অতিরিক্ত লবণ খেলে কি হয়! জেনে নিন যেভাবে লবণের ব্যবহার কমানো যায়!

লবণ নাকি স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর! লবণ খেলে নাকি হৃদরোগ হয়, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যে ক্ষতিকর ইত্যাদি। লবণের গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য ও ব্যবহার আলোচনা করব এখানে।

আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে বহুল ব্যবহৃত একটি উপাদান হলো লবণ। লবণ ছাড়া দিন বা জীবন ভাবাও যায় না, অন্তত  খাবার এর কথা ভাবা যায় না। খাবার এর সাথে বা খাবার এর স্বাদ বৃদ্ধি করতে প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ খাবার এর সাথে লবণ মেশানোর কৌশল রপ্ত করেছিল। যার ধারাবাহিকতায় আজ আমরা লবণের স্বাদ যুক্ত খাবার খাই। আর এই লবণ নিয়ে প্রচলিত নানা রকম গল্প বা নানা রকম ঘটনা আমরা সবাই জানি। আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে লবণ খুব গুরুত্বপূর্ন উপাদান। লবণ যে শুধু খাবার এর স্বাদ বৃদ্ধিতেই ব্যবহার হয়  তা নয়, এছাড়াও লবণ এর নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। 

লবণ কি? 

লবণ হলো খাদ্যে ব্যবহৃত এক প্রকার দানাদার পদার্থ যার মূল উপাদান হলো সোডিয়াম ক্লোরাইড(Nacl)। এটি প্রাণীর জীবন ধারনের জন্য অপরিহার্য, কিন্তু অধিকাংশ স্থলজ উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর। লবণের স্বাদকে মৌলিক স্বাদের একটি হিসেবে গণ্য করা হয়। পৃথিবীর সর্বত্র এটি খাদ্য প্রস্তুতিতে ব্যবহার করা হয়। 

রসায়নে লবণ হলো একটি আয়নিক যৌগ যা অম্ল ও ক্ষারকের মধ্যে সংগঠিত প্রশমন বিক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপন্ন হয়। সোডিয়াম ও ক্লোরিন মিলে এটি তৈরি হয় এবং একসাথে একে সোডিয়াম ক্লোরাইড (Nacl)  বলে। লবণ এর মধ্যে ৪০% সোডিয়াম ও ৬০% ক্লোরিন থাকে। এই লবণের সাথেই আয়োডিন যোগ করে আয়োডিনযুক্ত লবণ বা টেবিল সল্ট তৈরি করা হয়। 

লবণ এর উৎস

সাধারণত আমরা যে সব লবণ  দেখি বা ব্যবহার করে থাকি তা অধিকাংশ সমুদ্রের পানি প্রক্রিয়া করে তৈরি করা হয় এবং মাটির গভীর থেকে বা খনি থেকে পাওয়া যায়। তবে সমুদ্রের পানিই লবণের প্রধান উৎস। ভূ-ত্বাত্তিকগণের মতে, পৃথিবী সৃষ্টির সময় ভূ-ভাগের অনেক লবণাক্ত অংশ গলে সমুদ্রের পানিতে মিশে সমুদ্রের পানি লবণাক্ত হয়ে যায়। তাছাড়া বন্যা, বৃষ্টির মত ঘটনায় ভূ-ভাগের অনেক লবণ পানিতে মিশে সমুদ্রের পানি লবণাক্ত করে। যে কারনে সুমুদ্রের পানি লবণাক্ত। এই সমুদ্রের পানি বাষ্পীভবন এর মাধ্যমে লবণ উৎপন্ন করা হয়। 

সমুদ্রের পানিতে লবণ পরিমাপ করা হয় সহস্রাংশ হিসেবে। অর্থাৎ প্রতি ১০০০ গ্রাম এ। সমদ্রের পানিতে প্রায় ৩৫ সহস্রাংশ বিভিন্ন রকম লবণ রয়েছে। সমুদ্রের পানিতে যে সব লবণ দ্রবীভূত থাকে তা হলো, 

