খাবারের অ্যালার্জি এড়াতে আপনার যা জানা দরকার
খাবারে অ্যালার্জি একটি অতি সাধারণ একটি রোগ হলেও, প্রকৃতপক্ষে এটির সাথে রয়েছে মারাত্নক জটিলতা এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে মৃত্যু ঝুঁকি। তাই কখনোই অ্যালার্জির কোন উপসর্গকেই অবহেলা করার কোন অবকাশ নেই। অথচ আমাদের দেশে দেখা যায় উল্টো চিত্র। যার অ্যালার্জি হয় সে বাদে সবাই এটিকে সাধারন চুলকানীই মনে করেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। এমনকি যার অ্যালার্জি সেও খাবার সামনে পড়লে হুশ হারিয়ে ফেলেন। অ্যালার্জি যাদের আছে এবং অ্যালার্জি যাদের নেই সবার জন্য রোগটি সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্তপুর্ণ। আসুন তবে শুরু করা যাক।

ভোজন রসিক বাঙ্গালির কাছে খাবার যেন জীবনে সুখি থাকার একটি গুরুত্তপূর্ণ অবলম্বন। এমনিতে গরুর মাংস হয়ত তেমন খাওয়া পড়বে না, কিন্তু ডাক্তার যখন বলবেন আপনার গরুর মাংস খাওয়া নিষেধ, মানুষের তখন অন্তরদহন যেন বহুগুণে বেড়ে যায়। তাহলে এ কথা নির্দিধায় স্বীকার করে নেওয়া চলে যে খাবারে অ্যালার্জি আমাদের জন্য সঙ্গত কারণেই বেশ জটিল রোগ।
এই জটিলতা শুধু খাবারে সীমাবদ্ধতার জন্য তা নয়। রোগ হিসেবেও এই রোগটি অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ হতে পারে। যাদের অ্যালার্জির সমস্যা তেমন গুরুতর নয় তাদের ও কোন বিশেষ কারণে হটাৎ অ্যালার্জি জটিল আকার ধারণ করতে পারে, এবং যাদের সমস্যা বেশি তাদের তো সবসময়ই নিয়ন্ত্রণ এর মধ্যে থাকতে হবে। আর্থৎ সতর্কতাই ও সচেতনতা এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে আপনার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। আসুন একে একে এই রোগটি সম্পর্কে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যাক।
অ্যালার্জি কি?
আমাদের শরীরে বাইরের কোন ক্ষতিকর বস্তু প্রবেশ করলে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা চালু হয়ে যায়। শরীর ঐ বাইরের বস্তুটিকে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করে। সেই চেষ্টার ফলশ্রুতিতে আমাদের দেহে বিভিন্ন অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন দেখা দিয়ে থাকে।
খাবারে অ্যালার্জি হলো, যখন আমাদের শরীরে কোন খাবারের নির্দিষ্ট কোন প্রোটিনকে আমাদের শরীর খাবার হিসেবে চিহ্নিত না করে বাইরের কোন ক্ষতিকর বস্তু হিসেবে চিহ্নিত করে অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন তৈরি করে। যে বস্তুর কারণে অ্যালার্জি হয়, সে বস্তুকে এলার্জেন বা অ্যালার্জি তৈরিকারী বস্তু বলে।
প্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এলার্জেন প্রোটিন হয়ে থাকে। এ কারণেই বেশিরভাগ প্রাণিজ খাদ্যে অ্যালার্জি হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। কিন্তু শাকসবজিতেও কিছু পরিমাণ প্রোটিন থাকে, যা থেকেও অ্যালার্জি হওয়া স্বাভাবিক।
অ্যালার্জি শুধু খাবার থেকে হয় তা নয়, ধুলা, ধুয়া, পুকুরের পানি, বা এমন কোন পদার্থের সংস্পর্শে আসা যা আমাদের শরীর ক্ষতিকর বলে বোধ করে।
অ্যালার্জির উপসর্গ গুলো কি কি?
অ্যালার্জির ফলে নিন্মোক্ত উপসর্গ গুলো দেখা দিতে পারে-
-
নাক জ্বলা ও নাক দিয়ে পানি ঝরা।
-
চোখ মুখ ও কপালে ব্যথা ও জ্বলাভাব
-
কাশি, হাঁচি ও শ্বাসকষ্ট
-
চুলকানী ও রেশ
-
ডায়রিয়া
-
দুর্বল বা অসুস্থ্য বোধ করা
-
গলা, জিহ্বা, মুখ ফুলে যাওয়া
সাধারণত মৃদু অ্যালার্জিতে চুলকানী, রেশ ও হাঁচির মত উপসর্গ দেখা যায়। কিন্তু অ্যালার্জির প্রকোপ বাড়তে থাকলে শ্বাসকষ্টের মত সমস্যা তৈরি হয়, রক্তচাপ বেড়ে যায়, শ্বাসনালি সংকোচিত হয়ে আসে ও দ্রুত চিকিৎসা না নিলে কোমা বা মৃত্যুর মত ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ঠিক এ কারণেই যেকোন অ্যালার্জির উপসর্গই গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত। লেখাটির পরবর্তি অংশে অ্যালার্জি জনিত জরুরি অবস্থায় কি করনীয় তা আলোচনা থাকবে।
খাবারে অ্যালার্জি কিভাবে হয়?
