে ঢুকে, যদিও তা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করছে।
১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্র এর ডায়েটারি গাইডলাইনে চর্বিকে দোষী সাব্যস্ত করলেও পরবর্তিতে স্বীকার করে যে চিনিকে দায় মুক্তি দিয়ে চর্বিকে দোষী করা উচিৎ হয়নি। তাদের গবেষনায় প্রকাশ পায় যে, ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মোটা মানুষ ছিল ১২%, ১৯৮০ সালে যা ১৫% হয় এবং ডায়েটারি গাইডলাইনের পর ২০০০ তা ৩৫% হয়।
হৃদরোগ-ফ্যাট হাইপোথিসিসের এই চক্রে পুষ্টিবিজ্ঞান গত ৫০ বছর যাবত একটী অসম্পূর্ন মিথের উপর চলছিল। প্রফেসর ইয়াদকিন মানুষ ও প্রানীর উপর একটি গবেষনায় দেখিয়েছেন ফ্যাট নয় চিনিই হৃদরোগের সাথে বেশি সম্পর্কিত।
চিনির বিকল্প হিসেবে আমরা যে কৃত্রিম চিনি ব্যবহার করি, আপাতদৃষ্টিতে স্বাস্থ্যকর মনে হলেও শরীরের জন্য তা একদমই উপকারী নয়।
সাম্প্রতিক প্রায় অধিকাংশ গবেষনায় হৃদরোগ আর মোটা হওয়ার পেছনের কারন হিসেবে চিনির দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে। লিভারে চিনি ফ্যাটে পরিনত হয়। চিনি রক্তে চর্বি প্রবাহ তরান্বিত করে, ফ্যাটি লিভারসহ নানা রকম অসুখ-বিসুখে চিনির যোগসূত্রের তথ্য ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। "সাদা চিনি" যাকে আমরা টেবিল সুগার বলি, কার্বহাইড্রেট পরিবারে এটি সুক্রোজ নামে পরিচিত। যার গাঠনিক উপাদান হচ্ছে গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজ। সুস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় এবং পুষ্টি নির্দেশনায় এই টেবিল সুগারের পরিমিত ব্যবহার ভীষন জরুরি হয়ে পড়ছে।
সময় এসেছে কৃত্রিম চিনি পরিহার করার। যদিও অনেকে কৃত্রিম চিনিকে বিপদজনক নয় বলে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, তবে এর বাইরেও কিছু উপযুক্ত তথ্যবহুল গবেষনা পত্র আজ আমরা ইন্টারনেটে পাচ্ছি। তেমনি একটি খবর হলো, "এনএসএস বা নন-ক্যালরিফিক আর্টিফিসিয়াল সুইটনার" ডায়াবেটিকস এর ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই কৃত্রিম চিনি ব্যবহারে সতর্ক হতে পরামর্শ দিচ্ছে স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো। তাছাড়া কৃত্রিম চিনি ক্যান্সার এর ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে বলে অনেক গবেষক মনে করেন।
চিনির কিছু কার্যকরী ব্যাবহার
উপরের আলোচনা বিশ্লেষণ করলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চিনির ক্ষতিকর দিকই পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন এমন সব ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে চিনি শুধু ভালোই না বরং খুবই ভালো এবং উপকারি। যেমন,
-
চিনি ঔষধ এর প্রিজারভেটিভ ও আন্টিওক্সিডেন্ট রূপে ব্যবহার হয়
-
হঠাৎ করে হেঁচকি উঠতে শুরু করলে আধা চা চামচ চিনি চুষে খেলে বন্ধ হয়
-
মৌমাছি হুল ফোটালে পানি আর চিনি সমান পরিমানে মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে লাগালে যন্ত্রনা কমে
-
গরম কিছু খেয়ে যদি মুখ পুরে যায়, চিনি খেলে যন্ত্রনা কমে
-
শরীরে কোথাও কেটে গেলে, চিনি সেই ক্ষত সারাতে দ্রুত কাজ করে
-
মেক আপ তোলা বা মইশ্চারাইজার হিসেবে চিনি দারুন উপকারি
-
আপনি যদি ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়ার পর ঠোঁটে সামান্য চিনি ছিটিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করেন, তাহলে আপনার লিপস্টিক এর রঙ টি দীর্ঘ সময় থাকবে
-
শরীর পরিষ্কার করার জন্য চিনি হতে পারে ভালো উপাদান। জজবা তেল বা অলিভ বা নারিকেল তেল এর সাথে চিনি মিশিয়ে গোসল এর আগে শরীরে মেখে কিছু সময় পর গোসল করে নিতে পারেন
-
আপনি যদি মাঠে বা বাগানে কাজ করে থাকেন বা আপনার গাড়ি ধুয়ে থাকেন, হাতের তালুতে সামান্য চিনি নিয়ে ভাল করে মেখে কিছু সময় পর সাবান দিয়ে ধুয়ে নিলে ভালো ফলাফল পাবেন
-
কাপড়ের দাগ তুলতে চিনির জুড়ি নাই
-
আপনার কেক, বিস্কিট, কুকিস ভালো ও মচমচে রাখে চিনি
-
ফুলদানির ফুল তাজা রাখে চিনি
-
পনির ভালো রাখে চিনি
-
আখের ছোবরা দিয়ে পার্টিকেল বোর্ড তৈরি হয়
-
টেক্সটাইল বা চামড়া বা জ্বালানি শিল্পেও রয়েছে এর বিবিধ ব্যবহার।
আপনি নিশ্চয়ই দ্বিধান্বিত যে, চিনি খাবেন নাকি খাওয়া বাদ দিবেন। হ্যাঁ, আমাদের আলোচনা, উল্লেখিত তথ্য প্রমান দেখে আপনি নিশ্চয়ই এমন সিদ্ধান্তে আসতেই পারেন যে চিনি খাবেন না। কিন্তু ব্যপারটি আসলে এমন না যে আপনি হুট করেই সিদ্ধান্ত নিবেন যে চিনি খাবেন না। চিনির ক্ষতিকর দিক যেমন রয়েছে, রয়েছে তেমনি উপকারি দিক। যারা মিষ্টি খেতে ভালোবাসেন তাদের জন্য হুট করে চিনি ছেড়ে দেওয়াও সম্ভব নয় বা কম খাওয়াও সম্ভব নয়। এই অভ্যাসটি করতে হলে আপনাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। নিজেকে সময় দিতে হবে, আস্তে আস্তে মানিয়ে নিতে হবে। ভালো একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে ঠিক করে নিতে হবে আপনার করণীয়। নিয়মিত শরীর চর্চা, কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, নিয়মিত শরীর চর্চা আমাদের শরীর ও মন দুইটাই ভালো রাখবে। আমরা একটি বিষয় নিশ্চয়ই জানি যে আমরা বর্তমানে ভেজাল খাবার, ভেজাল দুনিয়ায় বাস করছি। এখানে ভালো থাকতে হলে হতে হবে সচেতন, হতে হবে ডাক্তার এর শরণাপন্ন। নিতে হবে চিকিৎসা ও পরামর্শ। ভালো থাকতে হলে েসব মানতে হবে, করতে হবে অনেক কিছু। এসব কিছুর সমন্বয় হলে হয়ত ভালো থাকার আশা করা যায়।