  • সোডিয়াম ক্লোরাইড

  • ম্যাগনেশিয়াম ক্লোরাইড

  • ম্যাগনেশিয়াম সালফেট

  • ক্যালশিয়াম সালফেট

  • পটাশিয়াম সালফেট

  • ক্যালশিয়াম কার্বনেট

  • ম্যাগনেশিয়াম ব্রোমাইড,

এছাড়া লবণের আর একটি বড় উৎস হলো খনি। মাটির গভীর থেকে প্রচুর খনিজ লবণ উত্তোলন  করা হয়। ইসরায়েলের গুহা সন্ধানিরা ‘’ডেড সি ‘’ র কাছেই পৃথিবীর দীর্ঘতম সল্ট কেভ বা লবণ গুহা আবিষ্কার এর কথা স্বীকার করেছেন। গুহাটির নাম ‘’মালহাম ‘’। এটি ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এর আগে ইরানের কেশম দ্বীপের ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ গুহাটি বৃহত্তম বলে পরিচিত ছিল। পৃথিবীতে এমন অনেক লবণ গুহা রয়েছে, রয়েছে অনেক অনেক লবণ খনি। এসব খনিতে রয়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন টন লবণ।

বিভিন্ন প্রকার লবণ 

যে লবণ ছাড়া আমাদের চলে না, যে লবণ আমাদের খাবার এর স্বাদ এর প্রধান উপাদান সেই লবণকে বলা হয় রস বা স্বাদের রাজা। শাস্ত্রমতে স্বাদ ছয় রকমের – অম্ল, মধুর, লবণ, কটু, তিক্ত ও কষা। লবণ কে বলা হয় প্রধান রস। লবণ ছাড়া সব খাবার, সব মশলা, সব স্বাদ নিরর্থক। 

সভ্যতার আদিযুগ থেকে যে লবণ খাওয়া শুরু তার রয়েছে অনেক রকম ফের। লবণের অনেক গুলো রকমের মধ্যে প্রধানত পাঁচ ধরনের লবণ ব্যবহার করা হয়। সেগুলো হল, 

সৈন্ধব লবণঃ খনিতে উৎপন্ন। এই লবণই সর্বশ্রেষ্ঠ। মাটি মিশ্রিত থাকে এই লবণ। কালো রঙ এর এই লবণকে কালো লবণও বলা হয়।

সম্বর বা কস্তুরি লবণঃ রাজস্থানের সম্বর সরবরের পানি থেকে এই লবণ তৈরি করা হয়।

সামুদ্রিক লবণ বা কেল্টিক লবণঃ অপরিশুদ্ধ, অপ্রক্রিয়াজাত লবণ হল কেল্টিক লবণ। এর গন্ধও অন্য  রকম। সমুদ্রের পানিকে বাষ্প করে এই লবণ তৈরী করা হয়।

বিট লবণঃ বিট লবণ এর আরেক নাম হলো সুলেমানি লবণ। এটি এক ধরনের খনিজ লবণ। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, ভূটান ও হিমালয় এর নিকটবর্তী খনিতে এই লবণ পাওয়া যায়। খনিতে এই লবণ পাথর আকৃতিতে পাওয়া যায়। সোডিয়াম সালফেট সমৃদ্ধ এই লবণ রূপ চর্চার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। বিট লবণের স্বাদ আমাদের সাধারন লবণ এর মত তবে এর ক্রিস্টাল গুলো আকারে একটু বড়।

পাথুরে লবণ বা হিমালয়ের গোলাপি লবণঃ পাথুরে লবণ বা হিমালয় লবণ দেখতে গোলাপি রঙ এর। এই লবণ পাওয়া যায় হিমালয়ের খেওড়া খনিতে, যা পাকিস্তানে  অবস্থিত। এই খেওড়া খনিটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো ও বৃহদাকৃতির লবণের খনির একটি। সাধারণ লবণের মত এইই লবণ ও প্রধানত সোডিয়াম ক্লোরাইড। তবে আরো অনেক খনিজ রয়েছে এই লবণ এ। লোহা থাকার কারনে এই লবণ গোলাপি রঙ এর। 