খাবারে অ্যালার্জির হওয়ার পেছনের ঘটনাটা জানতে হলে একটু শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও অ্যান্টিবডি সম্পর্কিত সাধারণ তথ্য জানা প্রয়োজন। আশা করছি পুরো ব্যপারটা জানা থাকলে অ্যালার্জি জনিত সমস্যা গুলোয় আরো সচেতন হতে পারবেন।
আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এতো উন্নত ও জটিল যে, যেকোন বাইরের বস্তু, ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস বা এমন কোন পদার্থ শরীর ভেদ করে ঢুকলেই তা শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধরে ফেলতে পারে। ক্ষতিকর বস্তুর অনুপ্রবেশ টের পেলেই শরীর অ্যান্টিবডি পাঠায় যা ঐ ক্ষতিকর দ্রব্যের সাথে জোড়া লেগে সেটাতে অকেজো করে দেয় ও পরবর্তিতে শ্বেত রক্ত কণিকা সেটা খেয়ে ফেলে।
বিভিন্ন ধরণের অ্যান্টিবডি বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত। সেরকমই এক ধরণের অ্যান্টিবডি হচ্ছে, আইজিই (IgE)। IgE কোন ক্ষতিকর বস্তু দেখলে তা অকেজো করে দেয় যার ফলে অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন হয়। কিন্তু যখন IgE কোন এমন একটি বস্তু বা প্রোটিনকে ক্ষতিকর মনে করে যা আসলে ক্ষতিকর নয়, তাকে অ্যালার্জির সমস্যা বলা হয়।
খাবারে আমরা যা খাই তা ক্ষতিকর নয়, কিন্তু IgE খাবারের কিছু উপাদানকে ক্ষতিকর ভেবে ভুল করে ও অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন শুরু করে দেয়। বিভিন্ন রকম অ্যালার্জিক বস্তুতে ভিন্ন ভিন্ন রকম অ্যালার্জির উপসর্গ দেখা দিতে পারে, এবং তাতে অ্যালার্জির তীব্রতাও কম বেশি হতে পারে।
কোন খাবার গুলো খেলে অ্যালার্জি হয়?
হেলথলাইন ওয়েবসাইট এর মতে আমেরিকার ৯০% অ্যালার্জি হয়ে থাকে ৮ ধরণের খাবারের জন্য। সেই খাবার গুলো হলো,-
-
দুধ
-
ডিম
-
গাছের বাদাম (ট্রি নাটস)
-
চিনা বাদাম
-
শেলফিশ (চিংড়ি, কাকড়া)
-
আটা
-
সয়া ও
-
মাছ।
কিন্তু সাধারণত ভৌগলিক অবস্থান ভেদে এই লিস্টটি পরিবর্তন হতে পারে।
অ্যালার্জি হয়ে থাকে খাবারে থাকা প্রোটিন এর জন্য। সে প্রোটিন প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ্ব উভয় রকমই হতে পারে। এই প্রোটিন গুলো হলো এমন প্রোটিন যা আমাদের শরীর ক্ষতিকর ভেবে ভুল করে।
বিষয়টি হচ্ছে যে কোন খাবারের কারণেই অ্যালার্জি হতে পারে, যা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে-
-
গরুর মাংস
-
ইলিশ মাছ
-
পুঁইশাক
-
বেগুন
-
চিংড়ি ইত্যাদি খাবারের জন্য অ্যালার্জি বেশি লক্ষ করা যায়।
অ্যালার্জি হলে প্রথমত যে সব খাবারে অ্যালার্জি হয়ে থাকে সেই খাবার গুলো লিখে রাখা ঔ জাতীয় অন্যান্য খাবারে অ্যালার্জি আছে কিনা পরখ করে দেখা উচিত। অ্যালার্জির সমস্যা বেশি থাকলে কোথায় কি খাচ্ছেন এবং সেই খাবারটি কি দিয়ে তৈরি সেটা সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত। পরিবারের লোক ও বন্ধুবান্ধবদের অ্যালার্জির কথা জানানো উচিৎ, এবং কাছের কারো অ্যালার্জির সমস্যা থাকলে, যে যে খাবারে অ্যালার্জি দেখা দেয় তা পরিহার করতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সহয়তা করাটাও আমাদের দায়িত্ব।
অ্যালার্জি কিভাবে নির্ণয় করা হয়?
