ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড খাবেন যে ১২টি কারণে
ফ্যাট বা চর্বি মানেই কিন্তু ক্ষতিকারক নয়। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড বা ওমেগা-৩ চর্বি এমনই একটি ফ্যাট যা আমাদের দেহের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে সহায়তা করার পাশাপাশি শরীর সুস্থ রাখতেও এর ভূমিকা অসীম।
ফ্যাট শব্দটি শুনলেই আমাদের মধ্যে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। তবে সামুদ্রিক মাছ যেমন স্যামন টুনা, ম্যাকরেল, হেরিং, বিভিন্ন ধরণের বাদাম,তিসি উদ্ভিজ্জ তেল থেকে পাওয়া ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড ক্যান্সার, হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি হ্রাসে সহায়তা করে। বিস্তারিত জানতে প্রবন্ধটি সম্পূর্ণ পড়ুন।
আর, আপনি যদি ওমেগা ৩ কি এবং এটি কোন কোন খাবার থেকে পাবেন এসব নিয়ে বিস্তারিত জানতে চান তবে আমাদের এই লেখাটি পড়ে আসতে পারেন-
ওমেগা-৩ কি? ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ খাবার কোনগুলি?
ওমেগা-৩ খাওয়ার উপকারিতা
ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড আপনার দেহের সুস্থতার জন্য অবিশ্বাস্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আপনার শরীর এবং মস্তিষ্কের জন্য ওমেগা-৩ চর্বির অনেক শক্তিশালী স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের পুষ্টি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গবেষণা করা হয়েছে। এখানে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের এমন ১২টি স্বাস্থ্য সুবিধা রয়েছে যা বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত।
১. ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে
গবেষণায় দেখা গেছে যারা নিয়মিত ও পর্যাপ্ত পরিমাণে ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ খাবার খান তাদের মধ্যে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রায় ৫৫ শতাংশ হ্রাস পায়। ওমেগা ৩ তে এন্টিইনফ্ল্যামেটারী উপাদান থাকায় এটি ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধেও এটি কার্যকর।
২. হার্টের সুস্থতায় ভূমিকা রাখে
পূর্বের গবেষণা অনুযায়ী বলা হতো যেসব কমিউনিটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে মাছ খায় তাদের মধ্যে হৃদরোগের হার কম। বর্তমানে পর্যবেক্ষনমূলক গবেষণার তথ্য মতে, ওমেগা ৩ সমৃদ্ধ খাবার যেমন মাছ বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ এবং সিফুড হার্ট ফেউলুর ও করোনারি হার্ট ডিজিজ প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করে। কারণ ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড-
-
ট্রাইগ্লিসারাইড এর পরিমাণ হ্রাস করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হাই লেভেলের ট্রাইগ্লিসারাইড স্ট্রোক ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
-
এইচডিএল এর পরিমাণ বাড়াতে সহায়তা করে যা হৃদরোগ ও স্ট্রোক প্রতিরোধ করে। এইচডিএল হচ্ছে (হাই ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন) যা গুড কোলেস্টেরল নামে পরিচিত ।
-
রক্ত জমাট বাধতে বাধা দেয়।
সুষম খাদ্যের পাশাপাশি ওমেগা ৩ সমৃদ্ধ খাবার হার্ট ভালো রাখে তবে স্ট্রোক প্রতিরোধে ওমেগা ৩ সাপ্লিমেন্টের কোন অবদান নেই।
৩. ডিপ্রেশন দূর করতে সহায়তা করে
বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী বিষণ্ণতা অন্যতম একটি কমন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। এর ফলে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, মুড অফ, ক্লান্তি জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, অমনোযোগী হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। আনন্দের বিষয় হচ্ছে গবেষণায় দেখা গেছে যারা নিয়মিত ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার খান তাদের মধ্যে হতাশায় নিমজ্জিত হবার ঘটনা কম ঘটে।
সাধারণত, তিন ধরণের ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড রয়েছে যাদের মধ্যে ইকোসাপেন্টানোয়িক এসিড (ইপিএ) ডিপ্রেশন প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি কার্যকর যা সামুদ্রিক মাছের তেলে পাওয়া যায়। ডিপ্রেশন প্রতিকারে সাপ্লিমেন্ট হিসেবে এটি গ্রহন করতে হবে, তবে কতটুকু পরিমাণে খাবেন কিংবা আপনার জন্য কতটুকু দরকার তা জানতে অবশ্যই ডাক্তার কিংবা পুষ্টিবিদদের পরামর্শ নিতে হবে।
৪. অ্যালঝাইমার্স প্রতিরোধে সহায়তা করে
বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমতে থাকে এবং ভুলে যাওয়ার প্রবনতা বৃদ্ধি পায়, স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়। ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাদ্য ডিমেনশিয়া ও অ্যলঝাইমার্স রোগের ঝুঁকি হ্রাস করে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড ইনফরমেশন কাউন্সিল এর দেয়া তথ্যে বলা হয়েছে অ্যালঝাইমার্সে আক্রান্ত হওয়ার পর ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহন করলে তা কার্যকর হয় না সুতারং এই রোগ প্রতিরোধের জন্য অবশ্যই নিয়মিত খাদ্য তালিকায় ওমেগা ৩ রাখতে হবে।
প্রতিদিন কি পরিমাণ ওমেগা-৩ খাবেন?