লবণ ও আয়োডিন এর সম্পর্ক

লবণ হলো দানাদার সোডিয়াম ক্লোরাইড আর আয়োডিন হলো একটি মৌলিক পদার্থ। পৃথিবীতে আয়োডিন এর প্রধান উৎস হলো সমুদ্রের পানি। আয়োডিন সমুদ্রের পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। 

এখন কথা হল আয়োডিন এর প্রাপ্তি নিয়ে, কোথায় আমরা আয়োডিন পাবো। যেহেতু আয়োডিন উদ্বায়ী পদার্থ, তাই সমুদ্রের পানি থেকে প্রাপ্ত লবণেও আয়োডিন এর পরিমান খুব কম থাকে। তাই সুমুদ্রের পানি থেকে  তৈরি লবণ থেকে যখন খাবার লবণ তৈরি করা হয় তখন তার সাথে আয়োডিন মেশানো হয়।

তাছাড়া প্রাকৃতিক বিভিন্ন উৎস থেকেও আয়োডিন পাওয়া যায়। যেমন সামুদ্রিক তাজা মাছ বা শুটকি মাছ, সমুদ্রের নিকটবর্তী অঞ্চল সমুহে উৎপাদিত বিভিন্ন শাকসবজি ও ফলমূল। তাছাড়া তাজা মাছ ও ঠান্ডা দুধেও প্রচুর আয়োডিন থাকে।

আয়োডিনযুক্ত লবণের প্রয়োজনীয়তা

আমাদের খাবারে যেমন লবণ এর প্রয়োজনীয়তা অনেক তেমনি আমাদের শরীরে আয়োডিন এর প্রয়োজনীয়তা অনেক। আয়োডিন এর অভাবে আমাদের বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। 

গর্ভবতী মায়ের আয়োডিন এর অভাবে গর্ভপাত বা বিকলাঙ্গ সন্তান হতে পারে। তাছাড়া স্নায়ুবিক দুর্বলতা, বধিরতা, বামনত্ব, বাকশক্তিহীনতা, মানসিক প্রতিবন্ধকতা, শিশুর স্বাভাবিক ও সুস্থ্য মানসিক বিকাশ ব্যহত হয়। তাছাড়া মাথার চুল কমে যাওয়া, পড়াশুনায় মন না বসা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়ার মত সমস্যা আয়োডিন এর অভাবে হয়। যেসব সমস্যা হয়ে থাকে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো,

  • ভ্রূণকালঃ আয়োডিনের অভাবে ভ্রূণকালে ভ্রূনের মৃত্যু বা মৃত শিশুর জন্ম হতে পারে , শিশুর জন্মগত ত্রূটি হতে পারে বা শিশু মানসিক প্রতিবন্ধী হতে পারে।

  • নবজাতকঃ নবজাতকের হাইপোথাইরয়েডিজম হতে পারে।

  • শৈশব ও কৈশোরত্তোর কালঃ আয়োডিনের অভাবে গলগণ্ড , দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যহত, হাবা গোবা, ট্যারা, কালা, বামনতার মত অসুস্থ্যতা হয়ে থাকে।

  • প্রাপ্তবয়ষ্কঃ আয়োডিনের অভাবে প্রাপ্তবয়ষ্কদের গলগন্ড , মিক্সিডিমা রোগ হতে পারে।  

আর এসব মারাত্মক রোগ থেকে রেহাই পেতে হলে অবশ্যই আয়োডিন যুক্ত লবণ বা আয়োডিন যুক্ত খাবার খেতে হবে। আর এসবের উপযুক্ত মাধ্যম হতে পারে বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ বা শাকসবজি।

লবণ নিয়ে কিছু তথ্য ও পরিসংখ্যান

আমাদের শরীর সুস্থ রাখার জন্য লবণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে অনেক। খাবারে এর অতি প্রয়োজনীয়তা তো রয়েছেই। এছাড়াও রয়েছে এর আরও ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব। 

  • বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করলে হৃদরগের ঝুকি বাড়ে। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘’ দ্য বিএমজি ‘’ থেকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অতিরিক্ত লবণ যুক্ত খাবার স্ট্রোক ও হৃদরোগের ঝুকি বাড়ায়। 

  • বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে অধিকাংশ মানুষই অতিরিক্ত পরিমাণে লবণ গ্রহন করে থাকে যা প্রায় (৯-১২) গ্রাম /প্রতিদিন। এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে অতিরিক্ত লবণ গ্রহন উচ্চরক্ত চাপের একটি প্রধান কারণ। 

  • যুক্তরাজ্যের ‘’ দ্য জার্নাল অব নিউট্রেশন, হেলথ এন্ড এনার্জিং ‘’ এর তথ্য অনুযায়ী, বেশি সোডিয়াম যুক্ত খাবার উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

  • আমেরিকানরা প্রতিদিন প্রায় ৩৪০০ মিঃগ্রাঃ সোডিয়াম খাবার এর সাথে খেয়ে থাকে। অন্যদিকে এক চা চামচ খাবার লবণে ২৩২৫ মিঃগ্রাঃ সোডিয়াম থাকে। কিন্তু পুষ্টি বিদদের মতে একজন পূর্নবয়ষ্ক মানুষের দৈনিক ২৩০০ মিঃগ্রাঃ সোডিয়াম খাওয়া উচিত। তবে যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, বা কিডনি সমস্যা রয়েছে তাদের সোডিয়াম কম খাওয়া উচিত তবে তা ১৫০০ মিঃগ্রাঃ এর কম নয় বলে পুষ্টিবিদদের পরামর্শ।

  • দক্ষিন আফ্রিকানরা সারা বিশ্বে বেশি লবণ খাওয়ার জন্য আলোচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে একজন পূর্ন বয়ষ্ক মানুষ দিনে ৫ গ্রাম লবণ খাওয়া উচিত। কিন্তু দক্ষিন আফ্রিকানরা দৈনিক ৮,৫০ গ্রাম লবণ খায়, যা অতিরিক্ত। যে কারনে ঐ অঞ্চলের মানুষের হৃদরোগ, স্ট্রোক বা ক্যান্সার এর মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবনতাও বেশি। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বছরে প্রায় ২৫ লাখ মানুষের অপমৃত্যু শুধু অতিরিক্ত লবণ গ্রহনের কারণে।

খাবারে লবণের উপকারিতা 

খাবারে লবণের ব্যবহার ও প্রয়োগের বিস্তৃতি ব্যাপক। আবার আমরা খাবার খেলে যেসব এনজাইম সেই খাবার হজম করতে সাহায্য করে সেই সব এনজাইম এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে লবণ। যে সব কাজে লবণ গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো,

থাইরয়েড প্রক্রিয়ায়ঃ থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত একটি বিশেষ এনজাইম আমাদের হজম প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়,যা খাবার হজমে সাহায্য করে। এই এনজাইমটি নিঃসৃত হতে তরল আয়োডিন সহায়তা করে। এই আয়োডিন আমরা বিভিন্ন শাক সবজি, ফল ও আয়োডিন যুক্ত লবণ থেকে পেয়ে থাকি। 

শরীরে পানির তারতম্য ঠিক রাখাঃ লবণ শরীরের অতিরিক্ত পানি শোষন করে নেয়। লবণ শরীরে পানির সঠিক সরবরাহ ঠিক রাখে। যে কারনে শরীরের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঠিক পরিমানে পানির সরবরাহ পেয়ে থাকে এবং কাজ করতে পারে। আমাদের শরীর যখন পানিশূন্যতায় ভূগে তখন পানির সাথে লবণ মেশানো হয়,যার ফলে শরীরের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঠিক পরিমাণে পানি শোষণ করে কার্যক্ষম হয়ে ওঠে। 

লো ব্লাড প্রেসার বা নিম্ন রক্তচাপ প্রতিরোধঃ আমাদের শরীরে সোডিয়াম এর অপর্যাপ্ততা লো ব্লাড প্রেসার এর কারণ। তাই নিম্ন রক্তচাপ বা লো ব্লাড প্রেসার প্রতিরোধ করার জন্য সোডিয়াম এর এই উৎসই (লবণ) উত্তম ব্যবস্থা। 