কোন খাবারে অ্যালার্জি হয় কিনা তা বিভিন্ন উপায়ে বের করা যায়। ডাক্তার আপনাকে অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী খাবার অল্প পরিমাণে দিয়ে লক্ষণ পর্যবেক্ষন করে অ্যালার্জি নির্ণয় করতে পারেন।
ত্বকে সাধারণ অ্যালার্জিক এজেন্ট গুলো দিয়ে রিঅ্যাকশন পর্যবেক্ষন করেও অ্যালার্জি নির্ণয় করা যায়। এ ধরণের পরীক্ষাকে স্কিন টেস্ট বলে।
অ্যালার্জি নির্ণয় করার আরেকটি সাধারণ মাধ্যম হলো ব্লাড টেস্ট। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে কোন কোন ধরণের খাবারে অ্যালার্জি হতে পারে তা নির্ণয় করা যায়। আপনার অ্যালার্জির ধরণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে একজন অ্যালার্জি বিশেজ্ঞ ডাক্তার (allergist) দেখাতে পারেন।
অ্যালার্জির চিকিৎসা
এখন পর্যন্ত অ্যালার্জি থেকে সম্পুর্ণ সুস্থ্য হবার খুব বেশি কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার হয় নি। যে যে খাবার গুলো থেকে অ্যালার্জি হয় সে খাবার গুলো এড়িয়ে চলাই অ্যালার্জির সবচেয়ে কার্যকরী সমাধান। যদিও অ্যালার্জি হলে অ্যালার্জির উপসর্গ গুলো কমিয়ে ফেলার জন্য কার্যকর ঔষধ রয়েছে। OTC, এন্টিহিস্টামিন, ও ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট অ্যালার্জিক ইনজেকশন অ্যালার্জির উপসর্গ কে কমিয়ে রাখতে সাহায্য করে।
বিপদের সংকেত গুলো কি কি? (Anaphylaxis)
খুব বেশি মাত্রায় অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন দেখা দিলে তাকে Anaphylaxis বলে। যাদের খুব বেশি অ্যালার্জি হয়ে থাকে তাদের বিপদ সংকেত গুলো জেনে রাখা জীবন মৃত্যুর পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। উপসর্গ গুলো হলো,
-
ত্বকে চুলকানী সহ লাল বা বেগুনী হয়ে ফুলে ওঠা।
-
রক্ত চাপ কমে যাওয়া।
-
শ্বাসকষ্ট, শ্বাসনালি সংকোচিত হয়ে আসা।
-
হাতের পালস দুর্বল হয়ে যাওয়া।
-
বমি ও ডায়রিয়া।
-
মাথা ঘোরা ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
এ ধরণের উপসর্গ গুলো দেখা দিলে খুব দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে। উপসর্গ চলে যাওয়ার অপেক্ষা করা উচিৎ নয়। যাদের এ ধরণের সমস্যা দেখা যায়, ডাক্তার অনেক সময় তাদের কাছে সবসময় epinephrine autoinjector রাখতে বলেন। এই ইনজেকশনটি পুশ করলে দ্রুত অ্যালার্জির রিঅ্যাকশন কমতে থাকে। রোগীকে ইনজেকশনটি দেওয়ার পরও হাসপাতালে নেওয়া অবশ্যক।
অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হবার কারণ
অ্যালার্জিতে ঠিক কি কারণে কেউ আক্রান্ত হন তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে পরিবারে কারো অ্যালার্জি থাকলে অন্যদেরও অ্যালার্জি হবার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। দূষণ ও পরিবেশগত কারণে অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। শিশুকে সঠিক বয়সের আগে মায়ের দুধ ছাড়া অন্যান্য খাবার খেতে দিলেও অ্যালার্জি হতে পারে। যেকোন বয়সেই অ্যালার্জি শুরু হতে পারে, অর্থাৎ আপনার পূর্বে কোন খাবারে অ্যালার্জি না থাকলেও কোন সময় যে হতে পারে না সে নিশ্চয়তা নেই।
শেষ কথা
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অ্যালার্জি রোগটির উপর আমাদের কোন হাত নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত আক্রান্ত হয়ে গেলে সুস্থ্য জীবনের জন্য সে খাবার এদিয়ে চলাই অ্যালার্জি থেকে নিস্তার দিতে পারে। অ্যালার্জির উপসর্গ গুলেকে অবহেলা করা কখনোই উচিৎ নয়।