গ্লুটেন কি আসলেই ক্ষতিকর নাকি ভ্রান্ত ধারণা
বর্তমানে বিভিন্ন খাবারের কোম্পানির বিজ্ঞাপনে গ্লুটেন ফ্রি কথাটি প্রায়ই শোনা যায়। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষও গ্লুটেনকে এড়িয়ে চলতে চান। কিন্তু গ্লুটেন কিভাবে মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর, কাদের জন্য ক্ষতিকর, কিংবা আদৌ ক্ষতিকর কিনা সে সব বিস্তারিত জানব এই প্রবন্ধে।

গ্লুটেন হচ্ছে এক প্রকার প্রোটিন। কিন্তু গ্লুটেন সম্পর্কে রয়েছে বিভিন্ন বিতর্ক, গবেষণা, অনুসন্ধান ও ভ্রান্ত ধারণা। শোনা যায় গ্লুটেন এর সাথে এলার্জির বিস্তর সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু অনেকেই জানেন না কী এই গ্লুটেন, ফলশ্রুতিতে পরেন নানান ভোগান্তিতে। চলুন জেনে নেওয়া যাক গ্লুটেন সম্পর্কে।
গ্লুটেন কী?
গ্লুটেন মূলত একধরণের জটিল প্রোটিন যাকে বইয়ের ভাষায় প্রোলামিন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। গম, রাই, বার্লি তে গ্লুটেন এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
গ্লুটেন এক ধরণের আঠালো পদার্থ যা বেকিং প্রক্রিয়ায় তৈরি খাবারকে ফুলে উঠতে সাহায্য করে। রুটি, পাউরুটি, সস,কেক, চিপস, বিয়ার এসব খাবার ও পানীয়তে গ্লুটেন থাকে।
গ্লুটেন সম্পর্কিত কিছু ভ্রান্ত ধারণা
গ্লুটেন নিয়ে বেশ কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। কারো কারো মতে গ্লুটেন মানব স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ক্ষতিকারক একটি পদার্থ। তাদের মতো এক শ্রেণীর মানুষ ধারণা করেন –
-
গ্লুটেন শুধুমাত্র সিলিয়াক ডিজিস আক্রান্ত মানুষের জন্য ক্ষতিকর।
-
গ্লুটেন মানুষের ওজন বৃদ্ধি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার দিকে পরিচালিত করতে পারে।
-
গ্লুটেন মুক্ত খাদ্য’ই স্বাস্থ্যকর।
-
গ্লুটেন এলার্জি’র সৃষ্টি করে।
আবার আরেক শ্রেণীর মানুষ মনে করেন গ্লুটেন একটি অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান। তারা আরও মনে করেন, গ্লুটেন সমৃদ্ধ খাদ্য দৈনিক খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া উচিত নয় বরং বয়স ও দৈহিক গঠন অনুযায়ী নিয়মিত খাদ্যে গ্লুটেন এর উপস্থিতি স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
এই হলো সত্য ও ভ্রান্ত ধারণার বিতর্ক। তাহলে জেনে নেওয়া যাক সত্য কোনটি এবং গবেষণায় কী জানা যায়।
গ্লুটেন কি ক্ষতিকারক নাকি উপকারী ?
-
গবেষণায় দেখা যায়, গ্লুটেন বেশিরভাগ মানুষের জন্য নিরাপদ। হার্ভাড স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর ২০১৭ সালে করা ১ লক্ষ জন নন-সিলিয়াক অংশগ্রহণকারীদের (অর্থাৎ যাদের সিলিয়াক ডিজিস নেই) নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়।
-
গবেষণা লব্ধ তথ্যানুযায়ী, যাদের সিলিয়াক ডিজিস নেই তারা দীর্ঘমেয়াদী গ্লুটেন গ্রহণ করলেও কোন ক্ষতি হতে দেখা যায় না। বরং যারা গ্লুটেন গ্রহণ থেকে বিরত ছিলো তাদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি দেখা যায়। তবে যারা সিলিয়াক ডিজিস এ আক্রান্ত তারা গ্লুটেন যুক্ত খাবার খেলে ক্ষুদ্রান্ত্রের আস্তরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে খাবার থেকে পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করতে ব্যাহত হয় ক্ষুদ্রান্ত্র।
-
আবার অনেকের রয়েছে গ্লুটেন সংবেদনশীলতা। যাদের গ্লুটেন অ-সহিষ্ণুতা রয়েছে, তাদের অবশ্যই গ্লুটেন’কে এড়িয়ে চলতে হবে। তবে দেখা যায়, গ্লুটেন সংবেদনশীলতার প্রভাব খুবই নগণ্য।
-
গ্লুটেন গ্রহণের ফলে ডার্মাটিটিস হার্পেটিফরমিস নামক চর্মরোগ দেখা হতে দেখা যায়।
-
এছাড়া খুব অল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যে আটা-তে এলার্জি লক্ষ্য করা যায়। যেহেতু আটা’তে গ্লুটেন এর উপস্থিতি রয়েছে, তাদের আটা খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।
গ্লুটেন নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকেই গেলো। তাহলে উপায় কী? চলুন জেনে নিই বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন।
গ্লুটেন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত কী?
-
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ আ ফ ম হেলালউদ্দিন বলেন, “গ্লুটেন আসলেই কোন ব্যক্তির ক্ষতি করছে কি না, সেটা জানা জরুরি। অনেকের শিশুকাল থেকেই গ্লুটেন সেনসিটিভিটি দেখা যায়। তখন রুটি ও গমের তৈরি খাবার এড়িয়ে চলতে হয়। বিশেষ অসুবিধা ছাড়া গ্লুটেনযুক্ত খাবার বন্ধ করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া ভালো।”
-
হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ এর প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এটি মনে রাখা প্রয়োজন যে গ্লুটেন কেবল তাদের জন্যই একটি সমস্যা যাদের উপর এটি নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে বা যারা সিলিয়াক ডিজিস এ আক্রান্ত। বেশিরভাগ মানুষ’ই কোনোরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই গ্লুটেন গ্রহণ করতে পারেন।’
-
গ্লুটেন এ সংবেদনশীলতা ও সিলিয়াক ডিজিস এর কথা বিবেচনায় রেখে অনেকেই গ্লুটেন ব্যতীত খাদ্য উৎপাদন করার চেষ্টা করছেন। বর্তমানে গ্লুটেন মুক্ত পাউরুটি দেখা যায় তবে তা নগণ্য। গ্লুটেনযুক্ত খাবারের বিকল্পও আমাদের সুপরিচিত। যেমন: চাল, ভুট্টা। আটার পরিবর্তে চাল বা ভুট্টার গুড়ো দিয়েও রুটি বানিয়ে খাওয়া যায়। গ্লুটেনযুক্ত বিস্কুটের পরিবর্তে চিড়া, মুড়ি খাওয়া যেতে পারে।
পরিশেষ
গ্লুটেন প্রতিদিনের খাবারের সাথে সংযুক্ত একটি প্রোটিন। খুব অল্প কিছু মানুষের মধ্যেই এর প্রতি সংবেদনশীলতা দেখা যায়। আর এই সংবেদনশীলতা পরিমাপ যোগ্য। যাদের এই প্রোটিনে সংবেদনশীলতা রয়েছে তারা সচেতন ভাবে গ্লুটেন এড়িয়ে চললে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করলে ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। অজ্ঞতা বশত গ্লুটেন এড়িয়ে চললে স্বাস্থ্য ঝুঁকি অবশ্যম্ভাবী।