তাছাড়া আরও কিছু উপকারী দিক রয়েছে লবণের যা আমাদের শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। লবণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কিছু গুণাগুণ হল,

  • রক্ত পরিষ্কার রাখতে

  • গোসলে উপকার পেতে

  • বুকের জ্বালা সারাতে

  • ত্বকের যত্নে

  • গলার সমস্যা দূর করতে 

  • শুকনা কাশি ও কফ দূর করতে

  • ব্যাথা সারাতে

  • পেট থেকে বিষ সারাতে

  • কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে

  • কৃমিনাশ করতে

  • প্রসাব এর সমস্যা দূর করতে

  • দাঁতের সমস্যায়

  • হার্নিয়ার সমস্যায়

  • বিষাক্ত পতঙ্গের কামড়ে

  • বিভিন্ন প্রকার জ্বর সারাতে

লবণ এর কিছু ব্যতিক্রমী ও বিশেষ ব্যবহার

শুধু খাবার এর স্বাদ বৃদ্ধি করার জন্য বা শরীরে সোডিয়াম এর প্রয়োজন মেটাতেই লবণ এর ব্যবহার হয় না। এছাড়াও অনেক ব্যবহার রয়েছে লবণের,

বাগান পরিচর্চায়ঃ আপনার শখের বাগানে লবণের রয়েছে এক বিশেষ ব্যবহার। ইপসাম লবণ যার রাসায়নিক নাম হলো হাইড্রেট ম্যাগনেশিয়াম সালফেট। আমাদের দৈনন্দিন ঘরোয়া জীবনে নানা সমস্যা সমাধান করে এই ইপসাম লবণ। বিশেষ করে অর্গানিক ফার্মারদের কাছে এর বিশেষ চাহিদা। 

আপনাদের শখের বাগানে যেসব উপকারী কাজ গুলো করবে এই ইপসাম লবণ তা হলো – এই লবণ বীজের সফল অংকুরোদগমে ভূমিকা রাখে, মাটির পুষ্টি শোষণ বৃদ্ধিতে ভুমিকা রাখে, আকর্ষনীয় ও পর্যাপ্ত গোলাপ উৎপাদনে, ক্ষতিগ্রস্ত মূলের ধাক্কা সামলাতে, মরিচের ফলন বৃদ্ধিতে, পাতার ক্লোরোফিল বৃদ্ধিতে, পাতা কোঁকড়ানো প্রতিরোধে, কীটপতঙ্গ বাগান থেকে দূরে রাখতে, ফলের মিষ্টতা আনায়নে, সুস্বাদু টমেটো উৎপাদনে এই লবণ ব্যাপক হারে ব্যবহার হয়। 

বুকের জ্বালা সারাতেঃ যদি বেশি খাওয়ার পরে আপনার বুকে জ্বালা করে বা পেটে ব্যাথা করে তবে লবণ বা এক গ্লাস পানিতে এক চা চামচ লবণ গুলে খেয়ে দেখতে পারেন। এতে জ্বালা বা ব্যাথা উপশম হয়। 

বিষাক্ত পোকাড় কামড়েঃ বিষাক্ত পোকাড় কামড়ের স্থানে লবণ দিয়ে রাখলে পোকাড় বিষ উপশম হয়।

চর্বি তুলতেঃ আপনার হাড়ি,কড়াই বা ওভেন এ লেগে থাকা চর্বি তুলতে আপনি লবণ ব্যবহার করতে পারেন। এটি ভালো উপকারে দিবে। এছাড়া আরও কিছু টোটকা ব্যবহার হলো, 

  • ডিম সিদ্ধ করার সময় এক চা চামচ লবণ দিয়ে দিন ,সহজে খোসা ছাড়ানো যাবে।

  • এক কার্টন দুধে দিয়ে দিন এক চিমটি লবন ,দীর্ঘদিন ভালো থাকবে।

  • হাত থেকে পেঁয়াজ ,রসুন এর গন্ধ দূর করতে ভিনেগার এর সাথে লবন মিশিয়ে হাত ধুয়ে নিন।