৫. ভালো ঘুম হতে সহায়তা করে
সুস্বাস্থ্যের জন্য সাউন্ড স্লিপ খুব জরুরি। অপর্যাপ্ত ঘুমের ফলে স্থুলতা, ডায়াবেটিস, হতাশার মতো নানা ধরণের রোগ হয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে শরীরে ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিডের ঘাটতি হলে শিশু এবং প্রাপ্ত বয়ষ্কদের ঘুমের সমস্যা হয়।
এছাড়াও দেহে ডেকোসাহেক্সানয়িক এসিড (এটি এক ধরণের ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড) কম থাকলে মেলাটোনিন হরমোনের পরিমাণ হ্রাস পায়। উল্লেখ্য মেলাটোনিন হচ্ছে স্লিপ হরমোন। ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্ট শিশু এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের ভালো ঘুম হতে সহায়তা করতে পারে এবং ঘুমের সমস্যা দূর করতে পারে।
৬. চোখ ভালো রাখে
ডিএইচএ এক প্রকার ওমেগা-৩, যা চোখের রেটিনার একটি প্রধান কাঠামোগত উপাদান। পর্যাপ্ত ডিএইচএ এর অভাবে চোখের সমস্যা ম্যাকুলার ডিজেনারেশন দেখা দিতে পারে। ম্যাকুলার ডিজেনারেশন হচ্ছে রেটিনার কেন্দ্রীয় অংশের ক্ষতি যা সারা বিশ্বে চোখের স্থায়ী ক্ষতি এবং অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারণ। আবার অনেক সময় ডিএইচএ ও ইপিএ এই দুই ধরণের ওমেগা-৩ এর অভাবে চোখ শুষ্ক হয়ে যায়। তখন ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্ট নিলে সমস্যা সমাধান হয়ে যায়।
৭. আথ্রাইটিস প্রতিরোধ করে
আথ্রাইটিস হলে অস্থিসন্ধিতে অর্থাৎ জয়েন্ট ব্যথা, ফুলে যাওয়া বিশেষ করে হাঁটুতে সমস্যা বেশি দেখা দেয়। ওমেগা-৩ হাড়ে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বাড়িয়ে হাড়কে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। রিউমাটয়েড আথ্রাইটিস যেটি বাত রোগ নামে পরিচিত এর ফলে হাত ও পায়ের আঙুলের জয়েন্ট ব্যাথা হয় পরে হাটুতে ও ছড়িয়ে যায়। ওমেগা-৩ তে এন্টি ইনফ্লামেটারি উপাদান রয়েছে যা আথ্রাইটিস প্রতিরোধে সক্ষম। তবে এ রোগ হলে ওমেগা ৩ সাপ্লিমেন্ট এর সাথে রিউমাটয়েড আথ্রাইটিস এর মেডিসিন ও নিতে হবে।
৮. শিশুদের এ্যাজমা প্রতিরোধে সহায়তা করে
এ্যাজমা ফুসফুসের সমস্যাজনিত রোগ। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এ রোগের লক্ষণ হিসেবে কাশি,শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, কখনও কখনও শ্বাস নেয়ার সময় গলায় ঘরঘর আওয়াজ হয়। ওমেগা ৩ খাদ্য তালিকায় থাকলে তা শিশুদের শ্বাসকষ্ট প্রতিরোধে সহায়তা করবে।
৯. পিরিয়ডের ব্যাথা কমাতে সাহায্য করে