  • সবুজ শাকসবজি সামান্য লবণ দিয়ে সিদ্ধ করলে সবজির রঙ নষ্ট হয় না। 

  • বেকিং সোডার সাথে লবন মিশিয়ে পেস্ট হিসেবে দাঁত ব্রাস করলে দাঁতের হলদে দাগ দূর হয়।

  • লোহার পাত্র পরিষ্কার না হলে লবণ ছিটিয়ে শুকনা কাপড় দিয়ে ঘষে মুছে নিন , পরিষ্কার হয়ে যাবে।

  • কুসুম গরম পানিতে সামান্য লবণ ব্যবহার করে মাউথওয়াস হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।

  • অলিভ অয়েলের সাথে লবণ মিশিয়ে স্ক্রাব বানিয়ে ব্যবহার করুন ত্বকে। ত্বকের মরা চামড়া দূর হবে।

  • রূপা বা কপার এর তৈজসপত্র পরিষ্কার করার জন্য লবণ ছিটিয়ে শুকনা কাপড় দিয়ে ঘষে মুছে নিন। তারপর পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিন। ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে যাবে। 

  • লবণ-পানিতে আপেলের টুকরা ভিজিয়ে নিন তাহলে আর বাদামি হবে না।

মরিচা তুলতেঃ লেবুর রস ও লবণ এর মিশ্রণ কোনো মরিচা ধরা বস্তুর উপর প্রলেপ আকারে দিয়ে এক ঘন্টা অপেক্ষা করুন।দেখবেন মরিচা উঠে গেছে। 

পিঁপড়া দূর করাঃ যেখান থেকে পিপড়া আপনার ঘরে প্রবেশ করে, সেখানে লবণ ছিটিয়ে দিন, দেখবেন আর পিপড়া ঢুকবে না। 

দাঁত পরিষ্কার করতেঃ এক ভাগ খাবার লবণ ও দুই ভাগ বেকিং পাউডার মিলিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করে ব্যবহার করে দেখুন। ভালো ফল পাবেন। 

ঘাস আগাছা দমনেঃ আপনার উঠান এ যদি ঘাস,আগাছা জন্মে – লবণ ছিটিয়ে দিন,জন্মাবে না। 

দাগ দূর করতেঃ কার্পেট বা অন্য কোনো কিছুর দাগ তুলতে লবণ ব্যবহার করতে পারেন। 

রূপচর্চায়ঃ আপনার ত্বক এর উপর লবণ এর মিশ্রণ দিয়ে স্ক্রাব করলে ত্বকের মরা কোষ উঠে আপনার ত্বককে আরো জীবন্ত করে তুলবে। 

অতিরিক্ত লবণ ব্যাবহারের কিছু অপকারিতা

অতিরিক্ত লবণ খেলে বা ব্যবহার করলে কিছু ক্ষতির কারন হয়ে উঠে উপকারী এই লবণ।

  • লবণ বেশি খেলে পাচন ক্রিয়া, রক্ত, মাংস, মেদ প্রভৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

  • লবণ বেশি খেলে চর্মরোগ, রক্তবিকার, শুক্রক্ষয়, সন্ধিতে ব্যাথা, মাথায় ব্যাথা, মূত্ররোগ প্রভৃতি অসুখ বৃদ্ধি পায়।

  • অতিরিক্ত লবণ ব্যবহার এর ফলে উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হয়। 

  • বেশি লবণ খেলে পিপাসা বেড়ে যায়। কারণ অতিরিক্ত লবণ খেলে তা দেহের কোষে পানির ভারসাম্য বজায় রাখতে বাধা সৃষ্টি করে। 

  • অতিরিক্ত লবণ খেলে তা শরীরে বেশি পানি ধরে রাখে যা কিডনির উপরে প্রভাব ফেলে।

  • কিডনিতে পাথর হওয়ার একটি প্রধান কারণ অতিরিক্ত লবণ খাওয়া।

  • অতিরিক্ত লবণ গ্রহণে শরীরে পানির পিপাসা তৈরি হয়। এতে বেশি বেশি পানি খাওয়া হয়। ফলে বেশি বেশি প্রসাব হয় ও প্রসাব এর সাথে শরীর থেকে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম বের হয়ে যায়। একে অস্টিওপোরোসিস বলে।এর ফলে হাড় দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়।  

যেভাবে লবণের ব্যবহার কমানো যায়

আমাদের প্রত্যাহিক জীবন লবণ ছাড়া চলেই না। লবণ আমাদের খেতে হয়ই। কিন্তু প্রয়োজনের চেয়ে বেশি লবণ খাওয়া যাবে না। আমরা প্রতিদিন যে খাবার খাই, তাতে প্রচুর লবণ থাকে, তাই খাবারে বাড়তি লবণ নেওয়া যাবে না। রান্নার সময় যতটা সম্ভব কম লবণ দিয়ে রান্না করুন।

সরকারি বেসরকারি ভাবে লবণ বিষয়ক সচেতনতার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম ,প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। স্কুল , কলেজ , বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত লবণ এর অপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।

প্যাকেটজাত মাছ,মাংস কম খান। ফাস্টফুড, হোটেল ক্যান্টিন এর খাবারে প্রচুর লবণ থাকে,তাই এসব খাবার এড়িয়ে চলুন। শিশুকাল থেকে বাচ্চাদের কম লবণ এর অভ্যাস গড়ে তুলুন। শুটকি, আচার এ প্রচুর লবণ থাকে, এইসব এড়িয়ে চলুন।

খাবার সংরক্ষণ এর জন্য লেবু রস, ভিনেগার, কাঁচা রসুন ব্যবহার করুন। বিভিন্ন রকম কাচা ফল যেমন আম, জাম, কামরাঙ্গা, আমড়া, জলপাই, আনারস ইত্যাদি খাওয়ার সময় আমরা অনেক লবণ খেয়ে থাকি  এগুলোতে লবণ কম খেতে হবে। 

লবণ আমাদের জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। লবণ ছাড়া একটি দিন, একটি মুহুর্তও ভাবা যায় না। জিভ এ জল আনা মজাদার খাবার গুলো লবণ ছাড়া মূল্যহীন। লবণ ছাড়া খাবার কেউ মুখে দিয়ে দেখবে না। শুধু খাবার এর স্বাদ এর জন্যই নয়, খাবারের পুষ্টিমান বৃদ্ধিতেও লবণ এর প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রমে লবণ অপরিহার্য। লবণের উপস্থিতি ছাড়া আমাদের সুস্থ্য স্বাভাবিক জীবন কল্পনাও করা যায় না। তবে লবণ এর অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের জন্য সাপে বর হতে পারে। হতে পারে ক্ষতির কারণ। তাই লবণ এর ব্যবহার জানতে হবে সঠিক ভাবে। জেনে নিতে হবে একজন পুষ্টিবিদ বা একজন বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে। তবেই অতি প্রয়োজনীয় লবণ আমাদের জীবনে উপকারী লবণে পরিনণত হবে।

Default user image

খন্দকার মোঃ শওকত হোসেন, লেখক, আস্থা লাইফ

বরিশাল এর নিভৃত ও মনোরম একটি গ্রামে জন্ম। সাহিত্য অনুরাগী মা-বাবার কাছেই লেখালেখির হাতেখড়ি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করলেও লেখালেখির দিকেই ঝোঁকটা বেশি। তাই অবসরে লেখালেখির চেষ্টা করি। লেখনীর মাধ্যমে যদি কারো উপকার করা যায় কিংবা কোন পরিবর্তনের সূচনা করা যায়, তাহলে তৃপ্তিটা আসে মন থেকে। এই উদ্দেশেই আস্থা লাইফ পরিবারে যোগ দেয়া। আমার লেখার মাধ্যমে কারো মধ্যে কিঞ্চিৎ সচেনতাও যদি সৃষ্টি করতে পারি, সেইটাই হবে পরম পাওয়া।

Related Articles