পিরিয়ড নারীর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং একই সাথে এটির উপর নারীর সুস্থতাও নির্ভর করে। পিরিয়ড চলাকালীন অনেক সময় তলপেটে ব্যাথা, পিঠে ব্যাথা ও দুর্বলতা অনুভব হয় যা মহিলাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বাধা হয়ে দাড়ায়। নিয়মিত ওমেগা ৩ গ্রহণ পিরিয়ডের ব্যাথা প্রতিরোধ করে। পিরিয়ড চলাকালীন সাপ্লিমেন্ট নিলে তা সিভিয়ার পেইন থেকে মুক্তি দেয়।
১০. ত্বকের সুস্থতায় ভূমিকা পালন করে
তিন ধরণের ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিডের মধ্যে ডিএইচএ এবং ইপিএ এই দুটি ত্বক ভালো রাখতে সাহায্য করে। ডিএইচএ ত্বকের গাঠনিক উপাদান এটি ত্বকের আবরণের সুস্থতা বজায় রাখে। আবার ইপিএ ত্বককে ভালে রাখতে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে যেমন
-
ত্বককে হাইড্রেট রাখে।
-
ত্বককে অকালে বুড়িয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।
-
ব্রনের ঝুঁকি কমায়।
-
ত্বককে সূর্যের আলোর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে। তবে হ্যা সানস্ক্রিন এর পরিবর্তে কিন্তু ওমেগা ৩ সাপ্লিমেন্ট কাজ করবে না।
১১. শিশুদের ব্রেন ডেভেলপমেন্টে সহায়ক
ওমেগা ৩ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে শিশুদের বৃদ্ধি ও মস্তিষ্কের বিকাশে। একজন মায়ের গর্ভাবস্থায় ও ব্রেস্ট ফিডিং কালে সপ্তাহে প্রায় ২২৪ থেকে ২৩৬ গ্রাম সিফুড খাওয়া উচিত যা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য খুব উপকারী। তবে যেসব সামুদ্রিক মাছে ইপিএ এবং ডিএইচএ আছে সেগুলো বাছাই করতে হবে যেমন সার্ডিন, স্যামন, হেরিং। গর্ভাবস্থায় ও শিশুকে ব্রেস্টফিড করানোর সময় ডিএইচএ ও ইপিএ সাপ্লিমেন্ট গ্রহন করলে তা শিশুর জন্য উপকারী হবে কিনা অর্থাৎ শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়ক হবে কিনা সেটি স্পষ্ট নয় তবে কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে সাপ্লিমেন্ট গ্রহনের ফলে শিশুর ওজন কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে।
১২. মেটাবলিক সিনড্রোম কমাতে সাহায্য করে
মেটাবলিক সিনড্রোম হলো কতগুলো রোগের লক্ষণের সমষ্টি যেমন
-
স্থুলতা।
-
পেটের চর্বি বৃদ্ধি।
-
উচ্চ রক্তচাপ।
-
হাই ট্রাইগ্লিসারাইড।
-
রক্তে শর্করা বৃদ্ধি।
-
(এইচডিএল) গুড কোলেস্টেরল এর পরিমাণ হ্রাস।
এগুলো ডায়াবেটিস ও হৃদরোগসহ বিভিন্ন ধরণের রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড ব্লাড গ্লুকোজ লেভেল হ্রাস করতে পারে ও হৃদরোগের ঝুঁকি সহ মেটাবলিক সিনড্রোমের রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো হ্রাসে ভূমিকা পালন করে।
পরিশেষ
ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড সর্বোপরি সুস্বাস্থ্যের জন্যই জরুরি। আমাদের চেষ্টা করতে হবে নিয়মিত যতটা সম্ভব ন্যাচারাল সোর্স থেকে খাবারের মাধ্যমে ওমেগা ৩ গ্রহন করা।